জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা নতুন বাজার অনুসন্ধানে নজর দিন

জনশক্তি রপ্তানিতে এজেন্ট বা দালালরা শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। তাদের কারণেই মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হচ্ছে। ২৬ আগস্ট ২০১৯ অভিবাসনবিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'দালালদের' দ্বারা জনগণ যেন 'প্রতারিত' না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। আরও শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থায় জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি।

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আবির্ভূত করোনাভাইরাস দেশের জনশক্তি রপ্তানির চাকা থামিয়ে দিয়েছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে গত পাঁচ মাসে ৮৫ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। প্রবাসে কাজ নেই এমন অসহায় অবস্থায় রয়েছেন ১ লাখের বেশি শ্রমিক। এর বাইরে এ বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটিতে আসা ৬ লাখ ২৪ হাজার শ্রমিক করোনার কারণে দেশে আটকা পড়েছেন। দেশের অর্থনীতিতে প্রাণভোমরার ভূমিকা পালনকারী জনশক্তি রপ্তানি খাত সত্যিকার অর্থে দুঃসময় পার করছে। করোনা পরিস্থিতির অবসান না হলে শ্রমবাজারে আরও বড় ধরনের ধস নামার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য সংকট থেকে বের হতে বিকল্প শ্রমবাজার খুঁজতে শুরু করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপে অন্তত দুটি বাজার খোঁজার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই ফলপ্রসূ বলে মনে হচ্ছে না বিশ্লেষকদের কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে আটকে পড়া শ্রমিকদের একটি অংশ কর্মস্থলে যাওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু সে সংখ্যাও বেশি নয়। উলেস্নখ্য, বিশ্বের ১৬০টি দেশে শ্রমিক প্রেরণ করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এর পরের অবস্থানে ওমান, কাতার, জর্ডান ও কুয়েত। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরও বাংলাদেশের জন্য ভালো বাজার হয়ে উঠেছে। তবে করোনার থাবায় জনশক্তি রপ্তানিতে রীতিমতো হোঁচট লেগেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখের বেশি কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ ৪ লাখের মতো, ওমানে ৭২ হাজার ও কাতারে গেছেন ৫০ হাজারের কিছু বেশি। চলতি বছরে ১০ লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য থাকলেও প্রথম তিন মাসে পাঠানো সম্ভব হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৮১ হাজার। এর পর থেকেই করোনা মহামারিতে বন্ধ শ্রমিক প্রেরণ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যেহেতু দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করছে, সেহেতু বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টিতে সরকারকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। আফ্রিকার দেশগুলোয় চাষাবাদের ক্ষেত্রে দেশের বিপুল মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। সে সুযোগ কাজে লাগাতেও উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান সোপান রেমিট্যান্স। দেশের বাইরে যারা গতর খেটে লাল সবুজের এই দেশের সমৃদ্ধির বৃদ্ধিতে জোগান দেন তাদের পথরোধ হওয়া খুবই নিন্দনীয়। সৌদি আরবের শ্রমবাজারেও চলছে ধীরগতি। বাহরাইন, কুয়েত ও কাতারের বাজার প্রায় থমকে আছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে এক সময় আস্থার প্রতীক ছিল উপসাগরীয় ছয়টি দেশ। কিন্তু করোনাভাইরাস, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভিসা জটিলতা, কূটনৈতিক ব্যর্থতাসহ নানা প্রতিকূলতায় ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে এ শ্রমবাজার। ফলে প্রতি বছর কমছে জনশক্তি রপ্তানি। দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে জনশক্তি প্রেরণের গতি এখন প্রায় থমকে গেছে। বাংলাদেশের অন্য শ্রমবাজার আরব আমিরাত দীর্ঘদিন বন্ধ। দেশের শ্রমবাজারে হতাশার যে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে সরকার তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরার ভূমিকা পালন করছে। এ অবস্থা জিইয়ে রাখতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মোচনের সব চেষ্টাই করা দরকার। এর পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার উন্মোচনেও উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে আফ্রিকার যেসব দেশে বিস্তীর্ণ জমি চাষাবাদের অভাবে পড়ে আছে সেগুলো লিজ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠিয়ে চাষাবাদের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাতে দুই পক্ষই লাভবান হবে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চাষাবাদের জন্য আফ্রিকায় জমি লিজ নিচ্ছে। বাংলাদেশও সে সুযোগ নিতে পারে। উদ্যোগী মনোভাবই পারে দেশের সমৃদ্ধি বাড়াতে। বাংলাদেশ দীর্ঘকাল একটি জনশক্তি রপ্তানিমুখী দেশ এবং সেই সুবাদে রেমিট্যান্সকে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে দেখে চলছে। কিন্তু এই ধারণার আমূল পরিবর্তন ও হালনাগাদ করার সময় এসেছে। গত বছরে প্রবাসীরা আয় পাঠানোয় রেকর্ড তৈরি করেছেন। ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ। আবার টানা দুই বছর জনশক্তি রপ্তানি কমছে। অনেক আগ থেকেই এই খাতে একটা মন্দাভাব লক্ষ্য করা যায়। তদুপরি বেশি আয়, নিম্নমুখী জনশক্তি রপ্তানি দুটোই বাস্তবতা। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিদেশি শ্রমবাজার তার প্রয়োজন অনুযায়ী জনশক্তি আমদানি করে। অবশ্যই কোনো বিদেশি সরকারের জনশক্তি নীতির আলোকে নয়। সরকারকে যা অনতিবিলম্বে বিবেচনায় নিতে হবে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক হলো, প্রথমত ধরে নিতে হবে, বিশ্ব শ্রমবাজারে আর অদক্ষ বা আধা দক্ষ শ্রমিকদের কদর বাড়বে না। এর চাহিদা দ্রম্নত নিচে নামছে। তাই দেশ গঠনে যেমন, তেমনি বিদেশে কর্মসংস্থান জোটাতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা ছাড়া বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে অকারণ রিক্রুটিং এজেন্সিনির্ভরতা কমাতে হবে। জনমনে একটা ভ্রান্তি আছে যে, এই সংস্থাগুলোই বিদেশে শ্রমবাজার তৈরিতে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাস্তবতা একদম তা নয়। বরং শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ভিসা ব্যক্তি নিজেই জোগাড় করে। কিন্তু আইন বলছে, রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই যেতে হবে। এই এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। এখানে সুশাসনের শর্ত পূরণ করতে হবে। তৃতীয়ত, জনশক্তি রপ্তানিতে এজেন্ট বা দালালরা শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। তাদের কারণেই মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হচ্ছে। ২৬ আগস্ট ২০১৯ অভিবাসনবিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'দালালদের' দ্বারা জনগণ যেন 'প্রতারিত' না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। আরও শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থায় জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষার তথ্য বেশ উদ্বেগজনক। সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিবছর ২৭০৬ কোটি টাকা ব্যয় করেও মানুষ বিদেশে যেতে ব্যর্থ হন। কারণ, তারা দালালদের দ্বারা প্রতারিত হন। এটা বিদেশগামীদের শতকরা ১৯ ভাগ। আর বিদেশে গিয়ে হয়রানির শিকার হন আরও ৩৪ ভাগ। পঞ্চমত, ২০১১ সালে পাস হওয়া জাতীয় দক্ষতা নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং ২০১৮ সালে সংসদে পাস হওয়া জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমকে গতিশীল করার কাজ ঢিমেতালে চলছে। জনশক্তি খাতের উলিস্নখিত মলিন চিত্র বদলাতে হলে সনাতনি পদ্ধতিতে যেভাবে এতকাল এই খাত চলে আসছে, সেটা আর চলবে না। আমরা মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে জনশক্তি রপ্তানি খাতের অন্যান্য কুশীলবেরা আমাদের পাশকাটিয়ে যাবে। তিনটি বৃহত্তম শ্রমবাজারের মধ্যে দুটির অচলাবস্থাকে মনে রেখে 'আসন্ন ঝড়' সামলানোর আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ