নানা রূপবৈচিত্র্যে দেবী দুর্গা

বৈদিক যুগের শেষভাগে দুর্গাকে ভবানী, অম্বিকা, ভদ্রকালী, গৌরী প্রভৃতি নামেও চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে যেমন দুর্গা প্রসঙ্গ উলিস্নখিত হয়েছে তেমনি পুরাণ থেকে যানা যায় দুর্গাপূজার নানা কথা।

প্রকাশ | ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
মহাকাশে পৃথিবী নামক গ্রহটি নিয়ে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের রয়েছে সীমাহীন কৌতূহল। জীবশ্রেষ্ঠ মানবজাতির বিস্ময়কর আবেগ থেকে সৃষ্ট দেবীমূর্তি মহাশক্তির মহালীলার জীবন্ত অনুষঙ্গ। ভক্ত মনের গভীরতর উপলব্ধিতে দেবীর যে রূপবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে তা পাপবিনাশী শান্তি দায়িনীর রূপকল্প। কল্পনার রাজ্যে অসংখ্য দেবীর আবির্ভাব হলেও মানসলোকে দেবী দুর্গার প্রভাব অপরিসীম। চিরজাগ্রত চেতনার এক অনন্য সাধারণ দেবী দুর্গার শক্তি মোহিত করেছে মানবসভ্যতাকে। সনাতন, শাশ্বত অন্তর্লোকের শক্তিরূপে বিভাসিতা দেবী দুর্গাকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনকর্তা হিসেবেই রূপায়িত করা হয়েছে। দেবীর দশহস্ত প্রসারিত হয়েছে একদিকে আসুরিক শক্তি দমনে অন্যদিকে বিশ্বময় শান্তি ও সৃষ্টিস্থিতির রক্ষক হিসেবে। ঋগ্‌বেদে দেবী সূক্তে দেবীরূপে পার্বতী ঊমার বর্ণনা রয়েছে। কোনো কোনো পন্ডিতের গবেষণায় শাশ্বত ধারণা রয়েছে, বৈদিক যজ্ঞাগ্নি থেকে পৌরাণিক দুর্গাদেবীর উৎপত্তি। অগ্নি হচ্ছে শক্তিরূপিণী, তেজোময়ী। অগ্নিতে যে শক্তি দুর্গাতেও ওই একই শক্তি। দুর্গাদেবী সব দেবতার সম্মিলিত তেজ ও শক্তি তাই দুর্গা অগ্নিস্বরূপা। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যায় ঊমাকে বলা হয়েছে ব্রহ্মদায়িনী অর্থাৎ দুর্গা দেবতাদের প্রথমে ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। আবার বরফাশ্রিত পর্বতকন্যা দুর্গা হৈমবতী নামেও প্রসিদ্ধা। এদিকে তান্ত্রিক মতে কুমারী মহাশক্তি দেবীরই অনন্য প্রতীক। এ কারণেই কুমারীপূজা প্রচলিত হয়ে আসছে। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতে যুগ যুগ কাল থেকে দুর্গোৎসবে কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। প্রাচীনকালে মহান ভারতবর্ষকে কুমারী দ্বীপ বলা হতো। গবেষকদের ধারণা এ নাম থেকেই দুর্গার কুমারী নামের উৎপত্তি। আসমুদ্র ভারতে দেবী দুর্গার বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকাশ ব্যাপক ও বিস্তৃত। বৈদিক যুগের শেষভাগে দুর্গাকে ভবানী, অম্বিকা, ভদ্রকালী, গৌরী প্রভৃতি নামেও চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে যেমন দুর্গা প্রসঙ্গ উলিস্নখিত হয়েছে তেমনি পুরাণ থেকে যানা যায় দুর্গাপূজার নানা কথা। দুর্গা যাকে দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সংকট থেকে ত্রাণ করেন। যিনি দৈত্যনাশসূচক, বিঘ্ননাশসূচক, পাপ, রোগ, ভয় থেকে মুক্ত করেন, শত্রম্ন নাশ করেন, আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং অন্যায় অসত্যকে হনন করেন বলেই তিনি দুর্গা। তাই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, মহাশক্তি, শত্রম্নবিনাশিনী মহামায়া। স্বর্গরাজ্য থেকে মহিষাসুর দ্বারা বিতাড়িত দেবগণ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়ে বললেন- 'আমরা আপনার স্মরণ গ্রহণ করলাম- আপনি সেই দুরাচার অসুর বধের কথা ভাবুন।' একথা শুনে বিভিন্ন দেবগণের শরীর থেকে নির্গত বিশাল পর্বতের মতো একীভূত তেজপুঞ্জ হতে জ্যোতির্ময় পরমাসুন্দরী এক অপূর্ব নারী মূর্তির আবির্ভাব হয়। এ নয়নবিমোহন নারীই মহাদেবী মহিষাসুরমর্দিনী। সত্যযুগে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মূর্তি তৈরি করে তিন বছর ধরে আরাধনা করছিলেন। ত্রেতা যুগে রাবন বসন্তকালে অর্থাৎ চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করেছেন। যা বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত। সে জন্য দুর্গাদেবীকে বাসন্তীদেবীও বলা হয়। শ্রী রামচন্দ্র রাবন বধের জন্য আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শরৎকালে দুর্গাপূজা করছিলেন বলে এটা শারদীয় পূজা নামে খ্যাত ও বহুল প্রচলিত। যুগে যুগে শারদীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। আধ্যাত্মিক চেতনার মূলে শারদীয় উৎসব গ্রোথিত আছে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মা দুর্গা ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে বিশ্রাম শুরু করেন এবং আশ্বিন মাসের কৃষ্ণাষ্টমীতে বিশ্রাম ভঙ্গ করেন। রামচন্দ্র অকালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন বলে শরৎকালের এই পুজোকে অকালবোধনও বলা হয়। চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী মধু ও কৈটভ নামে দুই পরাক্রমশালী অসুরের হাত থেকে দেবতাদের বাঁচানোর জন্য ব্রহ্মা অসময়ে দেবীকে জাগ্রত করেছিলেন। আবার ব্রহ্মান্ড পুরাণ ও শ্রী বিদ্যার ললিতা অনুসারে কামদেবের ভস্ম থেকে তৈরি ভগু নামে এক অসুরকে বধ করার জন্যই দেবীকে অসময়ে জাগানো হয়েছিল। দ্বাপর যুগে গোপকুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতি হিসেবে পাওয়ার কামনায় অগ্রহায়ণ মাসে হেমন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন। মহাভারতেও যুধিষ্ঠির কর্তৃক দুর্গাস্তব এবং ভীম পর্বে যুদ্ধের শুরুতে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুনের দুর্গাস্তবের কথা বর্ণিত আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেবতা, মানুষ নির্বিশেষে কালে কালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছে দুর্গতিনাশের জন্য। দশভুজা দেবীর পুত্র-কন্যাদের পূজা করা হয় ভিন্ন ভিন্ন কারণে। একেকটার লক্ষ্য উদ্দেশ্যে সরস্বতী, লক্ষ্ণী, কার্তিক, গণেশ পূজা হয়ে থাকে বিভিন্ন তিথিতে। দুর্গাদেবীর সঙ্গেও এদের একত্রে পূজা হয়। এটা রূপবৈচিত্র্যের অনন্য উদাহরণ। আবার একই পর্বে মহাকালীর পূজা হয়। দুর্গার অন্যরূপ শক্তির নাম মহাকালী। এরূপে বিশ্বে এক ভিন্ন বিশেষত্ব নিয়ে কালীমূর্তি ধারণ করে পাপবিনাশ করেছেন দেবী। এ উপমহাদেশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু বহু জায়গায় দুর্গা দেবীর পূজা প্রচলন রয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যেখানে যেখানে অবস্থান করেন সেখানে দুর্গা পূজা হয়ে থাকে। সে হিসেবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে অঞ্চলভেদে দেবীর নামের এবং রূপের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এ রূপবৈচিত্র্যের বিস্তার প্রাচীনকাল থেকেই। প্রকৃতপক্ষে ভক্তের ভক্তির উৎসে দেবীর রূপবৈচিত্র্য বিদ্যমান। তারাপদ আচার্য্য :সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ