দুর্ঘটনা ও স্বাভাবিক মৃতু্যর নিশ্চয়তা

রাজধানীর রূপনগরে ৭ শিশুর মর্মান্তিক মৃতু্য আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগে বা গ্যাসের চুলার ব্যবহারে অসাবধানতা ও অসচেতনতা, গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা না করা এবং সরবরাহকৃত গ্যাসলাইনের ত্রম্নটির কারণে যে ভয়াবহ বিপদ ও মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার দৃষ্টান্ত সর্বসাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি। ৭০ ভাগ গ্যাস পাইপলাইন ঝুঁকিপূর্ণ। ৫০ বছরের পুরানো পাইপলাইনও রয়েছে রাজধানী ঢাকায়।

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
মৃতু্য যেন কোনোভাবেই এ দেশের মানুষের পিছু ছাড়ছে না। নানাভাবে মানুষের অকাল মৃতু্য হচ্ছে। এই অকাল মৃতু্য রোধ করা যাচ্ছে না। মানুষ পথে, রাজপথে, বন্যায়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে, ঘূর্ণিঝড়ে, নৌ-রেলপথে, সড়ক দুর্ঘটনায়, গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যাচ্ছে অবলীলায়। এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না আমাদের কোমলমতি শিশুরাও। বাংলাদেশে এখন আর স্বাভাবিক মৃতু্যর নিশ্চয়তা নেই। এ ব্যাপারে যাদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তারা রয়েছে চরম উদাসীন। এক মৃতু্যর রেশ না কাটতেই আরেক মৃতু্য এসে হাজির হয়। আমরা শোকগ্রস্ত ও হতাশ হই। এটাই বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা। বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি। সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনায় বেশ কিছু মানুষের অকাল মৃতু্য হয়েছে। শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের ফতুলস্নার পশ্চিমতলস্না এলাকায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ জনে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পশ্চিমতলস্না বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজের পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে মসজিদের ভেতরে থাকা অর্ধশতাধিক মুসলিস্ন দগ্ধ হন। এ সময় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দগ্ধ মুসলিস্নরা মসজিদ থেকে বাইরে ছুটে এসে সড়কে জমে থাকা পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে মসজিদের ছয়টি এসি পুড়ে গেছে। ভেঙে গেছে দরজা-জানালার কাচ। সে সময় মসজিদে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ সবাই কমবেশি দগ্ধ হন। এক সঙ্গে এত মৃতু্য মেনে নিতে পারছে না এলাকাবাসী। পুরো এলাকা এখন শোকে মুহ্যমান। এই মর্মান্তিক বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একটি এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আমাদের দেশের সমস্যা হলো- কোনো ঘটনা ঘটলে একাধিক তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। ফলে তদন্ত কমিটির প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। পাঁচ থেকে সাত বছর আগেও এসি বিস্ফোরণ হয়ে এত দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটত না। মূলত ২০১৫-১৬ থেকেই এসিতে বিস্ফোরণ হয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ১০০ থেকে ১৫০ জনের কাছাকাছি। তার ভেতরে মারা গেছেন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো। এর আগে, চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে ৭ জন নিহত এবং ১০ জন দগ্ধ হয়েছেন। নগরীর পাথরঘাটা এলাকার ব্রিক ফিল্ড রোডের ধনা বড়ুয়ার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া রান্নার চুলার গ্যাস বিস্ফোরণ, সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর রূপনগরে ৭ শিশুর মর্মা্ি‌ন্তক মৃতু্য আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগে বা গ্যাসের চুলার ব্যবহারে অসাবধানতা ও অসচেতনতা, গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা না করা এবং সরবরাহকৃত গ্যাসলাইনের ত্রম্নটির কারণে যে ভয়াবহ বিপদ ও মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার দৃষ্টান্ত সর্বসাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি। ৭০ ভাগ গ্যাস পাইপলাইন ঝুঁকিপূর্ণ। ৫০ বছরের পুরানো পাইপলাইনও রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। তিতাস গ্যাসের এদিকে নজরদারি নেই। সিএনজিচালিত পরিবহণের অনেক সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলো চেক না করার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো মনোযোগ নেই। কেবল কি গ্যাস দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মানুষ। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। এখানেই শেষ নয়- বিদেশে লোভনীয় চাকরিপ্রাপ্তি ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেকেরই জীবন চলে যায়। এর আগে দেশি-বিদেশি দালালচক্র গভীর সমুদ্রে ছোট্ট নৌকায় অনেক মানুষকে তুলে দিয়েছিল এমন ঘটনাও ঘটেছে। যেখানে নৌকাটি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কিনা, যাত্রীরা বেঁচে থাকবে কিনা, সে সব নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। এসব দালালচক্রের একমাত্র লক্ষ্য হলো- অর্থ উপার্জন। বিভিন্ন সময়েই সমুদ্রে নৌকা ডুবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের মৃতু্যর ঘটনা ঘটেছে। কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে অনেক বাংলাদেশি সাগরে ডুবে মারা গেছেন। আর শুধু সমুদ্রপথ নয়, দুর্গম মরুপথে, তুষারপথে ও বনজঙ্গল পার হতে গিয়েও অনেকে মারা গেছেন। এ ছাড়া নৌ ও ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায়ই মানুষ মারা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মানুষ মারা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় হুমকিতে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো জাপান, চীন, বাংলাদেশ ও ভারত। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা না গেলে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বেড়ে যাবে, বেড়ে যাবে মৃতু্যর হারও। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। বাংলাদেশের অবস্থান এমন এক এলাকায় যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্য-ঘটনা। গত ৫০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এ দেশে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তান্ডবে ২৬ জন মানুষ মারা গেছে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরাজীব, আশরাফুল মাখলুকাত। বর্তমান সমাজের মানুষ মানবিকতা হারিয়ে যেভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, মানুষের কারণে যেভাবে মানুষের মৃতু্য হচ্ছে, তাতে তাদের কী অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? এমন অপরাধপ্রবণ, অসহিষ্ণু ও অবক্ষয়গ্রস্ত উদাসীন ও কর্তব্যে অবহেলার সমাজ কি আমরা চেয়েছিলাম। আসলে আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আমরা নানারকম সামাজিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কি সামাজিক ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয় ও নিরাপত্তাহীনতা দেখতে পাচ্ছি, যা একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা স্বাধীন ও একটি গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনা করতে পারছি না। এ অবক্ষয় ইদানীং আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যা বর্তমান সমাজে প্রকট। সামাজিক নিরাপত্তা আজ ভূলুণ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, দেশের সামগ্রিক যে অবক্ষয়ের চিত্র নিরাপত্তাহীনতার চিত্র এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই কি আমাদের খোলা নেই? আমাদের অতীত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, বর্তমান অনিশ্চিত এবং নিরাপত্তাহীনতার দোলাচলে দুলছে এবং ভবিষ্যৎ মনে হচ্ছে যেন পুরোপুরি অন্ধকার। যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এই নিরাপত্তাহীনতা ও অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? দায়ী সমাজের একশ্রেণির মানুষ। কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না। একের পর এক অঘটন লেগেই আছে। নিরাপত্তাহীনতা আমাদের দিন দিন গ্রাস করছে। এর জন্য মানুষের খেয়ালিপনা উদাসীনতা কম দায়ী নয়। বাঙালি জাতির অতীত গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্য সাহস ও সংগ্রামের। সে ঐতিহ্য মানবিক চেতনাবোধের। নানা বৈরী পরিবেশ ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও জাতি হিসেবে বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অদম্য সাহসী এ দেশের মানুষ। তাদের প্রতিরোধ বা প্রতিহত করা অত্যন্ত কঠিন। অতীতে তারা নানা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রমাণ করেছে। প্রতিনিয়ত তারা ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও টিকে আছে। নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও বাঙালির মনোবল কখনো দুর্বল হয়নি, হয়নি হীনবল। দৃঢ়চেতা ও মনোবলসম্পন্ন বাঙালি জাতি সবসময় এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। কখনো বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, টর্নেডো, সাইক্লোন, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করেছে, কখনো বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এখন তারা মোকাবিলা করছে করোনাভাইরাসকে। বাঙালি জাতি বারবার প্রমাণ করেছে তারা অদম্য। এর প্রমাণ তাদের রাখতে হবে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে, সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, এর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক