আইন মানতে এত অনীহা কেন?

প্রকাশ | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:২৫

খালিদ জামান সেজান শিক্ষাথীর্, আইন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোরদের স্বতঃস্ফ‚তর্ আন্দোলন শেষ হওয়ার পর এখনও একমাস পার হয়নি। এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে বহু মমাির্ন্তক সড়ক দুঘর্টনা। সেসব দুঘর্টনায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যাও কম নয়। দেশের বেশ কয়েকটি শীষর্ পত্রিকায় নিহতদের সংখ্যা ফলাও করে শিরোনাম করা হয়েছে। যথারীতি দেশবাসীর পুরোটুকু ক্ষোভ গাড়িচালকদের ওপর। তাদের বেপরোয়া ড্রাইভিংকেই সড়ক দুঘর্টনার অন্যতম কারণ বলে মনে করে সবাই। কিন্তু, সড়ক দুঘর্টনা প্রতিরোধে জনগণের ভূমিকা কতখানি? আমরা সাধারণ জনগণ কি ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল? এই গুরুত্বপূণর্ প্রশ্নটি কিন্তু আড়ালেই রয়ে যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সংস্থার দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশে বছরজুড়ে যত সড়ক দুঘর্টনা ঘটে তাতে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭০ শতাংশ হতাহত হয় সাধারণ পথচারীরা। ফুটপাত ক্রমাগত দখল হওয়ার ফলে পথচারীদের পায়ে হেঁটে চলার পথ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ফলে তাদেরকে বাধ্য হয়ে পায়ে হঁাটার কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে মূল সড়কের অংশ। আর এতেই ঘটছে দুঘর্টনা, ঝড়ে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। ভারী যানবাহন চালকদের দোষারোপ করার আগে সাধারণ পথচারীরা কতটুকু আইন মানছে সেদিকেও দৃষ্টিপাত করতে হবে। আজ (০৫/০৯/২০১৮) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা অবধি রাজধানীর মিরপুর-১০ গোলচত্বরের দৃশ্য ছিল যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক। পাশেই ফুট ওভারব্রিজ। অথচ রাস্তা পারাপারে পথচারীদের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে যেন সীমাহীন অনীহা। ট্রাফিক সাজের্ন্ট হ্যান্ডমাইকে বারবার চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছিলেন। ফুট ওভারব্রিজ না ব্যবহার করলে জরিমানার ভয়ও দেখানো হচ্ছিল। কিন্তু, সেদিকে কেউই ভ্রƒক্ষেপ করল না। যে যার মতো ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হচ্ছিল। কখনও চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে হাত উঁচু করে, কখনওবা দ্রæতগতিতে দৌড়ে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথায় গিয়ে-এভাবেই সম্ভাব্য দুঘর্টনা থেকে নিজেদের রক্ষা করছিল কিছু বেপরোয়া পথচারী। এসব পথচারীকে আইন মানাতে ব্যথর্ হয়ে নিজের অসহায়ত্বকেই যেন শিকার করে নিলেন দায়িত্বরত ট্রাফিক সাজের্ন্ট। কিন্তু, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের মতো সামান্য একটি আইন মানতেও এত অনীহা কেন? মূলত, সময় বঁাচাতে অধিকাংশ পথচারীই চান না ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে। তাদের কাছে সড়কের নিরাপত্তা যেমন জরুরি, তেমনি সময় বঁাচানোটাও একরকম অলিখিত দাবি। আর তাই সেই দাবি পূরণে প্রয়োজনে আইন লঙ্ঘন করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না অনেকেই। ফুট ওভারব্রিজ না ব্যবহার করার তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারীদের হার বেশি। ওভারব্রিজগুলো অবৈধ দখলে থাকা, ছিনতাইকারী ও হিজড়াদের দৌরাত্ম্য এবং যথাযথ পরিবেশ না থাকায় নারীদের জন্য সেগুলো ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। হরহামেশা ইভ টিজিং-এর শিকার হতে হচ্ছে তাদের। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ফুট ওভারব্রিজ না ব্যবহার করার প্রকৃত কারণ হলো পথচারীদের অলসতা। আর এই অলসতার দরুণ রোজই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুঘর্টনা। কোমলমতি শিক্ষাথীর্রা যখন নিরাপদ সড়ক চেয়ে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসেছিল, তখন তাদের এই দাবির সাথে পুরো দেশবাসী নৈতিক সমথর্ন দিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শিক্ষাথীের্দর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু, এই যে আইন না মানার যে প্রবণতা, তা আমাদেরকে নতুন বাংলাদেশ গড়তে দিচ্ছে না। চালক, হেলপার থেকে যাত্রী, পথচারী কেউই আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই। তাই প্রত্যেকেই নিজের স্বাথের্র জন্য নিজের মতো করে আইন অমান্য করি। আর সেজন্য কখনও বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে, কখনও অন্য বাসের সাথে প্রতিযোগিতা করে, আবার কখনও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে অনায়াসেই কায়েম করে চলেছি বেআইনি ট্রাফিক রাজত্ব। আমাদের অসচেতনতা ও অলসতার কারণে ঝড়ে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। খালি হচ্ছে কত মায়ের বুক। দিন শেষে ক্ষতি হচ্ছে নিজেদেরই। তবুও সাবধান না হয়ে রোজ ঝুঁকি নেওয়াকেই একমাত্র হাতিয়ার বানাচ্ছি আমরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো ফলাফল ছাড়াই থেমে যাওয়ার পর আন্দোলনের শীষর্ এক নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীের্দর উদ্দেশ্যে আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘আপনারা যদি পাশেই না থাকবেন, তাহলে আশা দিলেন ক্যান?’ সেদিন এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্রা। কিন্তু এই একই প্রশ্ন যদি শিশু কিশোররা আমাদেরকে করে, তাহলে আমরা মুখ লুকানোর জায়গা পাবো তো? তাই সাধারণ জনগণের উচিত এখন থেকেই সচেতন হয়ে ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। রাস্তা চলাচলে ফুটপাথ ব্যবহার করা এবং রাস্তা পারাপারে ফুট ওভারব্রিজ আর জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করা। এতে সড়ক দুঘর্টনা যেমন কমে আসবে, তেমনি ছাত্রদের আন্দোলনের দামও পরিশোধ হবে। পরিশেষে, আইন মানতে ছোট-বড় প্রত্যেকেই উৎসাহিত হবে বলে আশা রাখি।