করোনাকালের লেখাপড়া এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রথমবার করোনার আক্রমণ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর পর দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। সেই চিন্তা-ভাবনা থেকেই এ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সাধারণ মানুষের চলাফেরা আর শিক্ষার্থীদের চলাফেরা একরকম নয়। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা কমে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় তা আবারও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর সে জন্যই হয়তো আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না সরকার।

প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
চলছে করোনাকাল। করোনাভাইরাস ডিজিজ যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথমে চীনে শনাক্ত হওয়ার কারণে এটি কোভিড-১৯ হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু কি পরিচিতি লাভ করেছে! এটি এখন সারা বিশ্বের একটি আতঙ্ক হিসেবে মানবজাতিকে কার্যত পঙ্গু করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা ৫ কোটি ৩৯ লাখ, যার মধ্যে মৃতু্যবরণ করেছে ১৩ লাখ ১১ হাজারের অধিক মানুষ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত চার লাখ ৩২ হাজার ৩৩৩ জন। মৃতের সংখ্যা ছয় হাজার ১৯৪ জন। আর দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। চীনে প্রথমে শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশে দেশে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেকটি দেশেই কোভিড-১৯ এর রোগীর সংখ্যা বাড়ার ওপর ভিত্তি করে সে সব দেশের অফিস, আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কখনো আংশিক আবার কখনো পুরো লকডাউনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানি, বাংলাদেশে প্রথম ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে তিনজন করোনা রোগী শনাক্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৮ মার্চ ২০২০ থেকে লকডাউনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কাছে চলতি ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির নোটিশ রয়েছে। এখানে করোনাকাল শুরুর দিককার কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। আমরা জানি বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পহেলা জানুয়ারি থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে থাকে। বর্তমান সরকার বছরের প্রথমদিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিয়ে শিক্ষাবর্ষের শুভসূচনা করে থাকে। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে) জানুয়ারি থেকে সর্বোচ্চ মার্চ, এপ্রিল, মে মাসের দিকে সেশন শুরু হয়ে যায়। আবার এ সরকারের আমলে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেশনজট কমানোর অংশ হিসেবে পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং তাদের সমমান পাবলিক পরীক্ষাগুলোর তারিখসহ রুটিন আগেই নির্ধারিত থাকত। তাই বরাবরের মতো গত বছরের (২০১৯) শেষদিকে নভেম্বর, ডিসেম্বর, ফেব্রম্নয়ারি মাসে যথাক্রমে পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক এবং তাদের সমমান পরীক্ষাগুলো নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হতে পারলেও এপ্রিলের ২ তারিখ ২০২০ থেকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষাটি সংঘটিত হতে পারেনি। উচ্চশিক্ষার জন্য মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাগুলো হতে পারলেও এবং তারপর ক্লাস শুরু করতে পারলেও নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার মধ্যবর্তী ও ফাইনাল পরীক্ষাগুলো হতে পারেনি। এতে সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই অনেক মানসিক চাপের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত কখনোই বাসায় বসে থাকে না। তাদের চঞ্চল মন। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়ানোই তাদের স্বভাব। সারাক্ষণই নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাস, পরীক্ষা, কোচিং, মডেল টেস্ট, ভর্তি পরীক্ষা, প্রাইভেট পড়া, পড়ানো, প্রাইভেট টিউশন করা, করানো ইত্যাদি কার্যক্রমে সর্বদাই শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত থাকত। কিন্তু এখন কার্যত এর সবই বন্ধ রয়েছে। সে জন্য শিক্ষার্থীরা হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। দিশাহারা হয়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনায়। শুরুর দিকে করোনার আতঙ্কের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে লেখাপড়ার বাইরে থাকতে পেরে অনেক খুশি হয়েছিল তারা। কিন্তু দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন তাদের আর ভালো লাগছে না যা প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান। তারা না পারছে কোথাও বেড়াতে যেতে, না পারছে বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে মিশে সময় কাটাতে। সে জন্য তারা একগুঁয়ে ও বোরিং হয়ে পড়ছে। তবে সরকারি নির্দেশে সব না হলেও কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনভিত্তিক ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। তবে এর সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন অবশ্য অনলাইন ক্লাসের বাইরে আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রামীণপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এখন অনলাইন ক্লাসের আওতায় চলে এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জুম অ্যাপ, গুগল মিট, বিডিরেনসহ আরও অনেক অ্যাপের মাধ্যমে এ সব অনলাইন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি সীমিত আকারে কুইজভিত্তিক মূল্যায়ন হিসেবে পরীক্ষাও শুরু করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতিমধ্যে সরকার এইচএসসি পরীক্ষার বিশেষ পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের পাশাপাশি মাধ্যমিক পর্যায়ে বিশেষভাবে মূল্যায়নের ভিত্তিতে অটো প্রমোশন দেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে। অনলাইন ক্লাস একদিকে যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস হিসেবে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তারা এ সব ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটি একদিকে সুবিধা এবং অন্যদিকে অসুবিধা। সুবিধা হলো- সবাই এ সব ডিজিটাল ডিভাইসে অভ্যস্ত হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ নামে ইমেইল আইডি, ফেসবুক আইডি খুলে চ্যাটিংয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অবসরের বেশির ভাগ সময় তারা এ সব ডিভাইসে আটকে থাকছে। আর সব অভিভাবকের সঙ্গতি একরকম নয়। সবার একটি স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ, ডেস্কটপ ক্রয়ের জন্য সঙ্গতি বা সচ্ছলত নেই। আবার এগুলো ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারলেও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থা রাখা সম্ভবপর হচ্ছে না। এতে যাদের সঙ্গতি নেই তারা এ সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাৎ সবার সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ছে। সঙ্গতিহীনরা নিজেদের ছোট ও বঞ্চিত মনে করে হীনম্মন্যতায় মানসিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তবে এটিও ঠিক, করোনার টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত হয়তো আমাদের করোনাকে নিয়েই বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের এখন এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে অন্য সবার মতো শিক্ষার্থীদেরও মানসিকভাবে করোনার ভিতর দিয়েই এভাবে চলার অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দিতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশের তুলনায় শীতের দেশগুলোতে করোনা মহামারির অবস্থা অনেক বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমাদের দেশেও সামনে শীতকাল আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রথমবার করোনার আক্রমণ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর পর দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। সেই চিন্তা-ভাবনা থেকেই এ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সাধারণ মানুষের চলাফেরা আর শিক্ষার্থীদের চলাফেরা একরকম নয়। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা কমে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় তা আবারও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর সে জন্যই হয়তো আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না সরকার। এ করোনাকালে আমার নিজের বাসায় সব ধরনের অভিজ্ঞতাই লক্ষ্য করছি। আমি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি। আমার স্ত্রী কাজ করেন একটি উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজে। আমার বড় ছেলে ক্যাডেট কলেজের মাধ্যমিক শাখার শিক্ষার্থী এবং ছোট ছেলে প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষার্থী। আমার স্ত্রী কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য অতি যত্নসহকারে অনলাইন ক্লাস নিলেও শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা বোঝা কঠিন। কারণ আমি তো আমার নিজের দুই সন্তানের অনলাইনে ক্লাস করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হচ্ছি। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক জায়গা থেকে এ করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতার আকুতি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। তবে মন্দের ভালো যে শিক্ষার্থীদের অলস সময় কিছুটা হলেও কাজে লাগছে। উপরন্তু বিষয়টি শুধু যেহেতু আমাদের দেশের একার নয়। আর এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার অভিজ্ঞতাও আমাদের কারও নেই। সে জন্য বিজ্ঞানী থর্ন ডাইকের প্রচেষ্টা ও ভ্রম সংশোধন (ঞৎরধষ ধহফ বৎৎড়ৎ) নীতির মাধ্যমেই এগোনো ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে প্রত্যাশা করি যেন এমন পরিস্থিতি আর প্রলম্বিত না হয়। আর হলেও যেন তা আমরা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে সে বিষয়েও গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন। এমনিভাবেই হয়তো আমরা অন্য মহামারির মতো করোনাকেও জয় করব ইনশালস্নাহ। এমন প্রত্যাশার মাধ্যমেই আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি ফিরে আসবে। \হ ড. মো. হুমায়ুন কবীর : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শনফযঁসধুঁহ০৮@মসধরষ.পড়স