বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশ্বিক মন্দা ও মানবিক বিশ্বভাবনা

আজ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবী একটি মানবিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করছে। মানবিক বিশ্বব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে ধ্বংসের মুখোমুখি হবে মানবসভ্যতা। আজ সব রাষ্ট্রকেই সমরাস্ত্র ধ্বংস করে, যুদ্ধের মনোভাব পরিহার করে, সুন্দর পৃথিবী গড়ার শপথ নিতে হবে। আমাদের পৃথিবীকে গুটি কয়েক যুদ্ধ-উন্মাদ মানুষের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না। করোনা মহামারি জয় করার পাশাপাশি আজ আমাদের যুদ্ধবিরোধী চেতনাও জাগ্রত করতে হবে।
মোনায়েম সরকার
  ২৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে পুরো পৃথিবীই আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। পৃথিবীর এমন কোনো ভূখন্ড নেই, যে ভূখন্ডের অধিবাসীরা নভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্কে আতঙ্কিত নয়। মহামারি আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে এর আগেও বহুবার হানা দিয়েছে কিন্তু এবারের মহামারি অল্পসময়ের মধ্যে সারাবিশ্ব গ্রাস করে নিয়েছে। হতদরিদ্র, দরিদ্র এবং উন্নত সব রাষ্ট্রেই কমবেশি আধিপত্য বিস্তার করে চলছে এই করোনা মহামারি। কীভাবে এই ঘাতক মহামারির হাত থেকে মানব সভ্যতা রক্ষা করা যায় তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণা করে যাচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান নিশ্চয়ই এই সংক্রামক মরণব্যাধি জয় করতে সক্ষম হবে। সংগ্রামী মানুষ মহামারির কাছে কখনোই মাথা নত করেনি, এবারের এই অভিনব মহামারির কাছেও মানুষ পরাজয় মানবে না।

করোনাভাইরাস মানবজাতির চলমান জীবনে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি করলেও যে দুটি বিষয় নিয়ে প্রত্যেকটি মানুষই কমবেশি চিন্তিত সে দুটি বিষয় হলো- স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক সংকট। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেসব দেশ দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনে নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছে এবং এখনো রাখছে- সেসব দেশ এখনই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। আমরা যদি ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে তাদের অর্থনীতি অনেকটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিশেষ করে পৃথিবীর 'মোড়ল' বলে খ্যাত, সুপার পাওয়ার আমেরিকা গভীর সংকটে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন, টঘঙ, টঘঊঝঈঙ, ওখঙ, ডঐঙ-এর তহবিলে অর্থদান বন্ধের ঘোষণা- এ কথাই প্রমাণ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে যেসব বেফাঁস কথাবার্তা বলছেন, তা পৃথিবীবাসীর হাসির খোরাক জোগালেও, দুশ্চিন্তার মধ্যেও ফেলেছে। ট্রাম্পের মলিন মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় সত্যিই তিনি আজ কতখানি অসহায়। তার অর্থনৈতিক সংকট এতটাই তীব্র হয়েছে যে, বেকারত্বের হার তিন থেকে চৌদ্দ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। দিনে দিনে এই হার বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুঁজিবাদী আমেরিকা তার পুঁজি বিকাশের জন্য চিরদিনই জবরদস্তির পথ বেছে নিয়েছে। আমেরিকা শুধু একটি কথাই জানে কীভাবে টাকা কামানো যায়। টাকা ছাড়া তাদের কাছে আর সবকিছুই তুচ্ছ, মূল্যহীন। টাকার গন্ধ পেলে তারা বন্ধুর গলায়ও ছুরি ধরতে পারে। করোনাপরবর্তী পরিস্থিতিতে আমেরিকার অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার দুটি পথ থাকবে। একটি হলো অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন পদ্ধতি, অপরটি ভিন্ন দেশের সম্পদ লুণ্ঠন, অর্থাৎ যুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব খবর প্রচার করা হচ্ছে তাতে সহজেই বোঝা যায় অস্ত্র ছাড়া আর তেমন কিছুই আমেরিকায় উৎপাদন হয় না। অস্ত্রই আমেরিকার ব্যবসা ও সম্পদ অর্জনের প্রধান ভরসা। অস্ত্র তারা বিক্রি করে এবং প্রয়োজনে নিজেরাই ব্যবহার করে। অস্ত্রের পথে হেঁটে হেঁটে আমেরিকা নিজেই এখন অস্ত্র হয়ে গেছে। দিকভ্রান্ত, উন্মাদ আমেরিকা এখন যে দেশের দিকে দৃষ্টি দেবে সেই দেশই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

মুসলিম-শাসিত তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো ইতোমধ্যেই আমেরিকা নিঃশেষ করেছে। সেসব দেশের লুণ্ঠিত সম্পদ খুব একটা হাতে আছে এমন নয়। বিলাসী আমেরিকার বিশাল সৈন্যবাহিনী, ন্যাটো, পেন্টাগন, সিআইএ-র ব্যয়ভার এবং ভোগবাদী নাগরিকদের জীবনমান অব্যাহত রাখতে নিশ্চয়ই হিমশিম খাবে। তখন তারা অর্থের জন্য হন্যে হয়ে যাবে। সেসময় তারা কাকে ছোঁবে আর কাকে খাবে তা বলা মুশকিল। পৃথিবীর মানুষ যদি এখনই এ ব্যাপারে সচেতন না হয় তাহলে করোনার চেয়েও সেই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

অস্ত্র ব্যবসা চলমান রাখার জন্য এক সময় আমেরিকা দেশে দেশে সামরিক সরকার বসিয়ে রেখেছিল। বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত প্রায় ৭০টি দেশে আমেরিকার মনোনীত পুতুল সরকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পরোক্ষভাবে ৭০টি দেশের অর্থকড়ি এসে জমা হতো আমেরিকার রাজকোষে। বিশ্ববাসী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সোচ্চার হয়ে উঠলে ধর্মীয় উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে দেশে দেশে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে তারা। মধ্যপ্রাচ্য লুণ্ঠন করতে এই জঙ্গিবাদ খুবই কাজে লাগে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন প্রশাসনের।

করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে আমেরিকার মিত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না, বরং অনেকটাই হ্রাস পাবে। ইউরোপের যেসব দেশ আমেরিকার অপকর্মে এতদিন অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে- সেসব দেশ এখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। তাদের দেশ ও দেশের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে সেই চিন্তা করতে করতেই তারা দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার সমরনীতিকে তারা কিছুতেই সমর্থন করবে না। আমেরিকা সেটা বুঝতে পেরে চীনের বিরুদ্ধে পৃথিবীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে মনগড়া অভিযোগ উত্থাপন করে যাচ্ছে।

আমি অর্থনীতিবিদ নই, অর্থশাস্ত্রে আমার জ্ঞান নেই বললেই চলে। তবুও দীর্ঘদিন যেহেতু রাজনীতি করেছি, দুই একজন অর্থনীতিবিদ মন্ত্রী, আমলা আমার সুহৃদের তালিকায় আছেন বলে অর্থনীতির কিছু কিছু জটিল হিসাবও বুঝতে পারি। মার্কিন প্রশাসন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেকায়দা পরিস্থিতিতে আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে আগামী দিনে দুটি চ্যালেঞ্জ খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, অন্যটি নাগরিক সুরক্ষা। আমেরিকার মানুষকে করোনাভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সুপার পাওয়ার আমেরিকার নাগরিক নিরাপত্তা আসলেই কতটা নড়বড়ে। এতদিন মিথ্যাকে যেভাবে ট্রাম্প চাপা দিয়ে রেখেছিলেন, করোনা সেসব ফাঁস করে দিয়েছে। আমেরিকার মানুষ আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। খাদ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ মিছিল বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে আমেরিকার দিন শেষ হয়ে আসছে।

সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা হয়তো মনে করে পৃথিবীর সব দেশ তাদের কথায় উঠবে-বসবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এ ভাবনা মোটেই ঠিক নয়। আজ আমেরিকার নিজের ঘরেই ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। নিজের ঘর না সামলিয়ে, ভিয়েতনাম, কিউবা, বলিভিয়া কিংবা আফগানিস্তানের যুদ্ধের কথা স্মরণ না করে আমেরিকা যদি আবার বিশ্বব্যাপী রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে, তাহলে এবার তার দুর্ভাগ্যজনক পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। পৃথিবীর মানুষ বিগত পাঁচ দশক ধরে যেভাবে আমেরিকার হাতে সর্বস্ব খুইয়েছে- এবার সময় আসবে সেসব হিসাব-নিকাশ কড়ায়-গন্ডায় আদায় করার। তবে শঙ্কার কথা হলো- আমেরিকা যখন মরবে তখন পৃথিবীও সুস্থ থাকবে না। আমেরিকা তার মৃতু্যর মধ্যে দিয়ে আরো অনেক দেশের মৃতু্যও ত্বরান্বিত করবে- যা আমরা কেউই চাই না।

করোনার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি গোটা মানব জাতিকে বেশ কিছু শিক্ষা দিয়ে যাবে। এই শিক্ষাগুলোর মধ্যে থাকবে পুঁজিবাদী জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে সাম্যবাদের হারিয়ে যাওয়া বণ্টন পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা, নাগরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, মারণাস্ত্র উৎপাদনের পরিবর্তে অকাল মৃতু্য জয় করার বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। পৃথিবীতে এখন কারো হাতে এককভাবে ক্ষমতা গচ্ছিত থাকুক- এটা কেউই প্রত্যাশা করে না। একবিংশ শতাব্দীরবিশ্বব্যবস্থায় যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। যুদ্ধের পথ পরিহার করে অবশ্যই মানুষকে শান্তির পথে এগিয়ে যেতে হবে। শান্তির পথে না গিয়ে মানুষ যদি আবার কোনো খেয়ালের বসে যুদ্ধের পথে যাত্রা শুরু করে তাহলে তার পরিণাম কত ভয়াবহ হবে তা আমাদের কল্পনাকেও হার মানাবে।

সারা পৃথিবীতে আমেরিকার আটশত মিলিটারি ঘাঁটি আছে। ছয় হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র তাক করা আছে পৃথিবীর নানাদিকে। এত শক্তির অহংকারে ট্রাম্প প্রশাসন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। 'ডঐঙ'-র অর্থনীতিবিদ জেফ্রে সাচ্চে (ঔবভভবৎু ঝধপযং) ঠিকই বলেছেন- ঞৎঁসঢ় রং ধ :যৎবধঃ :ড় :যব ড়িৎষফ ড়ৎফবৎ. গত দুটি বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার গায়ে কোনো আঁচড়ই লাগেনি। তারা যুদ্ধের মাঠে নেতৃত্ব দিলেও কেউ তাদের গায়ে হাত তোলার সাহস করেনি। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে এবার যদি আমেরিকা তৃতীয় কোনো বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর পরিকল্পনা করে- তাহলে সেটা হবে চরম বোকামি। আমেরিকার একক নেতৃত্বের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এখন যেভাবে পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হলে সমগ্র পৃথিবীর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

আজ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবী একটি মানবিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করছে। মানবিক বিশ্বব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে ধ্বংসের মুখোমুখি হবে মানবসভ্যতা। আজ সব রাষ্ট্রকেই সমরাস্ত্র ধ্বংস করে, যুদ্ধের মনোভাব পরিহার করে, সুন্দর পৃথিবী গড়ার শপথ নিতে হবে। আমাদের পৃথিবীকে গুটি কয়েক যুদ্ধ-উন্মাদ মানুষের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না। করোনা মহামারি জয় করার পাশাপাশি আজ আমাদের যুদ্ধবিরোধী চেতনাও জাগ্রত করতে হবে।

\হকেননা, একটি অদৃশ্য ভাইরাস যেভাবে পৃথিবীকে বিপন্ন করে তুলেছে তারপরে যদি পারমাণবিক যুদ্ধ বাঁধে তাহলে সেই যুদ্ধের তেজস্ক্রিয়তায় পৃথিবীর কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা আজ কিছুটা হলেও অনুভব করা যাচ্ছে। মানুষকে সমস্যার সংকীর্ণপথ অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হয়। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ এভাবেই সব বাধা মোকাবিলা করে অভিযাত্রা অটুট রেখেছে। আমরা আশা করব আগামী পৃথিবী মানবিক হবে, যুদ্ধের পথ সচেতনভাবে পরিহার করে, সম্প্রীতি ও সাম্যবাদে আস্থা রাখবে।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<116265 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1