সি আর দত্ত ও আবু ওসমান চৌধুরীর মৃতু্য মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান জাতি মনে রাখবে

পরপারে চলে গেলেও ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) ও ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বেঁচে থাকবেন দেশবাসীর অন্তরে। দেশের লাল সবুজ পতাকায় অনুভব হবে তাদের অস্তিত্ব।

প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
মহান মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্তের মৃতু্য শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই আরও একজন জাতীয় বীর চলে গেলেন জীবনের পরপারে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনা অভু্যত্থানের সময় একদল সেনা সদস্য আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যা করার জন্য তার গুলশানের বাড়িতে চড়াও হয়। তিনি বাড়িতে না থাকায় রক্ষা পেলেও প্রাণ হারান তার স্ত্রী নাজিয়া খানম। ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে জন্ম হয় আবু ওসমান চৌধুরীর। কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর হন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়, সেই খবর আবু ওসমান চৌধুরী পান কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে বসে। পরদিন সকালে তিনি কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং একদল সৈনিকসহ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরে তাকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে এক পস্নাটুন সৈন্য নিয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনেও ভূমিকা রেখেছেন আবু ওসমান চৌধুরী। চাঁদপুরের জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের বীর আবু ওসমান চৌধুরীর মৃতু্যতে শোকের ছায়া বিস্তৃত হয়েছে সারা দেশে। এদিকে, ২৫ আগস্ট মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিযুদ্ধকালে ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) বীর-উত্তম। পেশা জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ রাইফেলস) প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সি আর দত্ত। চিত্ত রঞ্জন দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত। শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন। পরে খুলনার দৌলতপুর কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাস করেন। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর 'সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট' পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার তাকে পুরস্কৃত করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে চার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি?চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা-বাগান। চা-বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে দিতেন। পরে আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। এই বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার। পরে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক। এ ছাড়া ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করেন সি আর দত্ত। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পরপারে চলে গেলেও ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) ও ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বেঁচে থাকবেন দেশবাসীর অন্তরে। দেশের লাল সবুজ পতাকায় অনুভব হবে তাদের অস্তিত্ব। আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ