মানবতা ও মানবসভ্যতার সংকট রোহিঙ্গা ও বিশ্ব প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা চলমান অস্থিরতায় ও অপব্যবস্থার মধ্যে হারিয়ে না গিয়ে স্থিতধী হয়ে কাজ শুরু করলে অবশ্যই সুফল দেখা দেবে। শুধু চিন্তা দিয়ে হবে না, চিন্তার সঙ্গে কাজও লাগবে, সংঘশক্তি লাগবে। প্রত্যেক জাতির এবং গোটা মানবজাতির অভীষ্ট নতুন ভবিষ্যতের জন্য আথর্-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নতির মমের্ নৈতিক উন্নতি লাগবে। নিকৃষ্ট নৈতিক চেতনা দিয়ে তা হবে না। আথর্-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির জন্য একসঙ্গে আন্দোলন শুরু করা আজ সময়ের মূল দাবি।

প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা আজ উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সন্তান। মিয়ানমারের মাটি রোহিঙ্গাদের মাটি। আমরা কেন অন্যের সন্তানকে লালন করব? হ্যঁা, তবে বিশ্ব সন্তান হিসেবে বিশ্বের বিবেক কেন জাগ্রত হচ্ছে না। এর সমাধানে এখনো কোনো কাযর্কর পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না। এ প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যের অসুবিধা বা ভোগান্তি বাড়বে তা কখনই কাম্য নয়। আমাদের দেশে আমরাই হাজার সঙ্কটের মুখে আবতির্ত হচ্ছি। ৫৬ হাজার বগর্মাইলের এই দেশে আমরা ১৬ কোটিরও বেশি মানুষ ঠাসাঠাসি অবস্থায় বসবাস করছি। অধিকন্তু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের চাপ। তাদের আবাসন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখার মতো সামথর্্য আমাদের কতটা আছে তা বিবেচ্য বিষয়। এই উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী যখন তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণে বেসামাল হয়ে যাবে, তখন তারা বিভিন্ন অন্যায়, অনৈতিক, অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে অন্যায়, অশালীন ও অযাচিত উপায়ে জীবনাচরণে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হবে। বেঁচে থাকার জন্য হয়তো বা যে কোনো ঘৃণ্য পন্থা বেঁছে নিতে দ্বিধা করবে না। সময়ান্তরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু জনগণ কাজের খেঁাজে বেঁচে থাকার তাগিদে হন্যে হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। এটা কোন অসভ্যতা? একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ সভ্যতার চ‚ড়ায় অবস্থান করেও মানুষ আদিম, অবস্থান থেকে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি ও তামাশা করে যাচ্ছে। মিয়ানমার কতৃর্পক্ষ আজ নিলের্জ্জর মতো। তারা মানবতর ও ইতর প্রাণীর চেয়েও বোধ বিবজির্ত নিকৃষ্ট বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তারা তাদের নিজের মানুষের প্রতি এমন বৈরী আচরণ করবে তা ভাবতে পারার মতো নয়। কেননা, ধমর্-নীতি, মতভেদ কিন্তু মানব ধমের্র কাছে এতটা গুরুত্ব পায়নি। তাই মানব ধমের্ক ও মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ, বিদূরিত করে মনের পশুত্বকে পরিহার করে সভ্যতার লালন করতে হবে। মিয়ানমার কতৃর্পক্ষ ও শাসক দলের কাছে বাঙালি ও বিশ্ব বিবেকের এটাই প্রত্যাশা। মিয়ানমারের সচেতন, সভ্য ও সুশীল সমাজের কাছে আমাদের নিবেদন আশা করি প্রত্যাখ্যাত হবে না। তারা হয়তো বা তা সহানুভ‚তি ও সহনশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখবেন। আর যদি না দেখেন তাহলে তো মানবতা ও বিশ্বসভ্যতা বিচ‚ণর্ হবেই। অন্যায়, অবিচার ও জুলুম প্রতিষ্ঠা পাবে, অশান্তি, অরাজকতা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। অসাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি, নাশকতা ও রক্তপাত বৃদ্ধি পাবে। বিভেদ ও বৈষম্য বাড়বে। জাতিগত দাঙ্গায় সমাজকাঠামো নষ্ট হবে। এই অনাচার যদি কেউ লালন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বের শান্তিকে হুমকিতে ফেলানোর কারও কোনো অধিকার নেই। জাতিসংঘ এই অবমাননা কতকাল বহন করে চলবে। সারা দুনিয়ার জনসাধারণ আজ ঘুমন্ত; তবে জাগ্রত ও ভীষণভাবে সক্রিয় আছে বিশ্বায়নবাদীরা। তারা সংকট বাড়িয়ে চলছে। দুনিয়াব্যাপী শুভবুদ্ধি আজ দুবর্ল, পরাজিত, নিযাির্তত, অসহায়; আর অশুভবুদ্ধি বিজয়ী। বিজয়ী ও পরাজিত উভয় মহলেই আজ মানবতা লাঞ্ছিত। প্রতিযোগিতা চলছে লোভীর সঙ্গে লোভীর ব্যক্তিপযাের্য়ই হোক আর সমষ্টিপযাের্য়ই হোক। মানবজাতি আজ সভ্যতাবিমুখ, প্রগতিবিমুখ, ন্যায়বিমুখ ও অদূরদশীর্। অত্যন্ত দ্রæত যন্ত্রের গতিতে চলছে কিংবা চলতে বাধ্য হচ্ছে সবাই; এতে কোনো বিচার-বিবেচনা নেই। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি এই ঝেঁাক, বলতে দ্বিধা নেই, সেকালের প্রায় সব লেখকের মধ্যেই লক্ষ্য করেছি আমরা। পশ্চাৎপদ ভারতীয়রা ঔপনিবেশিক শাসকদের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যতই তারা শিক্ষিত হতে থাকেন, ততই বুদ্ধিবৃত্তিক মোহাচ্ছন্নতা কাটিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এরকম একটা সময়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হুমায়ুন কবির সেই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, রবীন্দ্রনাথ যখন জন্মেছেন তখন হচ্ছে সেই সময়, যখন পশ্চিমের সম্মোহনের প্রথম দশা কেটে গিয়ে সমানুপাতিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠার পথে। যেসব আদশর্ এ দেশে আনীত হয়েছিল সেগুলো তখনও সক্রিয় ও প্রবল ছিল; কিন্তু সে সঙ্গে ভারতবষের্র নিজস্ব উত্তরাধিকারের মূল্যবোধগুলোর স্বীকৃতিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। রবীন্দ্রভাবনারও বিবতর্নও ঘটেছিল এ পথে।’ সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটিকে রবীন্দ্রভাবুকতার চমৎকার ধারাভাষ্য বলে উল্লেখ করে বলা যায়। ইতালীয় মাকর্সবাদী ভাবুক অ্যান্তোনিও গ্রামসি তার ‘জেলখানার নোটবুক’-এর এক জায়গায় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের তিনটি স্তর ছিল বলে উল্লেখ করেছেন: সূচনা পবর্, কৌশলী পবর্ এবং অজের্নর পবর্। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধিতা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠিক এভাবেই অগ্রসর হয়েছিলেন। ইতিহাস পযাের্লাচনায় দেখা যায় পাকিস্তানি হায়েনারা যখন বুঝতে পারে যে, তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী তখন তারা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মেতে ওঠে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে বুদ্ধিশূন্য জাতি হিসেবে ভবিষ্যতে বাঙালিরা মাথা উঁচু করে দঁাড়াতে না পারে। বিষয়টি বাঙালি হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পারল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনায়। পঁচাত্তর-উত্তর এ দেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতনে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও মোটামুটিভাবে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মুক্তিবুদ্ধিচচার্র বদলে শুরু হয় দলীয় গীত রচনার মহোৎসব। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপিঠগুলোয় বুদ্ধিজীবীশূন্যতা ও পরে বুদ্ধিজীবীদের দলীয় সংকীণর্ রাজনৈতিক চেতনা ও পদ-পদবির আশায় দলবাজির সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি চিন্তার দ্বার সংকীণর্ হয়ে যায়। ডাকসু, রাকসু কিংবা চাকসু এক সময় বিবেচিত হতো ছাত্র রাজনীতির বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির কারখানা, তা কালের বিবতের্ন তার অবস্থান থেকে সরে এসে জরাজীণর্ ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির সংকীণর্ চেতনার বীজ রোপিত হয়েছে। ছাত্ররা নিজ স্বাথর্ কিংবা অধিকার অজের্নর আন্দোলনের চেয়ে দলীয় স্বাথের্র আন্দোলনকে অনেক বড় করে দেখে অথচ বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ও সংস্কৃতি। মনে রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা কিংবা মুক্তসংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে জাতি গঠিত হয়। জাতির চেতনা মূল্যবোধ কিংবা সংস্কৃতি উন্নত ও শানিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নত সংস্কৃতির বিকাশের প্রেক্ষাপটে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি সংকীণর্ চিন্তায় কিংবা দলবাজির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় তাহলে জাতির সংস্কৃতির বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়বে। জাতির সংস্কৃতির বিকাশ যদি পরিপূণর্ভাবে না হয় তাহলে ওই জাতির কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট হলো একটি সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ শিক্ষানীতি প্রবতের্নর অভাব। বাংলাদেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা চলমান অস্থিরতায় ও অপব্যবস্থার মধ্যে হারিয়ে না গিয়ে স্থিতধী হয়ে কাজ শুরু করলে অবশ্যই সুফল দেখা দেবে। শুধু চিন্তা দিয়ে হবে না, চিন্তার সঙ্গে কাজও লাগবে, সংঘশক্তি লাগবে। প্রত্যেক জাতির এবং গোটা মানবজাতির অভীষ্ট নতুন ভবিষ্যতের জন্য আথর্-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নতির মমের্ নৈতিক উন্নতি লাগবে। নিকৃষ্ট নৈতিক চেতনা দিয়ে তা হবে না। আথর্-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির জন্য একসঙ্গে আন্দোলন শুরু করা আজ সময়ের মূল দাবি। পাশ্চাত্যের এক চিন্তাবিদ মাছের মতো সঁাতার কাটা আর পাখির মতো আকাশে ওড়ার স্বাধীনতা মানুষকে না দিয়ে জাগতিক সুখকে বিসজর্ন দেয়ার কথা বলেছেন। চিন্তাবিদের এ ধরনের বক্তব্যের পিছনে যৌক্তিকতা যতটুকু আছে তার চেয়ে জীবনের অস্তিত্বের স্বাথের্ অযৌক্তিকতার পরিমাণটা বেশি। কারণ অন্যান্য প্রাণী আর গাছ-গাছালির মতো মানুষ একই শ্রেণিভভুক্ত হতে পারে না। মানুষের ভেতর আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রতিশোধের নেশা, না পাওয়ার হাহাকার আর কু-প্রবৃত্তি থাকে যা পাশবিক পযাের্য় নিয়ে গেছে। হাত দিয়ে আপনি যা খুশি করতে পারেন না। মুখ দিয়ে আপনি খেয়ালখুশি মতো কথা বলতে পারবেন না। মুখের কথার কারণে জগতে লাখ লাখ লোক মরার ঘটনা আছে। আবার মুখের কথায় মানুষকে সভ্যতার শীষের্ নিয়ে যাওয়ার রেকডর্ আছে। তবে অনুশাসনের মধ্যে কিছু অনুমোদনও দিতে হয় নইলে মানব জীবন অসহায় হয়ে পড়ে। তবে সেটা যদি মানবের জন্য বেশি অকল্যাণকর হয় তাহলে পূবার্বস্থায় ফিরে যাওয়াই ভালো। জবাবদিহিতা এবং শাস্তির ভয়ে মানুষ মূল্যবোধ লালন এবং ইন্দ্রিয় সংযম করতে বাধ্য হয়। আর মানুষের যদি জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে অতি কতৃর্ত্ব ও ভোগের আশায় যা খুশি তাই সে করবে। জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতা ও মানবসভ্যতায় আরও সচেতন হয়ে কাযর্কর ও কঠিন পদক্ষেপ নেবেÑ এ প্রত্যাশা জনগণের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বিগত দিনে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিষয়ে ভ‚মিকা রেখেছেন। এবারও তিনি সাবলীল ও বলিষ্ঠচিত্তে মিয়ানমারের উদ্যত্যের বিরুদ্ধে জোরালো ভ‚মিকা রাখবে। জাতির পিতার সুযোগ্য সন্তান ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জনগণ তাই প্রত্যাশা করে। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক