বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

কোভিড-১৯ ও বাংলাদেশের শিক্ষা সংকট

নতুনধারা
  ১২ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সীমিত এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে বেশির ভাগ দেশে। কার্যত সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থায় এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এর মধ্য স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক নানা পরিকল্পনার কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছি। কিন্ত করোনার এই সময়ে শিক্ষা নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে না। অনেকেই ভাবছেন, জীবন বাঁচানোর কার্যক্রম যেখানে পর্যাপ্ত নয়, সেখানে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা কতটা যৌক্তিক? কিন্তু আসল ব্যাপার হলো শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে জীবন বাঁচানোর জন্যই। শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা আগামীর করোনামুক্ত পৃথিবীতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাব না। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে আমাদের সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশ সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। এই সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছে। খুব সহজে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে যেখানে অনেক পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, সেখানে সবার ঘরে টেলিভিশন থাকবে সেটা চিন্তাও করা যায় না। তাই অনেক শিক্ষার্থী পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই সংকটকালকে পুঁজি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে নামেমাত্র ক্লাস পরীক্ষা গ্রহণের নাম করে শিক্ষার্থীদের থেকে সেমিস্টার ফি আদায় করছে। অন্যদিকে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস না নিলেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত পরিসরে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। তাতে উপস্থিতির সংখ্যা খুবই নগণ্য। কারণ অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষে উচ্চমূল্যের কচ্ছপগতির ইন্টারনেট ক্রয় করে অনলাইনে ক্লাস করা অসম্ভব। আর বিনা আয়োজনে এরকম অপরিপক্ব পদ্ধতিতে ক্লাস নিয়ে তেমন উপকার যে হবে না, সেটা শিক্ষামন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন। তারপরও আজ অথবা কাল আমাদের অনেক কিছুই অনলাইননির্ভর হয়ে যাবে। তাই আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে এবং পরিকল্পনা করতে হবে।এখন তাহলে আমাদের উপায় কী হবে? আমরা নিশ্চিত যে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। সেসব বিষয় আমলে নিয়ে আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। শিক্ষা খাতে ইউনেস্কোর চাওয়া জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ। তা ছাড়া আমরা যদি এসডিজির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলেও শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এসডিজির চার নম্বর লক্ষ্যে শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলা হলেও এটিই মূলত অন্যান্য লক্ষ্য পূরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও নীতি প্রণয়ন এবং বিশেষ করে জাতীয় বাজেটে এর প্রতিফলন নিয়ে পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা করা একটি সময়োপযোগী অপরিহার্য উদ্যোগ। আমরা যদি প্রতি অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যায় যে বাজেটে শিক্ষা খাতের সঙ্গে সবসময় প্রযুক্তি বাজেট সংযুক্ত থাকে। অথচ সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ ও তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা উচিত। উদাহরণ হিসেবে যদি গত বছরের বাজেটও দেখি, তাতে শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কার্যত শিক্ষা খাতের প্রকৃত বাজেট পরিকল্পনাটি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। গতবারের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেট বরাদ্দ ১৫.২ শতাংশ দেখালেও মূলত শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১১.৭ শতাংশ। জিডিপির শতাংশ হারেও শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ স্থবির রয়েছে। শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ এ বছরেও জিডিপির ২.১০ শতাংশ। অথচ ইউনেস্কো এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কে (বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষরকারী ও সমর্থনকারী দেশ) একটি দেশের জিডিপির ৪-৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও উলেস্নখ আছে জিডিপির অন্তত ২.৮৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার। অথচ প্রতি বছর শিক্ষা খাতের এই আর্থিক প্রতিশ্রম্নতির বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অথচ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া অন্যসব দেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির শতাংশ হারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা শিক্ষা খাতে যথাক্রমে জিডিপির ৩.৮, ৩.৭ ও ৩.৬ শতাংশ ব্যয় করে। ভুটানের শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ৬ শতাংশ। এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। কোভিড-১৯ আমাদের একটা বিষয় দেখিয়ে দিয়ে গেল যে, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে আমাদের পাঠদান কার্যক্রম বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে অনলাইনকেন্দ্রিক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনলাইনে পাঠদানে যে অন্তরায়গুলো আছে সেগুলো নিরসনে বাজেট বৃদ্ধিসহ সরকারকেই সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। সব ছাত্রছাত্রীকে সমান সুযোগ তৈরি করে তবেই অনলাইনে পাঠদান পরিচালনা করা দরকার। প্রশিক্ষিত শিক্ষক, উচ্চমূল্যে ও মন্থরগতির ইন্টারনেট, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানোসহ সব শিক্ষার্থীদের হাতে অনলাইনে ক্লাস করতে যা লাগে তা সরকারেই ব্যবস্থা করতে হবে। সে পক্ষত্রে আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আজ কোভিড-১৯ আমাদের পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। ভবিষ্যতে এর চেয়েও যদি মারাত্মক কোনো দুর্যোগের আমাদের মুখোমুখি হতে হয়? এর চেয়ে আরও বেশিদিন যদি আমাদের ঘরে থাকতে হয়? তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখাসহ জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উৎপাদনসহ নানান বিষয় মাথায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সবকিছু আমলাতান্ত্রিক হওয়ার কারণে সাধারণ জনগণের অধিকার বুঝে পাওয়া প্রশ্নে নানান সংকট তৈরি হয়েছে। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ৭২-এর সংবিধানকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংবিধানের ৪ মূলনীতির সমন্বয়ে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তাই আমাদের দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে অবশ্যই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের আসন্ন বাজেট প্রণয়ন করতে হবে এবং মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো যেন সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারে তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।

আব্দুর রউফ

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108462 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1