আমরা কতটা স্বাস্থ্যসচেতন?

রাস্তাঘাটে বাজারে গণপরিবহণে মানুষ মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করছে। দেশে যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে এটা তারা মনেই করছে না। ফলে বিপদ বাড়ছে। সারা বিশ্বে মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের চেয়েও সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মাস্ক ব্যবহার করা।

প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
ছোটবেলায় পড়েছি 'স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল'। শরীর ভালো না থাকলে সব কিছুই অর্থহীন মনে হয়, এমনকি বেঁচে থাকাও। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন- 'চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন ব্যথিতবেদনা বুঝিতে পারে। কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে, দংশেনি যারে।' সাপে যারে দংশন করেনি, সে কী করে সাপের বিষের যাতনা বা মর্মজ্বালা উপলব্ধি করতে পারবে। অন্যভাবে বলা যায়, যিশুর ক্রুশ যিশুকেই বহন করতে হয়েছে। যে বা যিনি করোনায় আক্রান্ত, যার সন্তান, স্বজন আক্রান্ত কিংবা যার স্বজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তার দুঃখ-বেদনা, শোক অন্য মানুষ কি তার মতো করে উপলব্ধি করতে পারবে? যতই দিন যাচ্ছে সারা বিশ্বে করোনার ভয়াবহতা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। সারা বিশ্বে ২ কোটি ৩ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে সাত লাখ ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। আমাদের দেশের চিত্রও ভয়াবহ। আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৫তম আর মৃতু্যর দিক থেকে ২৯তম। এটা সত্য, দেশে মৃতু্য হার কম। তবে আক্রান্তের হার উদ্বেগজনক। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯৮ জন, মৃতু্যবরণ করেছে ৩ হাজার ৫১৩ জন। তবে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। এ পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি রোগী সুস্থ হয়েছেন। এক জরিপে দেখা গেছে রাজধানীতে শতকরা ৯ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। ঢাকার বাইরেও করোনা ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে সারাদেশের মানুষ এক মহাতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। কখন কে আক্রান্ত হয় কে কখন মারা যায় সে ভয়ে রয়েছে। গড় হিসেবে এখন ঢাকার বাইরে মৃতু্যহার বেশি। দেশের স্বাস্থ্য খাতে বেহাল দশা বিরাজ করছে। সারাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসা খাতে রীতিমতো নৈরাজ্য বিরাজ করছে। একদিকে মানুষ ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না, অন্যদিকে ভুল চিকিৎসা ও ভুয়া চিকিৎসকের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। করোনাকালে এই সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোর চিত্র সরেজমিন না দেখলে বোঝা যাবে না কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে আক্রান্ত রোগী ও তার স্বজনদের দুর্দশা। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি, রোগীর স্বজনরা আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে ছুটছে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। স্বজনরা রোগীদের রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে। ডাক্তার-নার্সরা হিমশিম খাচ্ছে। তারাও রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে অনেক ডাক্তার মারা গেছে। মারা গেছে পুলিশ এবং সাংবাদিকও। এরা সবাই করোনাকালের সম্মুখযোদ্ধা। এই করোনাকালে কিছু অমানবিক চিত্রও ফুটে উঠেছে। প্রতারণা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক। রিজেন্ট, জিকেজি ও সাহাবুদ্দি মেডিকেল হাসপাতালই তার প্রমাণ। করোনাকালে এ খাতের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আরও প্রকাশ্যে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৫৪টি। আর ৫ হাজার ৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল। অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে অনেক। দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেয়। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান সেবাপরায়ণ নয়। অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্রই চোখে পড়ে বেশি। রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান পরিচালনার আগে সমন্বয় করে নেওয়ার জন্য জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সম্প্রতি বিভিন্ন হাসপাতালে অভিযানের কারণে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃষ্ট চাপা অসন্তোষের কথাও চিঠিতে উলেস্নখ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এই সিদ্ধান্তের কারণে হাসপাতালগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান 'সমন্বয়ের ফাঁদে' পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টজনরা। অতীতে পরিচালিত প্রতিটি অভিযানই ছিল যৌথ অভিযান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়েই অভিযান পরিচালিত হয়ে আসছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ যে সমন্বয়ের কথা বলছে, তা নতুন কিছু নয়। আগেও সেই সমন্বয় ছিল। বিষয়টিকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, মানুষ চায় স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি লাগবে-স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম। তাদের আশঙ্কা- এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দেশে স্বাস্থ্য সেক্টরে নৈরাজ্য থামবে না। রোগীদের বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির মাত্রা ভয়াবহ হবে। \হআরো একটি বিষয় হচ্ছে দেশের মানুষ করোনাভাইরাসের ব্যাপারে সচেতন নয়। তারা সরকারের দেয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা এবং এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এর আগে করোনা সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত ২১ জুলাই রাস্তার হকার থেকে শুরু করে গণপরিবহন ও অফিস-আদালতে সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে পরিপত্র জারি করে। সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। রাস্তাঘাটে বাজারে গণপরিবহণে মানুষ মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করছে। দেশে যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে এটা তারা মনেই করছে না। ফলে বিপদ বাড়ছে। সারা বিশ্বে মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের চেয়েও সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মাস্ক ব্যবহার করা। কারণ করোনাভাইরাস মূলত বাতাসে ড্রপলেটস বা মুখ থেকে নিঃসৃত মিহি জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। আর মাস্ক ব্যবহার করলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় বলে নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে। ১১ জুন প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে এই গবেষণাবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছে, গবেষকরা ইতালি ও নিউইয়র্কে করোনা রোধে মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করার আগে ও পরের করোনা সংক্রমণের হারের তুলনা করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, দুই জায়গায়ই মানুষ বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারের পর থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। এর মধ্যে দেখা গেছে অনেক মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতাটা কমে গেছে। সেটা আরও বাড়াতে হবে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে করোনার বিস্তার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার করা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এর পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টিন ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে কোভিড-১৯ এর প্রতিরোধে কাজ করে যেতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রোগের ধরন পরিবর্তন এবং জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তন হওয়ায় নগর স্বাস্থ্যসেবার জন্য আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিসহ শক্তিশালী স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে পড়েছে। কারণ এখন যারা আক্রান্ত তারা উপসর্গহীন। স্বাস্থ্য খাতের অর্জনগুলোকে টেকসই করতে আরও উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এখন সবার আগে জরুরি করোনা মোকাবিলা করা। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়লে চরম বিপর্যয় দেখা দেবে। এই সহজ কথাটি স্মরণে এনে দ্রম্নত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এও মনে রাখতে হবে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নানা অজুহাতে এই দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে বা অবহেলা করলে চলবে না। এর মধ্যে একটি হতাশাজনক খবর হচ্ছে, করোনাভাইরাসের তথ্য দেশবাসী ও গণমাধ্যমকে জানাতে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসা দৈনন্দিন হেলথ বুলেটিনের ইতি টেনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত চার মাসেরও বেশি সময় যাবত দুপুর আড়াইটায় করোনাভাইরাস সম্পর্কিত নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিন পরিবেশন করে আসছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। দেশের সচেতন মহল মনে করছেন, এটা বন্ধ করলে দেশের মানুষ দ্রম্নত তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। মানুষের সচেতনতা কমে যাবে, ফলে সংক্রমণ বাড়বে। এই সুযোগে নানা গুজবও ছড়িয়ে পড়তে পারে। \হআমরা দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ্য করে আসছি, দেশের স্বাস্থ্য খাতে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপর সব কিছুই চলে আগের মতো। এখানে সরকারের আন্তরিকতা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে কি না তা তলিয়ে দেখতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে পুরনো ধাঁচের ব্যবস্থাপনা। সে কারণে কোনো সংকট দেখা দিলে তাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু স্থায়ী কোনো পরিকল্পনা হয় না। এটা সত্য করোনা চিকিৎসায় সমন্বয়হীনতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্য বিভাগে এখন যে সংস্কার দরকার তা হলো আমূল পরিবর্তন। যদি স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তন করা যায় তা হলে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি কমে আসবে। এর পাশাপাশি দেশের জনগণকে স্বাস্থ্যসচেতন হতে হবে। মেনে চলতে হবে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিপদ আরো বাড়বে। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক