শান্তি, কল্যাণ, সমান অধিকার ও শুভ চিন্তা আজ কোথায়?

বাঙালি একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত করেছিল পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীকেই শুধু নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি করে পরাজিত করেছিল মানুষের জীবনে দুর্যোগ-দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সব ধরনের ঘৃণ্য, অমানবিক ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শকে। বিজয়ী করে স্বাধীনতা এনেছিল শুধু তাই নয়, বিজয়ী করেছিল অসাম্প্রদায়িকতা ধর্ম নিরপেক্ষতাকে, শান্তি, কল্যাণ, সমান অধিকার ও শুভ চিন্তাকে। আর আজ কী দেখছি আমরা?

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

রণেশ মৈত্র
জন্মেছি ১৯৩৩ সালে। দেখেছি ইংরেজশাসিত ভারত। অতঃপর ২৩ বছর ধরে দেখলাম অনাকাঙ্ক্ষিত দেশ পাকিস্তানকে। ইংরেজশাসিত ভারত ১৪ বছর ধরে দেখলাম। তাই মোটমাট ৩৭ বছর থেকেছি পরাধীনতা আধা পরাধীনতার নিগঢ়ে শৃঙ্খলিত হয়ে। সব ঝড়, তুফান, সাইক্লোন মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে। ঘর-বাড়ি ভেঙেছে- মানুষ অসহায় হয়ে খোলা আকাশের নিচে বাস করেছে তাও দেখেছি। কিন্তু সেগুলো তো মানবসৃষ্ট কোনো দুর্যোগ ছিল না-ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানবসৃষ্ট মুরাদনগর জাতীয় দুর্যোগ ওই ৩৭ বছরে আদৌ দেখিনি তা নয়- অবশ্যই দেখেছি ১৯৭১-এর শত্রম্নসেনা পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতাকালে। তখন যে দুর্যোগ নেমেছিল তা সমগ্র বাঙালির জীবনে। সে দুর্যোগ ঠেকাতে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২৩ বছর ধরে আইনি পথে। আর নয় মাস ধরে বাঙালি জাতি করেছে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ- তারা পরাজিত করেছিল পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীকে। বাঙালি একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত করেছিল পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীকেই শুধু নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি করে পরাজিত করেছিল মানুষের জীবনে দুর্যোগ-দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সব ধরনের ঘৃণ্য, অমানবিক ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শকে। বিজয়ী করে স্বাধীনতা এনেছিল শুধু তাই নয়, বিজয়ী করেছিল অসাম্প্রদায়িকতা ধর্ম নিরপেক্ষতাকে, শান্তি, কল্যাণ, সমান অধিকার ও শুভ চিন্তাকে। আর আজ কী দেখছি আমরা? আজ ওই বিজয় সেগুলো সবই যেন অন্তর্হিত, বিস্মৃত অতীতের বিষয়ে পরিণত। আজকের চিত্র কি? চিত্রটি ফুটে উঠেছে ৪ ও ৫ নভেম্বরের 'ভোরের কাগজ'-এ যথার্থভাবে নিখুঁতভাবে। সে জন্য ভোরের কাগজের কুমিলস্না ও মুরাদনগর প্রতিনিধি অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও এম ফিরোজ মিয়া এবং নিউজ ডেস্ককে অভিনন্দন। ওই খবরে লেখা হয়েছে- কোরবানপুর বাজার পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়েই দেখা গেল একটি বাড়ির সামনে জনাকয়েক পুলিশ বসে আছেন। তাদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একে একে বীভৎসতার চিহ্ন আসতে লাগল। সুরম্য অট্টালিকার বাইরের দেয়ালে সাদা রঙের ওপর আগুনের কালো ধোঁয়ার ছাপ এখনো লেগে আছে। ভেতরে প্রত্যেকটা কক্ষ ভাঙাচোরা। পাশে থাকা টিনের চালার ঘরটি আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোড়া থেকে বাদ যায়নি খাবারের থালা চায়ের কাপ পেস্নটসহ অন্যান্য তৈজসপত্র। পুড়ে গেছে কালী মন্দির, মনসা মন্দির। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র পোড়া জিনিস। এ সবের পাশে মানুষের আহাজারি ও আর্তনাদ। সবার একই কথা, মৃতু্যর মুখ থেকে তারা ফিরে এসেছেন। সেদিন কী ঘটেছিল মুরাদনগরের বাঙ্গরা থানার ৪নং পূর্ব ধৈল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান বনকুমার শিবের বাড়িসহ আশপাশের অন্য হিন্দুদের বাড়িতে এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই সামনে এসে দাঁড়ান গৃহবধূ সান্ত্বনা রানী সিংহ। কান্নাচাপা কণ্ঠে বলেন, জানেন, সেদিন নিজের জীবন বাঁচাতে হাত থেকে শঙ্খের চুড়ি (শাঁখা) খুলে ফেলেছি। কপাল থেকে সিঁদুর মুছে দিয়েছি। পার্শ্ববর্তী মুসলমান বাড়িতে গিয়ে ১৩ বছরের মেয়ে এবং ৮ বছরের ছেলেকে নিয়ে প্রাণ ... বাঁচিয়েছি। ওখানেও ওরা গিয়েছিল। বলেছি আমরা 'মুসলমান'। প্রাণে বাঁচলেও নিজের ঘরকে বাঁচাতে পারিনি। ওরা নিমেষের মধ্যে আমাদের পেট্রোল ও গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় ঘর পোড়ার পাশাপাশি আমার বিয়েতে বাপের দেওয়া সোনার গহনা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রয়োজনের জন্য ঘরে রাখা ২০ হাজার টাকাও পুড়ে গেছে। এতে শুধু ছাই হওয়া নয়, বাপের বাড়ির স্মৃতিটুকুও শেষ এটুকু বলেই কান্না আর চেপে রাখতে পারলেন না। ঘটনার কারণ হিসেবে ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ফ্রান্সের ওই ঘটনার পর দিনকয়েক আগে ফেসবুকে প্যারিস থেকে একজন স্ট্যাটাস দেন। ওই স্ট্যাটাসে 'সহমত' জানিয়ে এখানকার শংকর দেবনাথের ওই লেখাকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে পূর্ব ধৈল ইউনিয়নের এ পাড়াটি উত্তপ্ত ছিল। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে চেয়ারম্যান বনকুমার শিব পুলিশের হাতে তুলে দেন শংকর দেবনাথকে। এরপর গত শুক্রবার স্থানীয় কোবরানপুর বাজারে এলাকার তিন চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে এলাকাবাসী। এ সময় চেয়ারম্যানরা ঘটনার বিচারের আশ্বাস দিলে জনতা শান্ত হয়। কিন্তু শনিবার থেকে আবার বিষয়টি ঘোঁট পাকাতে থাকে। পরে শনিবারেই সাব্যস্ত হয় রোববারে সালিশ বিচার বসবে। মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. রফিকের নেতৃত্বে বিচার শুরু হয়। বিচারের একপর্যায়ে উপস্থিত জনতা দুভাগ হয়ে যান। এক ভাগ বলেন, শংকরকে যখন পুলিশ ধরেছে তখন দেশের প্রচলিত আইনেই বিচার হবে। আর একপক্ষ বলতে শুরু করে ইসলাম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত শংকরকে বাঁচাতে ইচ্ছা করেই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন চেয়ারম্যান বনকুমার শিব। শংকরকে তৌহিদী জনতার হাতে তুলে দিতে হবে। ইসলাম অবমাননার বিচার তৌহিদী জনতাই করবে। এ অবস্থায় বিচারসভা পন্ড হয়ে যায়। এর পর চেয়ারম্যান বনকুমার শিব চলে যান স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সভায়। এদিকে বিচার না মানা অংশটি এলাকায় মাইকিং করে রোববার বেলা ৩টায় আবার মিটিং ডাকে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও লোকজন জড়ো করা হয়। এর পরই 'নারায়ে তকবির-আলস্না হু আকবর' স্স্নোগান দিয়ে উত্তেজিত জনতা প্রথমে শংকর দেবনাথের বাড়িতে চড়াও হয়। নিমেষেই সে বাড়িটি তছনছ করা হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে স্থানীয় কালী মন্দির, মনসা মন্দির ও পরে মুরাদনগরের ৪নং পূর্বধৈল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান বনকুমার শিবের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন দেওয়ার সময় আক্রমণকারীরা স্স্নোগান দিচ্ছিল, 'চেয়ারম্যানের চামড়া-তুলে নেব আমরা'। উলেস্নখ্য, হামলার সময় চেয়ারম্যান বাড়িতে ছিলেন না। পরে জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। গত মঙ্গলবার আক্রান্ত হওয়া ওইসব বাড়িঘর সরেজমিন ঘুরে সাংবাদিকরা দেখেছেন বাসিন্দাদের চোখেমুখে এখনও আতংক। কেউ কথা বলছেন না। শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গত তিনদিন ধরে তাদের বাড়িতে রান্না হচ্ছে না। এর ওর বাড়ি থেকে খাবার পাঠাচ্ছে। সঙ্গে কাপড়ও। কারণ পরনের কাপড় ছাড়া সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছে দৃস্কৃতিকারীরা। কেন এমনটা ঘটল? এমন প্রশ্নের উত্তরে ক্ষতিগ্রস্ত সন্দীপ কুমার শিব বলেন, হামলার কারণ এখনো বোঝা যাচ্ছে না। শুধু ইসলাম অবমাননার অভিযোগে এমন ঘটনা ঘটেছে, নাকি এর পেছনে অন্যকিছু লুকিয়ে আছে তা বের করতে হয়তো সময় লাগবে তবে এ ঘটনায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, গত ১২ বছরে শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, ভানুগাছ থেকে তিন লাখ টাকার আসবাবপত্র কিনেছি, টিনের বেড়া দিয়ে ঘর তুলেছি-আগুনে তার সবই পুড়ে গেছে। ঘরে আগুন দেওয়ার সময় আপনি কোথায় ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে চোখের জল মুছে তিনি বলেন, আমি ওই কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরা আমাকে চিনতে পারেনি। প্রত্যেকের বয়স ১৭-১৮ হবে এবং তারা অন্য এলাকার। আমারই সামনে আমারই ঘর, আসবাবপত্র, খাবারের থালা, কাপ-পেস্নট সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কথায় যোগ দিয়ে স্থানীয় পলস্নী চিকিৎসক রতন বলেন, ওরা ওই সময় এত উগ্র ছিল যে ভয়ে আমাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এই কথোপকথনের সময় ওই বাড়িতে আসেন ৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাজী আবদুল রউফ। এসেই তিনি হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। একপর্যায়ে কান্না থামিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার পর তিন দিন পার হয়ে গেল বাবা কিন্তু কীভাবে ঘটল তা বলতে পারব না। বলেই ফের কান্না শুরু করেন ওই বৃদ্ধ। ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকরা দেখেছেন, চেয়ারম্যান বনকুমার শিব এবং তার কাকাতো ভাইদের ঘর আগুনে পোড়ালেও পার্শ্ববর্তী ঘর অক্ষত ছিল। পাশের ঘর অক্ষত কেন জানতে চাইলে ষাটোর্ধ্ব কল্পনা রানী দেবী বলেন, মুসলমানের ঘর পরিচয় দিয়ে ঘরটি রক্ষা করা গেছে। কারণ হামলা হবে টের পেয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই গ্রামে তিন শতাধিক হিন্দু পরিবার বাস করেন। সবাই নিরাপত্তাহীন। \হরীতা দেবনাথ নামে আর এক নারী বলেন, ঘটনা ঘটেছে রোববার দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। এর দুদিন আগে লক্ষ্ণীপূজা ছিল। প্রায় হাজার দেড় হাজার লোক পূজায় আমাদের বাড়ি এসেছে। নাড়ু খেয়েছে। যারা নাড়ু খেয়েছে তাদের অধিকাংশ হামলার দিনেও উপস্থিত ছিল। চেয়ারম্যান বনকুমার শিবের বাড়িটি দোতলা। গত সোমবার তার ভাতিজার বিয়ের আশীর্বাদ হওয়ার কথা ছিল। এ উপলক্ষে চেয়ারম্যানের বাড়িতে লক্ষ্ণীপূজার দিন থেকেই আত্মীয়স্বজন জড়ো হয়েছিলেন। দুদিন ধরে বাড়িতে বিয়ের আনন্দ। রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে তারা সবাই খেতে বসবেন। ওই সময়ই 'তৌহিদী জনতার' মিছিল চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে। খবরটি জেনেই খাবার বন্ধ। সব মহিলা ও শিশুকে দোতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আক্রমণকারীরা দোতলায় উঠবে প্রতিবেশী শফিকুল ইসলাম ফাঁকফোকর দিয়ে দোতলায় উঠে যান। সেখানে তিনি সব হিন্দু মহিলাকে হাত থেকে শাঁখা খুলে ফেলতে বলেন। কপালের সিঁদুর মুছে দেন। আক্রমণকারীরা উপরে উঠে মহিলাদের মারতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ওরা মুসলমান। চেয়ারম্যানের কাছে কাজে এসেছিল। ওদের তোমরা মেরো না। তখন আক্রমণকারীরা মহিলাদের মারল না বটে, তবে তাদের গায়ে থাকা সোনার গহনাপত্র নিয়ে যায়। এ সময় তারা প্রত্যেকটি কক্ষ ভাংচুর করে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় চলে যাওয়ার সময় পাশের একচালা টিনের ঘরেও হামলা চালায়। সেখানে চেয়ারম্যান বনকুমার শিব একটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন-গত তিন বছর ধরে তারা ওই বাড়িতে আশ্রিত। পৈতৃক জমি বিক্রির সাত লাখ টাকাও ছিল তাদের কাছে। রেখেছিলেন ঘরের ভিতরে একটি ড্রয়ারের মধ্যে। আগামী শীতে নিজস্ব জমিতে তাদের ঘর তোলার কথা ছিল। আগুনে তাদের সাত লাখ টাকাই পুড়ে গেছে। সব হারিয়ে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া গোপনে দেবনাথ বলেন, বাবা, আমার নামটা একটু লেখ। যদি কোনো সাহায্য পাই। আমার তো কিছুই নাই। পরদিন ৫ নভেম্বরের ভোরের কাগজের ফলোআপ খবর পরিবেশন করেন ওই দুজন সাংবাদিক। 'মুরাদনগর তান্ডবে অংশ নেয় ১০ গ্রামের লোক' শিরোনামে প্রকাশিত ওই খবরে লেখা হয়- নেতাকর্মীদের কেমন যেন গা ছাড়া ভাব। তবে আক্রান্তদের মনোবল চাঙ্গা করতে আসবেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার। তার সঙ্গে থাকবেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলে জানা গেছে। আক্রান্ত হিন্দুদের অনেকেই গত বুধবার বলেছেন, হামলায় পার্শ্ববর্তী ১০ গ্রামের লোকজন অংশ নিয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে মুরাদনগরের ডালপাড়, জানঘর, হীরাপুর, খোশঘর, এলখলি, ফুলঘর, বাড়েস্বর, কসবা, পান্ডুঘর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ সব এলাকার লোকজনকে রোববার সকাল থেকেই কোরবানপুর বাজারের পাশের একটি এতিমখানায় এনে রাখা হয়। এদিন দুপুরের ওই এতিমখানায় ভালো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। এরপর এরা মিছিল নিয়ে বের হয়। এই মিছিলে যোগ দেয় আগে থেকে চলতে থাকা জামায়াতে ইসলামীর লোকজন। এরপরই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। আগের রাতে মুরাদনগরের কোরবানপুর বাজার লাগোয়া বাড়িতে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আবদুল আবিদ এলাকাবাসীদের নিয়ে মিটিং করেন। পরদিন রোববার দুপুরে কাউসার নামে একজন মাইকিং করে জমায়েতের ডাক দেয়। সেই জমায়েত থেকে মিছিল নিয়ে পূর্বধৈল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বনকুমার শিবের বাড়িসহ স্থানীয় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়। ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের কোনো নেতাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি বলে জানা যায়। কোরবানপুরের বাসিন্দারা জানান, আক্রমণকারীরা প্রথমেই হামলা চালায় শংকর মাস্টারের বাড়িতে। সেখানে আগুন দেওয়ার পর পরই গ্রামবাসী ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। যদিও 'তৌহিদী জনতা'র বাধার মুখে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি। হামলার খবর পেয়ে তিন গাড়ি পুলিশও আসে। কিন্তু তান্ডবলীলা দেখে বাজারের এক কোণায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। এখন দেখা যাচ্ছে, এই মুরাদনগরই আজকের বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। জামায়াতের ষড়যন্ত্রে, বিএনপির মদদে ঘটনাটি গ্রামবাসীর একাংশ এবং আরও ১০ গ্রামের দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েও থাকেন আওয়ামী লীগ নীরব কেন? তাদেরও মদদ ছিল এমনটি মনে করা কি ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় অস্বাভাবিক বলে আদৌ মনে হবে। ঘটনার দিন তারা যাননি, যাননি তার পরদিনও। সুতরাং ধারণাটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর ওই হিন্দুরা দেশত্যাগী হলে তো তাদের লাভ। বাড়িঘর জমিজমা দিব্যি দখল করে নেওয়া যাবে। আর পুলিশ? পুলিশও কি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মজা দেখলেন? দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ না করে, গ্রেপ্তার না করে সন্ত্রাসীদের মতো হিন্দুবাড়ি পোড়ানোর ও লুটপাট না থামিয়ে 'ছওয়াবের' ভাগিদার হলেন? এ দেশে থাকতে হলে কি বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের শাঁখা সিঁদুর খুলে ফেলে দিতে হবে। হিন্দুদেরও অঙ্গচ্ছেদ করতে হবে? এর অর্থ, মুসলমান হও। থাকল কি নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা? সর্বশেষ খবরে জানা গেল, ওই গ্রামের হিন্দুরা নিরাপত্তাবোধ এবং প্রাণে বাঁচার নিশ্চয়তার অভাবে দলে বলে গ্রাম ছেড়ে কুমিলস্না শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বাড়িতে ফিরতে পারল কি আদৌ? গ্রামে যদি ফিরিয়ে আনাও হয় বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ ও রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা ফিরবে? মুরাদনগরই আসল বাংলাদেশ। রণেশ মৈত্র : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত