শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালীন আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা

বিদ্যালয় বন্ধ এ কথা বলা যাবে না। এতে অভিভাবক শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের কাছে ভুল মেসেজ যায়। সাধারণ মানুষ মন করে বিদ্যালয় বন্ধ কোনো কাজ ছাড়া শিক্ষকবৃন্দ বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। কার্যত এটা ঠিক না। বিদ্যালয়ে সরাসরি পাঠদান বন্ধ কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমরা অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি।
দুলাল চন্দ্র চৌধুরী
  ২৬ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

আমরা সকলেই জানি যে, কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশেরে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ১৭ই মার্চ ২০২০ইং থেকে বন্ধ আছে। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় অচল অবস্থা বিরাজ করছে। প্রথমদিকে এ অবস্থা যে এত দীর্ঘ সময় স্থায়ী হবে সেটা আমাদের অনেকেরই ধারণায় ছিল না। চীন তিন মাসের মধ্যে করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত হয়েছিল বলে আমাদের অনেকের ধারণা ছিল আমরাও এ রকম সময়ের মধ্যে মুক্তি লাভ করতে পারব। বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। আমাদের ধারণা ছিল রমজানের পরে হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিবেশ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আজ অক্টোবরে এসেও স্কুল বন্ধ আছে। এ বছর এ অবস্থা চলবে বলে ধরে নিয়েই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঘোষণা করলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। তার পরিবর্তে অংংরমহসবহঃ মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে যে, শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখনফল অর্জন করতে পেরেছে। এখানে কোনো গ্রেডিং ব্যবস্থা থাকবে না। তিনি আরও বলেন যে, সিলেবাস এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে যা ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পাঠদান সম্পন্ন করা যায়। এজন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিকট পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অংংরমহসবহঃ ব্যবহার আমাদের দেশে নতুন নয়। তবে বহুল প্রচলিত বা আলোচিত নয়। আমাদের অনেকের কাছে অংংরমহসবহঃ শব্দটি নতুন। তাহলে অংংরমহসবহঃ কী? ইংরেজি অংংরমহসবহঃ শব্দটির বাংলা অর্থ হলো নিয়োগ, কর্তব্য, কার্য, নির্ধারণ, বরাদ্দ, বিভাজন, বণ্টন, বিতরণ, স্থিরিকরণ, স্বত্ব নিয়োগ, আরোপণ ইত্যাদি। আমার মনে হয় এ শব্দটি সর্বাধিক ব্যবহার হয় হোমওয়ার্ক হিসেবে। যদিও অংংরমহসবহঃ অধিকার, কাজ বা সম্পত্তি হস্তান্তরের সম্পর্কিত একটি অংংরমহবৎং এবং একজন নিয়োগকারীকে জড়িত শব্দ। এসব বিষয়ের মধ্য থেকে দেখা যায় অংংরমহসবহঃ শব্দটি অর্থ তার প্রয়োগের স্থান, কাল, পাত্র ও বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে কাউকে দেওয়া এক টুকরো কাজ, শিক্ষার্থীরা তাদের উপর আরোপিত কাজ বা পড়াশোনার অংশ। অংংরমহসবহঃ এর অর্থ বাড়ির কাজ ধরলে আমরা এর সাথে অনেক পূর্ব থেকেই পরিচিত। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকবৃন্দ আদিকাল থেকেই একটি অধ্যায় বা পাঠ শেষে বাড়ির কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতেন বা ব্যস্ত রাখতেন। তবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হতো না।

সনাতন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের প্রধান অংশ ছিল বার্ষিক পরীক্ষা, ষান্মাসিক পরীক্ষা এবং এটাই ছিল চূড়ান্ত। আমরা এ অবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি বলে মূল্যায়ন বলতে প্রান্তিক পরীক্ষাই বুঝি। এর পরে আসে পাবলিক পরীক্ষা। এটাতো আরও মহা মূল্যাবান ব্যবস্থা। এখানে একটি সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলে সেটা দিয়ে সারা জীবন পার করা যায়। তাহলে দেখা যায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাব্যবসায় আমরা সব সময় অংংরমহসবহঃ নামক বাড়ির কাজ করে আসছি। কিন্তু কখনো এটাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিখনকালীন মূল্যায়নকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে গিয়ে আমরা অংংরমহসবহঃ শব্দের সঙ্গে পরিচিত হই। উচ্চশিক্ষার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অংংরমহসবহঃ জমা দিতে হয়। অংংরমহসবহঃ বলতে আমরা সেখানে কী বুঝতাম? শিক্ষক একটি প্রবন্ধ বা অধ্যায় পাঠদান করার পরে একটি বা দুটি প্রশ্ন দিতেন, যা শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে বিভিন্ন সহায়ক বই ঘেঁটে উত্তরমালা তৈরি করে শিক্ষকের কাছে জমা দিতে হতো। শিক্ষক সেটা মূল্যায়ন করে নম্বর দিতেন যা সমষ্টির পরীক্ষার নম্বরের সাথে যুক্ত করতেন। আর এখান থেকে আমরা পরিচিত হলাম অংংরমহসবহঃ শব্দটির সঙ্গে। ২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণিত হওয়ার পরে তার আলোকে ২০১২ সালে জাতীয় কারিকুলাম তৈরি করা হয়। সেই কারিকুলামে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় দুটি ধারা যুক্ত হয়। একটি শিখনকালীন মূল্যায়ন, অন্যটি প্রান্তিক পরীক্ষা অর্থাৎ প্রথম সাময়িক পরীক্ষা ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা। ফলাফল নির্ধারণ করা হতো শিখনকালীন মূল্যায়ন থেকে নেওয়া হতো ৩০% এবং প্রান্তিক পরীক্ষা থেকে নেওয়া হতো ৭০%, সব মিলে ১০০%। ১ম সাময়িক পরীক্ষা ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার গড় নম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা ফল প্রকাশ করা হতো। তখন শিখনকালীন মূল্যায়নকে বলা হতো ঝ.ই.অ বর্তমানে যা ঈ.অ বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন নামে পরিচিত। ঈ.অ.-এর কয়েকটি ধাপ আছে যথা- বাড়ির কাজ, শ্রেণির কাজ, শ্রেণির অভীক্ষা, দলগত কাজ, নির্ধারিত কাজ এসবের ইংরেজি প্রতিশব্দ অংংরমহসবহঃ.

বর্তমানে ঈ.অ.তে ২০% এবং সাময়িক পরীক্ষায় ৮০% সব মিলিয়ে ১০০%। তাহলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যে মূল্যায়নের কথা বলেছেন তা শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন বিষয় নয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যায়নের একটি অংশ যা সারা বিশ্বে প্রচলিত এবং গ্রহণযোগ্য। আমরা যে প্রশিক্ষণ নেই তার প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রান্তিক মূল্যায়ন পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে। পুরাতন ধ্যান-ধারণা আকারে থাকার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রান্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। করোনাকালে আমরা আধুনিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় যেতে পারছি এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে অভিনন্দন এ রকম একটি সুন্দর ব্যবস্থায় আমাদের কোমলমতি শক্ষার্থীদের নিয়ে আসার জন্য। তবে ভালো ব্যবস্থাটিকে প্রচারে আনতে হবে। যাদের দিয়ে এটি বাস্তবায়ন করবেন। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকের এ বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করার জন্য তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। যাতে করে তাদের নেতিবাচক মনোভাব দূরীভূত হয়। এ পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে চাই। আমি একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মী নীতি-নির্ধারিত নই। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হব। নির্দেশনার সাংঘর্ষিক নয় এমন কিছু বিষয় আমরা সংযুক্ত করতে পারি। যা আমাদের বিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে আমাদের কিছু সমস্যা হয় যখন একটি পরিপত্রের আলোকে কাজগুলো গুছিয়ে এনে শিক্ষক-অভিভাবক শিক্ষার্থী ম্যানেজিং কমিটির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলি তখনই এটি আর একটি পরিপত্রের দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই পরিপত্র দেওয়ার সময় আমাদের নীতি-নির্ধারকদের দূরদর্শী হওয়া উচিত। ৩০/০৪/২০২০ইং তারিখ জেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় তড়ড়স পষড়ঁফ ধঢ়ঢ়ং বা অন্য যে সব ধঢ়ঢ়ং দ্বারা ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমরা শিক্ষকবৃন্দের অনেকেই এটাকে গুরুত্ব সহকারে নিতে পারিনি। আমাদের কাছে এ নির্দেশনা যথাযথভাবে পৌঁছায়নি। আবার জুলাই মাসে প্রথম সপ্তাহে একটি নির্দেশনা আসে যে মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন ও ১৩ই জুলাই পর্যন্ত অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের শতকরা হার প্রেরণ করার জন্য। তখন আমরা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ সমস্যায় পড়ে যাই। কী তথ্য দিব? অনলাইন ক্লাস কোনো কোনো স্কুল একেবারেই নেয়নি। আমরা যারা নিয়েছি তাও নগণ্য। না নেওয়া বা কম নেওয়ার কারণঃ অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারী প্রশ্ন ছিল অনলাইন ক্লাস নিলে তা দেখার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল দিতে হবে। কিছুদিন আগে আমরা শিক্ষার্থীদের মোবাইল নিয়ে স্কুলে আসতে নিষেধ করছি। আজ আমরাই তাদের হাতে মোবাইল তুলে দিব- এটা স্ববিরোধিতা নয়? যদিও যারা অনলাইন ক্লাস দিতে অভ্যস্ত নয়, তারাই বিরোধিতা করছেন বেশি করে।

আমরা প্রথম যারা আইসিটি বিষয়ে দক্ষ তাদের দিয়ে শুরু করলাম। পর্যায়ক্রমে অনভ্যস্ত শিক্ষক অভ্যস্ত হলেন। প্রায় শতভাগ শিক্ষক অনলাইন ক্লাস দেওয়া শুরু করেছেন। শিক্ষকবৃন্দ এত অল্প সময়ে এ বিষয়টি রপ্ত করতে পারবেন- এটা ধারণার বাইরে ছিল। আস্তে আস্তে শিক্ষকবৃন্দ দক্ষ হয়ে উঠছেন। এটা একটা বিরাট সফলতা। যেসব শিক্ষার্থীর অনলাইন সুবিধা নেই তাদের অংংরমহসবহঃ মাধ্যমে পাঠ মূল্যায়ন আগে থেকে শুরু করা হয়েছিল। এখন শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা পেলাম। তবে আমার সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা আছে।

১. বিদ্যালয় বন্ধ এ কথা বলা যাবে না। এতে অভিভাবক শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের কাছে ভুল মেসেজ যায়। সাধারণ মানুষ মন করে বিদ্যালয় বন্ধ কোনো কাজ ছাড়া শিক্ষকবৃন্দ বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। কার্যত এটা ঠিক না। বিদ্যালয়ে সরাসরি পাঠদান বন্ধ কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমরা অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি। বিষয়টি এ রকম বলা যায় বিদ্যালয় সরাসরি পাঠদান বন্ধ কিন্তু অনলাইন পাঠ চালু আছে। শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে পড়াশোনা করবে।

২. বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ বলা যাবে না, বলতে হবে প্রান্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন না করে আমরা অংংরমহসবহঃ-এর মাধ্যমে মূল্যায়ন করব। আমরা অটো প্রোমোশন দিব না অংংরমহসবহঃ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার করতে হবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে এ ধারণা পৌঁছাতে হবে যে অংংরমহসবহঃ হলো আধুনিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা। ০৩. শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কেউ তামাশা করতে পারবে না। এত বড় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে আমরা তামাশার পাত্র হতে চাই না।

দুলাল চন্দ্র চৌধুরী : প্রধান শিক্ষক ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<116483 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1