শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ

আজ 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ-এর ৪৫ বছর। ১৫ আগস্টের মতো মর্মন্তুদ ঘটনা আমরা আর প্রত্যক্ষ করতে চাই না। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই কালো অধ্যায়টি অমোচনীয় হয়ে থাকবে, যার মাধ্যমে খুনিদের উৎসাহিত করা হয়েছিল।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত বর্বরোচিত অধ্যায়। আমরা হারিয়েছি বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মহাকাব্যিক বীর নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হারিয়েছি তার দুই কন্যা ব্যতিরেকে পুরো পরিবারকে- যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিচক্র কেবল ব্যক্তি মুজিবকেই হত্যা করেনি। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির ওপর আঘাত হানে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কার দেওয়া হয়, তাদের করা হয় পুনর্বাসন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পর ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একটি বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় পাকিস্তানের একটি বিশেষ বিমানে করে লিবিয়ায়। খুনিচক্রকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে একটি প্রভাবশালী দেশ প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে। এই হত্যাকান্ড বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে ভয়ানকভাবে পিছিয়ে নিয়ে যায়। পঁচাত্তরের ক্ষমতাসীন সামরিক-বেসামরিক এলিটচক্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত অবস্থান ও লক্ষ্য থেকে সরিয়ে এনে একটি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা বেদখল করে এবং সংবিধানের কর্তৃত্ব ধ্বংস করে। দেশব্যাপী হত্যা, সন্ত্রাস, জোর-জবরদস্তি চলে অবলীলায়। পরে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল তাহেরের হত্যাকান্ড, বিচার প্রহসনের নামে সশস্ত্র বাহিনীর শত শত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও জোয়ানকে হত্যা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ইত্যাদি এর নজির হয়ে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদকে অর্থাৎ ৭১-এর সশস্ত্র আলবদর, আল শামস, রাজাকারদের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতিতে যেমন দক্ষিণপন্থি ধারায় বিএনপি তথা জাতীয় পার্টি গড়ে ওঠে, তেমনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সমাজ গঠনের মধ্য যে পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছিল পূর্বোক্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো ছিল তারই অসুস্থ প্রতিফলন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও প্রকাশ্যে পার্টির নামে সংগঠন গড়ে তোলে। রাজনীতির অঙ্গনে তারা সক্রিয় হতে চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রধানত সামরিক শাসনের ছায়াতলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্স্নোগানের আড়ালে চরম দক্ষিণপন্থিসহ প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবাররা হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর সুব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।

যেহেতু বাংলাদেশ সংসদ অধিবেশনে ছিল না, সে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক একটি অধ্যাদেশের আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে এ আইনটি প্রণীত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তিনিই দেশটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। এটি শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারের পথ প্রশস্ত করে। ২০১০ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট।

দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার কাজ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলার মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃতু্যদন্ড প্রদান করা হয়। আসামি পক্ষের ১৫ জন উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পান। ওই আপিলে ১২ জনের মৃতু্যদন্ড বহাল এবং ৩ জনকে খালাস প্রদান করা হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিলের মাধ্যমে এ বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে ১২ জনের মৃতু্যদন্ড বহাল রাখে আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে এদের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হয়। আবদুল মাজেদ ছাড়া বাকিরা এখনো বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। দন্ডিত অন্য আসামি আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের তালিকায় রয়েছে ১. লে. কর্নেল শরিফুল হক (ডালিম) ২. লে. কর্নেল আজিজ পাশা ৩. মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ ৪. মেজর বজলুল হুদা ৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদ ৬. মেজর রাশেদ চৌধুরী ৭. মেজর নূর চৌধুরী ৮. মেজর শরিফুল হোসেন ৯. কর্নেল কিসমত হাশেম ১০. লে. খায়রুজ্জামান ১১. লে. নাজমুল হোসেন ও ১২. ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ। পলাতকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আছে খুনি রাশেদ চৌধুরী, তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। নূর চৌধুরী আছে কানাডায়। এ ব্যাপারে কানাডার একটি আইন আছে, সেটা হলো কাউকে মৃতু্যদন্ড দেওয়ার বিধান সে দেশের আইনে নেই। এ কারণে আইনটিকে শিথিল করে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কানাডায় একটি মামলাও বাংলাদেশ সরকার করেছে এবং সেখানে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত আছে।

আবদুল মাজেদ ২৫ বছর ধরে ভারতে পালিয়ে ছিলেন। সেখানে তিনি বিয়ে করে সংসারও করেছেন। করোনাভাইরাস আতঙ্কে সেখান থেকে গত ২৬ মার্চ ময়মনসিংহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। দেশে ফেরার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ৬ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের জন্য দায়ী কে, মোশতাক না জিয়া? যেহেতু মোশতাক সরকার ছিলেন সেনা সমর্থিত, জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাপ্রধান সেহেতু এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। খুনিদের জন্য পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা সবসময়ই অবারিত ছিল। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। শুধু তাই নয়- এসব খুনি এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাজনীতিতে অংশ নেন এবং রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

শাহরিয়ার রশিদ ও বজলুল হুদা ১৯৮০ সালের পর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি নামের একটি দল গঠন করেন। ১৯৮৭ সালে ফারুক রহমান ও আব্দুর রশিদ গঠন করেন ফ্রিডম পার্টি। পরে বজলুল হুদাও ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেন লে. কর্নেল ফারুক। বজলুল হুদা ফ্রিডম পার্টি থেকে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে মেহেরপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি খালেদা জিয়ার ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনে কুমিলস্না থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন লে. কর্নেল রশিদ। এভাবেই এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে খুনিরা সংসদে বসেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। খুনিদের বিচারের মাধ্যমে সে কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। মূলত ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট হত্যাকান্ড একসূত্রে গাঁথা। এর উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা এবং পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করা।

আজ 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ-এর ৪৫ বছর। ১৫ আগস্টের মতো মর্মন্তুদ ঘটনা আমরা আর প্রত্যক্ষ করতে চাই না। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই কালো অধ্যায়টি অমোচনীয় হয়ে থাকবে, যার মাধ্যমে খুনিদের উৎসাহিত করা হয়েছিল।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113212 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1