মার্কিন নির্বাচন ও মিয়ানমারের নির্বাচন পরবর্তী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ

আমরা আশা করছি, বাইডেন সরকারের সময় বিশ্বে কোনো ধরনের যুদ্ধ বা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হবে না। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় নতুন সরকার ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যবসাবাণিজ্য, অভিবাসনসহ সব ধরনের কার্যক্রমে বাইডেন সরকার বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে আমাদের দৃঢ় আশাবাদ।

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

সৈয়দ ফারুক হোসেন
রোহিঙ্গা শব্দের অর্থ পৃথিবীর অত্যাচারিত এবং অতি নিপীড়িত একটি জাতিসত্তার নাম। চার দশকেরও বেশি সময় যাবত রাষ্ট্রহীন অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রিত। বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে ২০১৬-২০১৭ সালে বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি মিয়ানমার ত্যাগের মাধ্যমে। গণহত্যা ও জাতিগোষ্ঠী নিধনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১৯৭৮ সালে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী এ দেশে এসেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের যে ঢল এ দেশে এসেছে, এমনটা আগে কখনো হয়নি। এটা দেশের জন্য বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নানা নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেটার আশু সমাধান দরকার। শরণার্থীদের আগমন মানবিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন কোনো নতুন বিষয় নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী সেনাদের পরিকল্পিত আক্রমণ সেই ১৯৬০-এর দশক থেকেই শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এক নতুন মাত্রা। আক্রমণের ফলে প্রায় সাত থেকে আট লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, রাখাইনে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে- যা আধুনিক যুগের সংঘটিত সংখ্যালঘু আক্রমণ এবং জাতিগত নিধনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রাণে বাঁচিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে গিয়ে শত শত রোহিঙ্গা শিশু এবং নারী নাফ নদীতে ডুবে মারা গিয়েছে আর শুধু বার্মাতেই প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে, এই সংখ্যাটি আরো অধিক হতে পারে। জাতিগতভাবে মুসলিম হওয়াতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শুধু যে বর্মীসেনা কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে তাই নয়, বরং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সমাজের একটি শ্রেণি থেকেও রোহিঙ্গারা গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং আক্রমণের শিকার হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। মিয়ানমারের অন্যান্য দলগুলোও তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে না পারায় মিয়ানমারের এবারের নির্বাচনের ফলাফল আগেই অনুমানযোগ্য ছিল। ২.৬ মিলিয়ন মানুষকে যে দেশে সরকারিভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়, সে দেশের নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আদৌ আগ্রহ দেখাবে কি না, তা সন্দেহের বিষয়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের এই নির্বাচন তেমন কোনো নতুন ভূমিকাই ফেলেনি বা সামনে ফেলবে না। প্রত্যাবাসন কার্যকর না হওয়ার জন্য দায়ী পূর্বের অবস্থার কোনো পরিবর্তন এ নির্বাচনের ফলাফল বয়ে আনেনি। অন্যদিকে ভারত নিজ দেশে অবস্থানরত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং সীমান্ত নিরাপত্তা- এসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ভারত সব সময়ই মিয়ানমারের সমর্থক, পাশাপাশি ভারত ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি করতে চায় না। এদিকে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত, বাণিজ্য সম্পর্ক, রাখাইনে অর্থনৈতিক এলাকা তৈরি এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে চীন রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের ওপর তেমন প্রভাব রাখছে না। মিয়ানমারে প্রতি চীন ও ভারতের মৌন সম্মতি কোনোভাবেই রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে সৃষ্ট ভূ-রাজনীতির উন্নয়নে তেমন কিছু আশা করা খুবই কঠিন। আর মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত, থাইল্যান্ড, জাপানের সম্পর্কের দিকে তাকালেও বুঝা যায় তাদের নানাবিধ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশেষ কোনো অগ্রগতি হবে না। তাই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা ব্যতীত এই সংকটের কোনো সমাধান হবে না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মানবিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং মানব পাচারসংক্রান্ত নিরাপত্তার ঝুঁকি প্রধান বলে প্রতীয়মান হয়। কিছু সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানবপাচারচক্র রোহিঙ্গাদের প্রতি শকুনের দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। বেশির ভাগ আগত রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে কোনো পুরুষ সদস্য নেই, অধিকাংশই নারী ও শিশু। ফলে বিভিন্ন পাচারচক্র তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের বিদেশে যৌনকর্মী এবং শিশুশ্রমিক হিসেবে পাচার করার চেষ্টা করছে। অপরদিকে অর্থনৈতিক শক্তি আর সামরিক সক্ষমতার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বা অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে বাংলাদেশে। কিন্তু নির্বাচনে যে প্রার্থীই বিজয়ী হোন না কেন, বাংলাদেশ কি চায় বা কি পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইসু্যতে দেশটির সহযোগিতা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। এ কারণেই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের সামনে যে বস্নু-ইকোনমি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আর্কষণের জন্য যে ধাপগুলো আছে, তা চিহ্নিত করে বাংলাদেশের দূর করতে হবে। এসব কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। \হযদিও এ বিষয়ে তারা একমত যে, বাংলাদেশের জন্য সেখানে কোনো দলের কে বিজয়ী হলো তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতি হুট করে পরিবর্তন করে না। দুদেশের নীতির ক্ষেত্রে অনেক সময় পারস্পরিক মতভিন্নতা দেখা গেলেও সার্বিকভাবে তা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক কিছু নয় বলেই ধারণা করা হয়। আমেরিকার কাছ থেকে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যা পেতে পারে তা হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে দেশটির শক্ত অবস্থান, বাণিজ্য ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা, রপ্তানি ক্ষেত্রে সুবিধার পাশাপাশি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট এবং বৈধ অভিবাসনে আরও উদারতা। \হজো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাইডেন এখন পর্যন্ত যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তার শাসনামলের শুরু থেকেই চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিরসনে উদ্যোগ নেবেন। আর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন কমে গেলে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশ্বের এ দুই পরাশক্তির যৌথ উদ্যোগেরও সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ইতিবাচক অগ্রগতি হতে পারে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র এগোলে চীন পিছিয়ে যায়; চীন এগোতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র পেছাতে থাকে। বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের অবসান হলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে এবং সেখানে ভারতও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানও সহজ হবে। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অত্যন্ত পরিপক্ব রাজনীতিবিদ। রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার নিয়ে বাইডেনের সরকার সোচ্চার হবে বলে আশা প্রকাশ করা যায়। তিনি নির্বাচিত হওয়ার ফলে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। মিয়ানমারে যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সে বিষয়েও তার সরকার সোচ্চার হবে বলে আমরা আশাবাদী। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ায় আমেরিকা সব সময়ই মানবাধিকারকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নতুন সরকার মানবাধিকার ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। আমরা আশা করছি, বাইডেন সরকারের সময় বিশ্বে কোনো ধরনের যুদ্ধ বা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হবে না। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় নতুন সরকার ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যবসাবাণিজ্য, অভিবাসনসহ সব ধরনের কার্যক্রমে বাইডেন সরকার বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে আমাদের দৃঢ় আশাবাদ। সৈয়দ ফারুক হোসেন : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়