পাঠক মত

পেঁয়াজ সমাচার এবং আমাদের কৃষক

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের প্রধান ফসলগুলোর মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। আমাদের দেশে পেঁয়াজের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হিসেবে প্রথমেই আসে বাঙালির ভোজনপ্রিয়তা- যা আমাদের কারোর-ই অজানা নয়। আর এই ভোজনরসিক বাঙালির নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় পেঁয়াজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও পেঁয়াজে আমিষ, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান রয়েছে এবং সেই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধী ঔষধিগুণের কারণে বিশ্বজুড়ে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছরের একটা বিশেষ সময়ে পেঁয়াজ নামক মশলাটির তীব্র সংকট দেখা যায়। যার দরুণ আমাদের দারস্থ হতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কাছে। এক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানরা বিশেষভাবে ভারতের ওপর নির্ভর করে থাকেন। তাই প্রতি বছর একটা হ্যান্ডসাম পরিমাণ পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাদের এই পরম বন্ধু রাষ্ট্রটি বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলাফল স্বরূপ দেশে পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। যার কারণে জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। এই কিছুদিন আগেও আমরা এর সত্যতা দেখেছি। হঠাৎ করে ৭০/৮০ টাকার পেঁয়াজ ২৫০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে কিনতে হয়েছে। এমনকি গত বছর এই সেপ্টেম্বর মাসেও ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল তখন পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, তীব্র সংকটের পেছনের কারণ কি? এই সংকট আসলেই যুক্তিযুক্ত নাকি বেশিরভাগই কৃত্রিম? বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় পেঁয়াজ দিয়ে এ দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ সম্ভব হলেও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ অধিকাংশ পেপারলেস ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে আমদানিকৃত পেঁয়াজ দিয়ে সহজেই ক্রেতাকে বোকা বানানো যায়। যেহেতু আইনি কাগজপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা থাকে না তাই সহজেই ক্রেতাদের বোকা বানিয়ে দফায় দফায় দাম বাড়ানো যায়। আর এই কারসাজির পেছনে আছেন বৈধ আমদানির ছাড়পত্র, এলসি খোলার ছাড়পত্রবিহীন আমদানিকারকের কমিশন এজেন্ট, আড়তদার পরিচয়ের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তাইতো দেশীয় পেঁয়াজের জোগান থাকলেও সেটা পাওয়া দুষ্কর। কারণ কমিশন এজেন্ট, আড়তদাররা দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রিতে আগ্রহী না; কেননা, দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি করতে গেলে ভ্রম্যমাণ আদালত বা ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি বিক্রেতার ক্রয় রশিদ দেখতে চাইবে। আর তখনি তাদের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যবসায়ীরা বরাবরই দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রিতে অনিহা দেখান। সুতরাং এটা সহজেই বোধগম্য যে প্রতি বছর পেঁয়াজের যে সংকট তার সিংহভাগই কৃত্রিম। বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টনের মতো। সেখানে ২০২০ সালে দেশে উৎপাদনের পরিমাণ ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে মূল উৎপাদন থেকে গড়ে ২২-২৫ শতাংশ নষ্ট হওয়ার দরুন অবশিষ্টাংশ ছিল ১৯ লাখ ১৭ হাজার টন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেই আসে, যেহেতু বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ সেহেতু পেঁয়াজের উপাদনই বা এত কম কেন? এই যে মোট উৎপাদনের ২২-২৫ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে তার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে কিছু বিষয় সামনে আসে যেমন; নায্যমূল্যের অভাব, সংরক্ষণ ব্যবস্থার সংকট, ভালো বীজের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। যখন দেশে কৃষকের পেঁয়াজ ঘরে উঠে, ঠিক তখনি আমদানিকৃত পেঁয়াজে দেশে বাজার ছয়লাব হয়ে যায়। যার ফলে কৃষক নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং তারা বেশ বড়োসড়ো লোকসানের সম্মুখীন হয়। উলেস্নখ্য, গত বছর এপ্রিলেও পেঁয়াজের মণ ছিল ৪০০ টাকা অথচ কৃষকের উৎপাদন খরচ ছিল ৬০০ টাকা। এমনকি এ বছরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা গেছে। যার ফলে অনেক কৃষক ইচ্ছেপূর্বক অনেক পেঁয়াজ নষ্ট করে ফেলেছে। সুতরাং দেশীয় পেঁয়াজ মৌসুমে আমদানি বন্ধ রাখলে কৃষক লাভবান হবেন এবং তারা অধিক উৎপাদনে আগ্রহী হবেন। এছাড়াও আমাদের দেশে সর্বত্র পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থার বেহালদশা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে প্রতি বছর উৎপাদিত পেঁয়াজের একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখন সময় এসেছে দেশীয় পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ পদ্ধতির ব্যবস্থা করার। কারণ পেঁয়াজের জন্য ১২-২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা দরকার এবং আদ্রতা থাকা প্রয়োজন ৩৫-৪০ এর মধ্যে। সুতরাং এ পদ্ধতি ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমবে এবং কৃষকদের মানসম্মত বীজের জোগান দিতে পারলে উৎপাদনের হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছি। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের কৃষকরা যদি সব ধরনের সহায়তা পায় তাহলে সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দেশে চাহিদা মতো পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব। সুতরাং এমতাবস্থায় সরকারের উচিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা, অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা এবং সর্বোপরি কৃষকদের স্বার্থের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি দেওয়া। কারণ একজন কৃষক যখনই তার পরিশ্রম তথা উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্যায়ন পাবে তখনি আরো বেশি উৎপাদনে আগ্রহী হবে। আর একমাত্র তখনই এই সংকট দূর করা সম্ভব হবে এবং আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশকে সমৃদ্ধশালী করা সম্ভব হবে। তাই আমাদের সব সময় একটা কথা মনে রাখতে হবে, 'কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ আর আমরা পাব একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ।' আফরোজা রোজা ঢাকা