মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ তুরস্কের লাভ-ক্ষতির সমীকরণ

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে তুরস্কের যে পদচারণা, তা রীতিমতো বিশ্বকে হতবাক করে দিচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজান সব জায়গায় তুরস্কের সশস্ত্র অবস্থান চোখে পড়ার মতো। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে হয়তো।
সাইফুল বিন শরীফ
  ১৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান দুটি রাষ্ট্রই মধ্য এশিয়ার দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত। আর্মেনিয়া হচ্ছে খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, আর আজারবাইজান শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। ইতিহাসের এক সময় এ অঞ্চলগুলো পারস্য সম্রাজ্য তথা ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উনিশ শতকের দিকে রুশ ও পারস্য যুদ্ধে ইরান রাশিয়ার কাছে পরাজিত হলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্য সম্রাজ্যের ওপর তুর্কিমানচাই চুক্তিসহ আরও কিছু চুক্তির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো দখল করে নেয়। পরে ১৯১৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আজারবাইজান দখলের ফলে সেখানে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯২০ সালে সোভিয়েত লালফৌজ আজারবাইজান দখল করে নেয়। পরে সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক আজারবাইজানকে তাদের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করে। ঠিক একইভাবে আর্মেনিয়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনাধীন ছিল। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দুটি পাশাপাশি রাষ্ট্র, এ দুটি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার যেমন সীমান্ত আছে তেমনিভাবে ইরানের সঙ্গেও সীমান্ত রয়েছে। আবার আজারবাইজানের সঙ্গে তুরস্কেরও কিছুটা সীমান্ত আছে। আপনি যদি দেখেন এ রাষ্ট্রগুলোর প্রাচীন যে দ্বন্দ্ব তা শতাব্দীব্যাপী চলমান দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বগুলো আমরা অনেকেই ধর্মীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখলেও আসলে তা যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি দ্বন্দ্বের কারণ হচ্ছে জাতিগত এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার দ্বন্দ্ব। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দুটি রাষ্ট্রই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। সেই তখন থেকে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। আর সেই অঞ্চল হলো নাগার্নো কারাবাখ। ৫০০০ বর্গ কিলোমিটারের এ অঞ্চলের প্রায় ৭৬% জনগণ আর্মেনীয় বংশধূত এবং আশির দশক থেকে আজারবাইজানের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল আর্মেনীয়রা। ১৯৮৮ সালের দিকে এসে তাদের এ আন্দোলন অনেক বেশি পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আর্মেনিয়া তাদের অধু্যষিত অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করে এবং তাদের জনগণ আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে মত দেন। আজারবাইজান তাদের এ মতকে সমর্থন না করাই আর্মেনিয়া সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিতে থাকে, এবং তারা সেখানে যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাধী সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। যার ফলে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বিরাট সংকট তৈরি হয়। আইনগতভাবে নাগার্নো কারাবাখ এ অঞ্চলটি এখনো পর্যন্ত আজারবাইজানের আছে। যদিও এটি নিয়ন্ত্রণ করছে আর্মেনিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল ৪ বার আর্মেনিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ ভূখন্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রেজুলেশন হয়েছিল। মুসলিমদের সর্বোচ্চ সংস্থা ওআইসি ১৯৯৪ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে অনেকবার এ ভূখন্ডের বিরোধ নিয়ে ওয়াইসি শীর্ষ সম্মেলনে কথা বলেছে। ওয়াইসি বলেছে, আর্মেনিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদী দল যেন আজারিদের ন্যায্য ভূখন্ড ছেড়ে চলে যায়। এ ভূখন্ড নিয়ে পর্যায়ক্রমে ২০০৮, ২০১০ এবং ২০১৬ সালেও যুদ্ধ হয়েছিল এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে। আমরা জানি, সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান নাগার্নো কারাবাখ অঞ্চল দখল নেওয়ার জন্য অভিযান শুরু করে। এখন পর্যন্ত এ অভিযান ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। তাদের এ যুদ্ধের পেছনে রয়েছে মূলত ভূখন্ডগত বিরোধ এবং জাতিগত বিদ্বেষ। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধে তুরস্ক কেন নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন এ প্রশ্ন সবার এবং এ যুদ্ধে তুরস্কের লাভ-ক্ষতির সমীকরণ কি? আমরা অনেকে তার হিসাব মেলাতে চাই। তুরস্কের এ যুদ্ধে আজারবাইজানকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। তুরস্ক আর আজারবাইজান শিয়া ও সুন্নি মতাদর্শের বিশ্বাসী হলেও তারা জাতিগতভাবে একই বংশের। তুর্কিরা যেমন অর্ঘুজ বংশের বংশধর, ঠিক একইভাবে আজারিরাও অর্ঘুজ বংশের বংশধর। তাই তুরস্ক আর আজারবাইজানকে বলা হয় এক জাতি দুই দেশ। তুরস্ক ১৯৯৪ সালেও আজারিদের যুদ্ধে সহায়তা করেছিল, কিন্তু তখনকার তুরস্ক আজকের এ অবস্থানে ছিল না। বর্তমানে এরদোয়ানের তুরস্ক সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম। বর্তমান ড্রোন প্রযুক্তিতে তুরস্ক বিশ্বের আইকন। তুরস্ক এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হতে পারে, সিরিয়ার পিকেকে নিয়ে যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল তুরস্কের সঙ্গে আমেরিকা এবং রাশিয়ার। যার ফলে আমেরিকা সিরিয়া ছেড়ে চলে যায়। আমেরিকা চলে যাওয়ায় রাশিয়া একাই এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এরদোয়ান এ অঞ্চলে নিজের প্রভাব স্থায়ী করতে যুদ্ধকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এরদোয়ান হয়তো মনে করেন, দক্ষিণ ককেশাসের এ রাষ্ট্রে যদি নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাহলে তার কিছুটা দাবানল ছড়িয়ে পড়বে উত্তর ককেশাসে রাশিয়ার মুসলিম অধু্যষিত কিছু রাজ্যে। যার ফলে এরদোয়ান সহজে পুতিনকে কাছে পাবেন। পুতিনকে এরদোয়ানের কাছে রাখা দরকার আমেরিকার চাপ থেকে বাঁচার জন্য। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে কারণ হতে পারে, তুরস্ক আর আজারবাইজান জাতিভাই হিসেবে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সহযোগিতা। তুরস্ক তার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন দিয়ে আজারিদের সহযোগিতা করেছে, ইতিমধ্যে তুর্কি ড্রোন বেশ সফল হয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজানে তুর্কি ড্রোনের সাফল্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তুর্কি ড্রোনের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, ইতিমধ্যে বেশকটি দেশ তুর্কি ড্রোন কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এদিকে রাশিয়া আর্মেনিয়ার মিত্র হলেও এখনো পর্যন্ত রাশিয়া আর্মেনিয়াকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। এমনকি রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আর্মেনিয়ার ভূখন্ডের বাইরে গিয়ে রাশিয়া কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়ার যেমন ভালো সম্পর্ক রয়েছে তেমনি আজারবাইজানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে, সুতরাং রাশিয়া চাইবে না কোনো দেশের সঙ্গে ঝামেলা করে নিজেদের ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হোক। তা ছাড়া তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার বেশকিছু চুক্তি রয়েছে। রাশিয়া যদি আজারবাইজানের বিপক্ষে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে তুরস্কের বিপক্ষে যাওয়া হবে, যা রাশিয়া চাইবে না। ইসরাইল এ অঞ্চলের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি। ইসরাইলের সঙ্গে আজারবাইজান ও তুরস্কের অস্ত্র বাণিজ্য রয়েছে। তাই ইসরাইল তার ক্রেতাকে সন্তুষ্ট রাখার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর আমেরিকা যেহেতু ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র তাই আমেরিকাও তার মিত্রের ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনো কাজ করবে না। সুতরাং আমেরিকা এ যুদ্ধে এখনো পর্যন্ত হঁ্যা না সাড়া দিচ্ছে না। আর দেবে বলেও সম্ভাবনা খুব কম, কারণ সামনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সুতরাং এ যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে আজারবাইজান। আর্মেনিয়া পুরো বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, কারণ এ অঞ্চলটি আজারবাইজানের ন্যায্য অধিকার। আজারিরা তাদের নিজেদের ভূখন্ড উদ্ধারে যুদ্ধ করছে। কেউ যদি আজারবাইজানের বিপক্ষে অবস্থান নেয় তাহলে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ইরান এ যুদ্ধে জাতিভাই আজারিদের সহযোগিতা না করে সহযোগিতা করছে আর্মেনিয়াকে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, এখানে ধর্মভিত্তিক যুদ্ধের কোনো উপস্থিতি নেই, আছে মূলত আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। আর্মেনিয়ার সঙ্গে যেহেতু ইরানের ভালো সম্পর্ক সুতরাং ইরান আর্মেনিয়াকে সহযোগিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইরান এ যুদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। যদি এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় তাহলে তার প্রভাব ইরানের উপরেও যাবে, কারণ ইরানে প্রায় ২ কোটি আজারবাইজানি বসবাস করে। এ ২ কোটি আজারি যদি কখনো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আজারবাইজানের সঙ্গে একত্রিত হতে চায় তাহলে ইরানে একটা ফাটল ধরবে। তাই ইরান যুদ্ধ বিরতির জন্য বারবার আহ্বান করছে, যুদ্ধের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটুক এটা ইরান চায় না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে তুরস্কের যে পদচারণা, তা রীতিমতো বিশ্বকে হতবাক করে দিচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজান সব জায়গায় তুরস্কের সশস্ত্র অবস্থান চোখে পড়ার মতো। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে হয়তো। মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বের প্রশ্নে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে তাতে সবার উপরের সারিতে এরদোয়ান থাকবেন নিঃসন্দেহে। সৌদি আরব, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া এ সব পরাশক্তির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে তুরস্ক কতটুকু এগিয়ে যেতে পারে তাই দেখার বিষয়। ঝুঁকি নিয়েই এরদোয়ান এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে আজারবাইজান ইসু্যতে অবরোধের হুমকিও দেওয়া হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। এ যুদ্ধ পশ্চিমাদের তুরস্কের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝার মতো। সামনে গ্রিস, আর্মেনিয়া, সিরিয়া, পেছনে কলকাঠি নাড়ছে পশ্চিমারা। তাই তুরস্ককে অনেক সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যদি দেখি যুদ্ধের ময়দানে আর্মেনিয়া বেশ কোণঠাসা হয়ে গেছে। আজারবাইজানের হামলায় এ পর্যন্ত আর্মেনিয়ার প্রায় ৪০০ শতাধিক সৈন্যের মৃতু্যর খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে, বেশকিছু ভারী যুদ্ধ সরঞ্জাম তুর্কি ড্রোনের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। আজারি সেনারা নাগার্নো করাবাখের ২৭টির মতো এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। আজারিদের চেয়ে আর্মেনিয়ানদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এ যুদ্ধে গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করেছে তুর্কি ড্রোন। শেষ পর্যন্ত আর্মেনিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান করা হয়েছে। আমরা যুদ্ধ চাই না শান্তি চাই। যুদ্ধবিহীন এর সমাধান হোক। আজারবাইজান তার নিজের ভূখন্ড ফিরে পাক। সাইফুল বিন শরীফ : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে