আগুন সন্ত্রাসে আর একটি প্রাণও ঝরে না যাক

আগুন সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোর পর ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল যথারীতি পরস্পরকে দোষারোপ করেছে এবং হয়তো আরও করবে। সেই দোষারোপের রাজনীতিতে না গিয়েও আমরা বলতে পারি, ঘটনাগুলো অত্যন্ত জঘন্য ও নিন্দনীয়। কোনোভাবেই একে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। আগুন সন্ত্রাসের এ পুনরাবির্ভাবকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। তা না হলে একসময় এটিই দাবানল হয়ে উঠতে পারে।

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার করোনা উপেক্ষা করেই কর্মস্থলে ছুটছে মানুষ। অফিস-আদালতপাড়া কর্মচঞ্চল। চাকা ঘুরছে কল-কারখানার। চলছে গাড়ি। যানজটের চিত্রও আগের মতোই। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে জমজমাট হাট-বাজার। পাশাপাশি চলছিল ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচন। দুপুরে হঠাৎই পাল্টে যায় রাজধানী ঢাকার দৃশ্যপট। প্রথম খবর আসে নয়াপল্টন এলাকায় কে বা কারা একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এর এক ঘণ্টার মধ্যে খবর আসতে থাকে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে। মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজার, শাহবাগ, মতিঝিল, বংশাল, কারওয়ান বাজার, সচিবালয়ের ৫ নম্বর গেটের সামনে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন এলাকায় একে একে নয়টি বাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে। কারা এবং কেন এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে না পারলেও পুলিশ বলছে, এ ঘটনা পরিকল্পিত। আগুনে পুড়ে যাওয়া বাসের মধ্যে তিনটি সরকারি। জানা গেছে, দুর্বৃত্তরা যাত্রীবেশে বাসগুলোতে আগুন লাগিয়ে দ্রম্নত পালিয়ে গেছে। যেসব বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তাতে তিনজন থেকে সর্বোচ্চ ১২ জন যাত্রী ছিলেন। আচমকা অশান্ত পরিবেশ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। মুহূর্তেই ঢাকা ফাঁকা হতে শুরু করে। কমে যায় গাড়ি চলাচল। হতচকিত হয়ে পড়েন রাস্তায় টহলরত পুলিশ সদস্যরা। এ ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক। আসল ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। কয়েক বছর আগে জঙ্গিরা সারাদেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ও বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মানুষ মেরেছিল। বৃহস্পতিবারের ঘটনা যদি সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে জঙ্গিসন্ত্রাস রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখনই মাঠে নামতে হবে। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার এ অশনিসংকেত থেকে নিরাপদ থাকতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই সজাগ হতে হবে। আবার কি দেশে আগুন সন্ত্রাস ফিরে এলো? বৃহস্পতিবার ১১টি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা এমনই প্রশ্ন করছিলেন। ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে এমনই আগুন সন্ত্রাস দেখেছিল দেশের মানুষ। সে সময় কয়েকশ মানুষ আগুনে পুড়ে হতাহত হয়েছিল। একপর্যায়ে মানুষ ঘর থেকে বেরোতেও ভয় পেতো। কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আবারও এমন আগুন সন্ত্রাস দেখে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনের দিন এমন সন্ত্রাসকে পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে করছে পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে, প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। কয়েকজনকে শনাক্ত এবং গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, আগুন সন্ত্রাসের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১২ নভেম্বর দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে পল্টনে বিএনপি অফিসের উত্তর পাশে। এখানে কর অঞ্চল-১৫ এর পার্ক করা সরকারি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর দুপুর ১টার দিকে মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে, ১টা ২৫ মিনিটে গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রমনা হোটেলের সামনে, দেড়টায় শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে, ২টা ১০ মিনিটে সচিবালয়ের উত্তর পাশে এবং ২টা ২৫ মিনিটে বংশাল থানার নয়াবাজার এলাকায় বাসে আগুন লাগানো হয়। বাকি বাসগুলোতেও বিকাল সাড়ে ৪টার মধ্যে অগ্নিসংযোগ করা হয়। উপনির্বাচনের ফলাফল পাওয়া গেছে রাতে। ফলে এটা স্পষ্ট যে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কারণে হঠাৎ উত্তেজিত কোনো পক্ষ এ ঘটনা ঘটায়নি। বরং বলা যায় যে আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল, নির্বাচনের দিন এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটানো হবে। বাসগুলোতে গানপাউডার বা অন্য কোনো বিস্ফোরক পদার্থ দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে এবং সন্ত্রাসীরা সেগুলো আগে থেকেই সংগ্রহ করে রেখেছিল। শুধু বাসে অগ্নিসংযোগ নয়, নির্বাচনকেন্দ্রসহ কয়েকটি স্থানে হাতবোমারও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। আগুন সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোর পর ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল যথারীতি পরস্পরকে দোষারোপ করেছে এবং হয়তো আরও করবে। সেই দোষারোপের রাজনীতিতে না গিয়েও আমরা বলতে পারি, ঘটনাগুলো অত্যন্ত জঘন্য ও নিন্দনীয়। কোনোভাবেই একে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। আগুন সন্ত্রাসের এ পুনরাবির্ভাবকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। তা না হলে একসময় এটিই দাবানল হয়ে উঠতে পারে। এ সব ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতাই আমাদের চোখে পড়ে। সন্ত্রাসীরা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে, তা সম্ভবত পুলিশ ও গোয়েন্দারা আগে থেকে কিছুই জানতে পারেনি। তারা যাতে ২০১৩-১৪ সালের মতো তান্ডব চালাতে না পারে সে জন্য গোয়েন্দাদের আরও তৎপর হতে হবে। আমরা চাই, যে কোনো মূল্যে জনজীবনের স্বাভাবিকতা রক্ষা করা হোক। আগুন সন্ত্রাসে আর একটি প্রাণও ঝরে না যাক। আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।