ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবস। দিনটি সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ আগস্ট, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার, সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে, সুবহে সাদিকের সময় মহাকালের এক মহাক্রান্তিলগ্নে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবার তেষট্টি বছরের এক মহান আদর্শিক জীবন অতিবাহিত করে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৮ জুন, ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ একই দিনে তিনি পরলোক গমন করেন। দিনটি মুসলিম সমাজে 'ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে সমধিক পরিচিত। ঈদ, মিলাদ আর নবী তিনটি শব্দ যোগে দিবসটির নামকরণ হয়েছে। ঈদ অর্থ- আনন্দোৎসব, মিলাদ অর্থ- জন্মদিন আর নবী অর্থ নবী বা ঐশী বার্তাবাহক। তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব। ১২ রবিউল আউয়াল একই সঙ্গে মহানবীর জন্ম ও মৃতু্য দিবস হলেও তা শুধু জন্মোৎসব হিসেবেই পালিত হয়। পৃথিবীর যে কোনো মানুষের মুতু্যই তার পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে। কিন্তু মহানবীর মৃতু্য মানবসমাজ ও সভ্যতার কোনো পর্যায়ে কোনো শূন্যতার সৃষ্টি করেনি। যদিও তার মুতু্যর চেয়ে অধিক বেদনাদায়ক কোনো বিষয় উম্মতের জন্য হতে পারে না। তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীর জন্য আলস্নাহর রহমত হিসেবে। এরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭) এরশাদ হয়েছে, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন বিধানকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতরাজিকে পূর্ণতা দিলাম আর ইসলামকে তোমাদের একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা আল-মায়িদা ; ৩)। রবিউল আউয়াল মাস এলে মুসলিম সমাজে মিলাদ মাহফিল ও সিরাত মাহফিল আয়োজনের ধুম পড়ে যায়। কিন্তু রাসুলুলস্নাহ (সা.) যে আদর্শের সুষমা দিয়ে একটি বর্বর জাতিকে আদর্শ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে থাকা একটি সমাজকে শান্তির সুশীতল ছায়াতলে এনে দিয়েছিলেন; সেই মহান আদর্শে উত্তরণের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। মহানবীর আদর্শ অনুসরণ না করে শুধু মিলাদ মাহফিল আর সিরাত মাহফিল আয়োজনে কোনো লাভ নেই। কারণ মহান আলস্নাহ রাসুলুলস্নাহ (সা.)-এর আদর্শকে জীবনে ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, 'হে রাসুল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আলস্নাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আলস্নাহ তায়ালা তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আলস্নাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। (সূরা আল-মায়িদা : ৩১) রাসুলুলস্নাহ (সা.) চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমেই একটি শ্রেষ্ঠ জাতি গঠন করেছিলেন। হজরত আব্দুলস্নাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন নিশ্চয়ই আমি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণাঙ্গতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি। (ইবনে মাজা) রাসুলুলস্নাহ (সা.)-এর আদর্শ ধারণ করেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যুগের সর্বোত্তম মানুষ হতে পেরেছিলেন। হজরত আব্দুলস্নাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন : সর্বোত্তম মানুষ হলো আমার যুগের মানুষ, অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ। (সহিহ বোখারি)। হজরত আব্দুলস্নাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একটি হাদিসে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন : কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি আর তাকে হত্যা করা কুফরি। (বোখারি-মুসলিম) হজরত আবু জার গিফারি (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির প্রতি ফাসেকি বা কুফরির অপবাদ নিক্ষেপ করে তখন অভিযুক্ত ব্যক্তি তার উপযুক্ত না হলে অপবাদ নিক্ষেপকারীর দিকে তার অপবাদ ফিরে আসে। (সহিহ বোখারি) রাসুলুলস্নাহ (সা.) গোত্রীয় শাসনের স্বৈরাচারে দগ্ধ, মুষ্টিমেয় বিত্তশালীর শোষণে নিঃস্ব, সামাজিক দূরাচারে অতিষ্ঠ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাওহিদের বাণী প্রচারের দায়ে স্বজাতির নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর ঐতিহাসিক মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে ইহুদি, পৌত্তলিক, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের নিয়ে মদিনাতে একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র জাতি ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অল্পসময়ের ব্যবধানে রাসুলের আদর্শিক জাগরণ সমগ্র আরব উপদ্বীপকে আয়ত্ব করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সুশাসন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। \হআজ যখন দেশের বিপুল মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যখন অন্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাব জনজীবনে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন মানুষ একে অপরের দ্বারা নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে তখন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হোক রাসুলের ভালোবাসার দাবিতে সংঘাত নয়, চাই রাসুলের আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ। মোহাম্মদ মাকছুদ উলস্নাহ : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ