আর কত ভোগান্তি জলাবদ্ধতায়?

সবার সমন্বিত উদ্যোগেই কেবল এই পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসা সম্ভব। অন্যথায় নগরবাসীসহ পযার্য়ক্রমে সারা দেশের মানুষকেই এর চরম মূল্য দিতে হবে। তাই জলজট নিরসনে নগর পিতার সুনজর ও সবর্স্তরের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই হয়তো জলাবদ্ধতার মতো এত বড় অভিশাপ থেকে উত্তরণ অনেকাংশে সম্ভব হবে।

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০১৮, ০০:০০

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক নদী। কিন্তু বতর্মানের চিত্রটা একটু ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রাণ কেন্দ্র ঢাকা নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূণর্ এলাকাগুলোয় বষার্কালে আসতে না আসতেই দেখা যায় অনেক নদ-নদী ছোট ছোট সৈকত। সমুদ্র সৈকত দেখার জন্য নগরবাসীকে কষ্ট করে সুদূর কক্সবাজার, কুয়াকাটা যেতে হয় না। মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মালিবাগ এই এলাকাগুলোতে গেলেই দেখতে পায় সমুদ্র সৈকত। যে সব রাস্তায় বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশা চলাচল করে বষার্কাল আসলে মাঝেমধ্যে নৌকাও দেখা যায় এ সব রাস্তায়। এ রকম নজিরও দেখা গিয়েছে নগরীতে। নগরীতে যানজটের সঙ্গে জলজটও মিশে নগরবাসীর জীবনকে দুবির্ষহ করে তুলেছে। জীবন আর কত দুবির্ষহ হলে যথাযথ কতৃর্পক্ষ তাদের প্রণীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করবে? নাকি ডুবন্ত ঢাকা নগরী দেখার অপেক্ষা করছে তারা। ঢাকা নগরী ডুবে যাবে সারা দেশের মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে তবেই কি তাদের বিবেক বোধের টনক নড়বে? বতর্মানে বষর্কালে এক পসলা বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা। প্রকৃতির ঋতু অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বষার্কাল। ঋতু অনুযায়ী এই দুই মাস বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃতি অনেকটাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়াই এই বছরে গ্রীষ্মকালেই অনেক বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং বষার্কালের শুরুতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে প্রাণ কেন্দ্র ঢাকা নগরীতে। এবং বিগত সব বছরের রেকডর্ ভেঙে জলাবদ্ধতার আকার ভয়াবহতায় রূপ নিয়েছে। গত বষার্য় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছিলেন এই বষার্য় নাকি আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। বষার্কাল চলে এসেছে কিন্তু তেমন কোনো কাযর্ক্রম শুরু করা হয়নি এখনো। জলাবদ্ধতা নিরসনে মূল দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা এখন পযর্ন্ত সক্রিয় কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এখন পযর্ন্ত কোনো নালা পুরোপুরি পরিষ্কার ও পুনঃখনন করেনি কোনো খাল। এটা বতর্মানের জলাবদ্ধতার রূপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নগরবাসীকে। বষার্র দিন যতই বাড়ছে জলাবদ্ধতার সমস্যা যতখানি নিরসনের কথা ঠিক ততটাই বেড়ে চলছে। জলাবদ্ধতার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রধান কারণ হলো অপযার্প্ত ও অপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। আরও অন্যতম কারণ হচ্ছে যথাসময়ে পানি সরতে না পারা, খালের গতিপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, সিটি করপোরেশনের ৪০টি ওয়াডের্র মধ্যে অধিকাংশ ওয়াডের্ পানি নিষ্কাশন, আবজর্না, খাল ও নালা-নদর্মা ভরাট মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছে ওয়াডর্ সমন্বয় কমিটি। এ ছাড়া জলাধার ভরাট করে বহুতল ভবন নিমার্ণ করেছে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি। এর ফলে বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ঢাকার আশপাশে এক সময় ৬৩টি নদী-নালা, খাল-বিল ছিল। বতর্মানে যার কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবকটিই প্রভাবশালীদের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়ে মরে গেছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এ সব খাল ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫ সাল থেকে অনেক পরিকল্পনা তৈরি করেছেন সিটি করপোরেশন, ওয়াসা এবং কি পরিকল্পনা কমিশন। বতর্মানের বষার্কালের ঢাকা নগরীর চিত্র দেখেই বোঝা যায় সেই পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে হচ্ছে বিধায় কোনো কতৃর্পক্ষই যথাযথভাবে দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। ২০১৫ সালের ২৯ জুন দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন ভারী বষর্ণ হলে নাকি জলাবদ্ধতার কিছু সমস্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা যে ঘুমিয়ে থাকব সেই সুযোগ নেই। সকাল বিকাল কাজ করছি। তিনি বলেছিলেন বৃষ্টির মৌসুমটা কেটে যাক। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পরে কাজ করে দেব। বৃষ্টির মৌসুমে কাজ করলে নাকি ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ার অসংখ্য সম্ভাবনা আছে। সেই ২০১৫ থেকে ২০১৮ আজও কি বষার্র মৌসুম কেটে ওঠেনি? দীঘর্ চার বছর পর ও কি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ সময় হয়নি? বতর্মান সময়ে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে নগরীর নালা-নদর্মা-খালের আবজর্না বজর্্য অপসারণ এবং এগুলোর গভীরকরণ কাজ সময়মতো করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। যথাযথ কতৃর্পক্ষ বলছে শিগগিরই এ কাজটি করা প্রয়োজন ছিল। একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে সময়ের এক ফেঁাড়, অসময়য়ের দশ ফেঁাড়, এই ক্ষেত্রে সবার্ংশে প্রযোজ্য হয়েছে। সত্যিই জলাবদ্ধতার সমস্যা বতর্মান সময়ের বড় সমস্যা হয়ে দঁাড়িয়েছে। জলাবদ্ধতার অভিশাপের সম্মুখীন পুরো নগরবাসী। জলাবদ্ধতার ভয়াবহ রূপ দেখে নগরবাসীর একটাই কথা এই কষ্ট আর কতদিন চলবে? জলাবদ্ধতার কারণে সময়মতো কমর্স্থলে পৌঁছানোটা ও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মৃত্যুর পর আর কিছু নয়, দাফনের জন্য প্রয়োজন সাড়ে তিন হাত মাটি। কিন্তু সেই মাটিটুকুও মিলছে না জলাবদ্ধতার কারণে বলেছিলেন রাজধানীর বৃহত্তম জুরাইন কবরস্থানের কমর্রত লোকেরা। জলাবদ্ধতার কারণে সেখানেই কোদালের কোপ বসানো হয়, গলগল করে উঠে আসে পানি। সত্যি এসব পরিস্থিতি দেখে নগরবাসী আজ নিবার্ক। বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নশীল দেশ। যেখানে একটি দেশের প্রাণকেন্দ্র ডুবে যাচ্ছে, কমর্ময় জীবন অক্ষম হয়ে পড়ছে তা দেখে যথাযথ কতৃর্পক্ষ নিশ্চুপ হয়ে আছে এটাই কি উন্নয়নশীল দেশের নমুনা? যেখানে যানবাহনের চাকাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে উন্নয়নের চাকা কীভাবে ঘুরবে? জনশক্তিকে অচল করে অক্ষম করে কোনো দেশের উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। সব সমস্যার সমাধানের একমাত্র পন্থা হতে পারে সমন্বিত প্রচেষ্টা। পৃথিবীর বহু দেশে নগরায়ণের পরও নদী রক্ষা ও নিষ্কাশন সুব্যবস্থার নজির আছে। তাহলে আমরা কেন পারছি না। নগর সরকার গঠন করে সব নগরের জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার অভাবে তা যেন ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। হতাশ মনে আজ নগরবাসীর প্রশ্ন জাগে, জলাবদ্ধতার নিরসনের স্বপ্ন কি বাস্তবায়ন হবে? আমাদের বিশ্বাস অবশ্যই হবে। এই জন্য সব অপশক্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ণ করতে হবে, নদী, খালগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। সবার সমন্বিত উদ্যোগেই কেবল এই পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসা সম্ভব। অন্যথায় নগরবাসীসহ পযার্য়ক্রমে সারা দেশের মানুষকেই এর চরম মূল্য দিতে হবে। তাই জলজট নিরসনে নগর পিতার সুনজর ও সবর্স্তরের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই হয়তো জলাবদ্ধতার মতো এত বড় অভিশাপ থেকে উত্তরণ অনেকাংশে সম্ভব হবে। অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোডর্ ইউনিভাসিির্ট বাংলাদেশ। শধসৎঁষথংঁন@যড়ঃসধরষ.পড়স