কোস্তারিকা, আর্নেস্তো গুয়েভারা এবং যুদ্ধের মহাকাল

কোস্তারিকা এবং নিকারাগুয়ার শূন্যরেখা পেনাস বস্নাঙ্কায় আসার মাধ্যমে ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা এবং গুয়ালো গ্রাসিয়া তাদের তিন সপ্তাহকালব্যাপী ঘটনাবহুল কোস্তারিকা সফরের ইতি টানেন। রিভাস পেরিয়ে ১৯৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত নাগাদ পৌঁছেন নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়া।

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

শাহ বুলবুল
১ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সাল। পানামার চিরিকিউ প্রদেশ এবং কোস্তারিকার পুনতারেনাস প্রদেশের মধ্যবর্তী সীমান্ত শহর পাসো কানোয়াস দিয়ে ডাক্তার আর্নেস্তো বন্ধু গুয়ালো গ্রাসিয়াকে নিয়ে কোস্তারিকার ভূখন্ডে প্রবেশ করেন। কোস্তারিকার উদ্দেশে পানামা ত্যাগ করার দিন আর্নেস্তোদের সহায়-সম্বল বলতে ছিল মাত্র পাঁচ ডলার। ইতিমধ্যে কোস্তারিকা উপকূলে আসার পথে তারা মারাত্মকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন এবং আর্নেস্তোর ডান পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পায়। ট্রাকচালক রোজালিও সদয় হয়ে আর্নেস্তোদের তার বাসায় খেতে এবং ঘুমাতে দেন। রোজালির বাসায় রাতটা পার করে পরদিন চলতে শুরু করেন এবং কোস্তারিকার উপকূল এসে এখানকার এল প্রোগ্রেসো গ্রামে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে একটি ফুটবল ম্যাচ খেলেন। যদিও আর্নেস্তোর ডান পায়ের গোড়ালিতে আঘাত ছিল তথাপি স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে খেলাটি তিনি উপভোগ করেন। পরদিন সকালে প্রোগ্রেসো গ্রাম ত্যাগ করে অনেক দূর কর্দমাক্ত পথ হেঁটে আসেন স্থানীয় রেলস্টেশনে। স্টেশন পরিদর্শকের অনুমতিক্রমে আর্নেস্তো এবং গুয়ালো গ্রাসিয়া বিনা ভাড়ায় রেলযাত্রী হয়ে আসেন বন্দরনগরী গলফিতো। রিও দামাস এবং রিও বারো নদীর মোহনায় অবস্থিত কোস্তারিকার জেলা শহর কুইপস। পুনতারেনাস প্রদেশের জেলা কুইপসকে বলা হয় ম্যানুয়েল আন্তোনিও জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার। এটি কলা উৎপাদনের জন্য একটি বিখ্যাত এলাকা যেখানে ১৯৩০ সাল নাগাদ আমেরিকার ফল ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ফ্রুট ব্যবসায়িক জোন আমেরিকান অঞ্চল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। গলফিতো উপসাগর পেরিয়ে কুইপস। আর্নেস্তো কলাবন্দর কুইপস যাওয়ার আগে গলফিতো বন্দরে চিকিৎসা নেন ইউনাইডেট ফ্রুট কোম্পানির হাসপাতালে। গলফিতো উপসাগর পাড়ি দিতে আর্নেস্তোদের বাহন ছিল রিও গ্রান্ডি জাহাজ। জাহাজের অধিনায়ককে নিজেদের বাস্তবতা বুঝিয়ে বিনা টিকিটে রিও গ্রান্ডিতে চড়ার অনুমতি মিললেও অধিনায়ক তাদের থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি তথাপি এখানকার দুজন কর্মচারী করুণা করে তাদের ঘরের মেঝেতে আর্নেস্তোদের রাতে ঘুমানোর সুযোগ করে দেন। বন্দরে অবস্থানকালে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা আলফ্রেদো ফালাসের সঙ্গে আর্নেস্তো এবং গুয়ালো গ্রাসিয়ার বন্ধুত্ব হয় যিনি থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান ছাড়াও জাহাজ ছাড়ার সময় অন্তত দুদিনের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে দেন। মহানুভব আলফ্রেদো ফালাস জাহাজ ছাড়ার আগে পুনতারেনাসে বসবাসরত তার স্বজন জুয়ান কালদেরন গোমেজের ঠিকানাসহ পত্র দেন যাতে জুয়ান কালদেরন অভিযাত্রীদ্বয়ের প্রতি সদয় আচরণ করেন। বন্দরে আরেকজন পরিচিত ছিল মেদিনা যার কক্ষে আর্নেস্তো ঘুমাতেন। আর্নেস্তোর ভাষায় মেদিনা স্বভাবত ভদ্র এবং চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তার বাবা নিকারাগুয়ার একজন নামকরা ডাক্তার এবং শিক্ষক। মেদিনারা কোস্তারিকায় থাকেন কারণ নিকারাগুয়ার সমুজা শাসন থেকে তারা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত। সাগর পেরিয়ে কলাবন্দর কুইপস। পুনতারেনাস যখন আসেন তখন সন্ধ্যা ৬টা। গলফিতো পোতাশ্রয়ের স্থানীয় বাসিন্দা আলফ্রেদো ফালাসের চিঠি নিয়ে দেখা করেন জুয়ান কালদেরন গোমেজের সঙ্গে। জাদুকর কালদেরন গোমেজ ভবঘুরে আর্নেস্তোদের সহায়তাস্বরূপ প্রদান করেন ২১ কলোন। ২১ কলোনকে সহায় করে বন্ধু গুয়ালো গ্রাসিয়াকে নিয়ে গন্তব্য কোস্তারিকার রাজধানী সানজুসে। কোস্তারিকার রাজধানী শহরটি তখন ল্যাটিন আমেরিকার নানা প্রান্ত থেকে আসা নির্বাসিতদের অভয়ারণ্য যাদের মধ্যে আছেন অনেক বিখ্যাত মুখ। সানজুসে আসার পর আর্নেস্তোর একটি মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল এখানে বসবাসরত খ্যাতনামা নির্বাসিতদের সঙ্গে কথা বলা এবং ল্যাটিন আমেরিকায় চলমান সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ। সানজুসে থাকার সময় নির্বাসিত লেখক ও ডমিনিকান রিপাবলিকের নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি জোয়ান এমিলিও বোশ গাভিনো এবং কোস্তারিকার জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা ম্যানুয়েল মোরা ভালভার্দের সঙ্গে ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনার সাক্ষাৎ ছিল বিপস্নবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। কোস্তারিকায় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর আর কিউবায় ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর। মাত্র তিন বছর আগে সানজুসে দেখা ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা তখন চে নামে বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রধান খবর। 'আমার স্মৃতি থেকে চে গুয়েভারা' জুয়ান বোশের স্মৃতিচারণমূলক লেখায় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের দিনগুলোকে স্মরণ করে বলেন- 'গুয়েভারা পানামা থেকে কোস্তারিকা এসেছিলেন এবং সব কিছু জানার টান নিয়ে আমেরিকা ভ্রমণ করছেন। কোস্তারিকা থেকে আমি গুয়াতেমালায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম এবং তিনি গুয়াতেমালা দেশটি সম্পর্কে আমার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনায় তিনি ছিলেন পেরন বিরোধী এবং জেনারেল পেরনের শাসনামলে তিনি আর্জেন্টিনায় ফেরত যেতে চাননি। ১৯৫৮ সালে যখন আর্নেস্তো গুয়েভারা নামটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত এবং আমি তখন ভেনিজুয়েলায়। এসময় রামুলো বেতানকোর্ট কমপক্ষে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- কে ছিল চে?। সেই সময় কোস্তারিকাতে বেতানকোর্টের সঙ্গে নির্বাসনে থাকা কিছু ভেনিজুয়েলান তাকে বলেছিল সেই দিনগুলোতে গুয়েভারাও কোস্তারিকাতে ছিল কিন্তু বেতানকোর্ট তাকে স্মরণ করেননি। সে সময় বেতানকোর্ট প্রায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন যেমনটা আমিও তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম এর কয়েকটিতে তার সাথে চে'র দেখা হয়েছিল এবং চে গুয়েভারা তাকে সম্বোধন করেছিলেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। আমি বেতানকোর্টকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে তিনি কে এবং সেই বিখ্যাত চে গুয়েভারা কেমন ছিলেন'। নির্বাসিত ও কোস্তারিকান বিশেষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্যে একদিন সকালবেলা ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা সানজুসে কোস্তারিকান কুষ্ঠরোগ হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন এবং কুষ্ঠরোগ নিয়ে কথা বলেন এখানকার দায়িত্ব প্রাপ্ত ডাক্তারদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা তার ডায়েরিতে লিখেছেন- 'আগামীকাল আমি কোস্তারিকান কুষ্ঠরোগ হাসপাতাল পরিদর্শনে যাব। আমি লেপ্রোসারিয়ামটি দেখিনি কিন্তু আমি দুজন চমৎকার মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। ডাক্তার আরতুরো রোমেরো, অসাধারণভাবে সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ যাকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে লেপ্রোসিয়াম বোর্ড থেকে দূরে সরানো হয়েছে এবং ডাক্তার আলফোনসো ট্রেজোস একজন গবেষক ও খুব ভালো মানুষ। আমি হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছি এবং ঠিক এই সকালে'। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে চিরহরিত অরণ্যের দেশ কোস্তারিকায় ডাক্তার আর্নেস্তোর কথা বললে অবশ্যই বলতে হবে এখানকার ঐতিহ্যবাহী সোদা প্যালেস ক্যাফের কথাও। ১৯২৯ সালে সানজুসে প্রতিষ্ঠিত ক্যাফেটি কোস্তারিকার ইতিহাসে জাতীয় সংস্কৃতির প্রতীক। সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক উত্থান-পতন আর নির্বাসিত নেতাদের আড্ডা আলোচনার নিয়মিত ঠিকানা ছিল কোস্তারিকার ঐতিহ্যবাহী সোদা প্যালেস ক্যাফে। ১৯৯৯ সালে লোকসানের কারণে ইতিহাসের ঘুমন্তপাঠ সোদা হাউস বন্ধের উপক্রম হলে তা কিনে নেয় কেএফসি কোস্তারিকান শাখা তবে সোদা প্যালেসের ঐতিহাসিক পুরনো ভবনটি ব্যবহার হচ্ছে একটি সিনেমা হল হিসেবে। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে সোদা প্যালেস ক্যাফের আড্ডায় ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারার সঙ্গে দেখা হয় ফিদেল বাহিনীর বিপস্নবী দুই যোদ্ধার। কমান্ডার কালিক্সতো গার্সিয়া মার্তিনেজ এবং কমরেড সেভেরিনো রোজেল গঞ্জালেজ। কিউবার মোনকদা ব্যারাক আক্রমণের দিন বেঁচে যাওয়া এ দুই বিপস্নবী যোদ্ধা ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারাকে কিউবায় সামরিক শাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিপস্নবী ফিদেল কাস্ত্রোর আন্দোলন, মোনকদা আক্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে বলেন এবং আর্নেস্তো অবাক হয়ে নির্বাসিত কিউবান কমরেডদের কথা শোনেন। সেদিন আর্নেস্তো গুয়েভারা নির্বাসিত যোদ্ধাদের জানান, তিনি গুয়াতেমালার দিকে যাচ্ছেন। মূলত সোদা প্যালেস ক্যাফের দেখাই ছিল কিউবার কোনো বিপস্নবীর সঙ্গে ভবঘুরে ডাক্তারের প্রথম দেখা অথবা কে-ই বা জানত মাত্র কয়েক বছর পরেই এ ভবঘুরে ডাক্তারের কমান্ডিংয়ে কিউবায় সংঘঠিত হবে অবিস্মরণীয় গেরিলা বিপস্নব। বিদায় সানজুসে। গন্তব্য নিকারাগুয়ার মানাগুয়া। সানজুস থেকে বাস ধরে এলেন কোস্তারিকার দ্বিতীয় রাজধানী আলাজুয়েলা। কিছু অভিযাত্রিক ঘটনার পর সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছলেন গুয়ানাকাস্তে প্রদেশের সাদা শহর লাইব্রেরিয়া। নিকোয়া উপদ্বীপের কোল ঘেঁষে নৈসর্গিক সাদা শহরটি দেখে আর্নেস্তো স্মৃতিকাতর হয়ে বলেছেন- এ যেন তাদের ছোট্ট প্রদেশ সান্তাগো দেল এস্তেরো। কিছুটা জিপে চড়ে আর ঝাঁঝালো রোদে মাইলের পর মাইল হেঁটে আর্নেস্তো গুয়েভারা এবং গুয়ালো গ্রাসিয়া দুপুরনাগাদ আসেন গুয়ানকাস্তে প্রদেশের জেলা শহর লা ক্রুজ। এটি কোস্তারিকা এবং নিকারাগুয়ার সীমান্তবর্তী একটি জনবিরল শহর। কোস্তারিকা এবং নিকারাগুয়ার শূন্যরেখা পেনাস বস্নাঙ্কা পেরুনোর আগে গুয়েভারা তার ডায়েরিতে লেখেন- 'দুপুর ২টা। হেঁটে চললাম আরও ২২ কিলোমিটার, এখন সময় ৫টা বা ৬টা হবে। রাত নেমে গেছে এবং হাঁটার জন্য আমার এক পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা চাল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা গুদামে ঘুমিয়ে পড়লাম এবং সারারাত কম্বলের উপর লড়াই করেছি। পরের দিন, বিকাল ৩টা অবধি হেঁটেছি। একটা নদীর চারপাশ ঘুরে আরও বেশি পথ তৈরির পর অবশেষে আমরা পৌঁছলাম পেনাস বস্নাঙ্কা। আমরা এখানেই অবস্থান করলাম কারণ প্রতিবেশী শহর রিভাসে যাওয়ার কোনো গাড়ি ছিল না।' কোস্তারিকা এবং নিকারাগুয়ার শূন্যরেখা পেনাস বস্নাঙ্কায় আসার মাধ্যমে ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা এবং গুয়ালো গ্রাসিয়া তাদের তিন সপ্তাহকালব্যাপী ঘটনাবহুল কোস্তারিকা সফরের ইতি টানেন। রিভাস পেরিয়ে ১৯৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত নাগাদ পৌঁছেন নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়া। নিকারাগুয়া হয়ে রক্তভূমি গুয়াতেমালার মাটি স্পর্শ করার আগে তিন সপ্তাহের কোস্তারিকা সফরটি সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে একটা রাজনৈতিক রূপান্তর। ল্যাটিন আমেরিকার সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে জুয়ান বোশের বক্তব্য, কোস্তারিকার বিপস্নবী শ্রমিক নেতা মোরা ভালভার্দের বিশ্লেষণ এবং কিউবার নির্বাসিত কমরেডদের অবাক করা লড়াকু জীবন। মূলত কোস্তারিকা থেকেই ভবঘুরে ডাক্তার গুয়েভারা জেনে গেছেন- আসছে যুদ্ধের মহাকাল। শাহ বুলবুল : কলাম লেখক