নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

শাহারিয়ার বেলাল শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
২৫ নভেম্বর পালিত হলো নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণ দিবস। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে ৩ জন নারী নির্যাতিত হয়। এ ঘটনার স্মরণে ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে প্রথম ল্যাটিন আমেরিকায় নারী অধিকার সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে নির্যাতনবিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘ 'নারী নির্যাতন দূরীকরণ ঘোষণা' প্রকাশ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন করে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দূরীকরণ দিবস' হিসেবে গ্রহণ করে। সেই থেকে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। 'নারী' দুই অক্ষরের এ শব্দের মধ্যেই রয়েছে অপরিসীম ক্ষমতা। আমাদের সমাজের অর্ধেক অংশ ধারণকারী, একটি উন্নত দেশের কারিগর হিসেবে যারা পরিচিত তারা যখন সমাজের একশ্রেণির বিকৃতমনা মানুষের হাতে নির্যাতিত হয় সেটি হয়ে যায় চিন্তার কারণ। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পোষণ ও শালীনতা রক্ষা করে চলা সৎ চরিত্রের অন্যতম গুণ। সাধারণভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে পুরুষ কর্তৃক নারীদের কোনো না কোনো প্রকারে কষ্ট দেওয়াকে বোঝায়। ব্যাপক অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে নারীদের ওপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বোঝায়। নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেওয়া বা কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের অন্তর্গত। সার্বজনীন নারী অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনমূলক অপরাধ নারী নির্যাতন। ধারণাগতভাবে এটি আবার নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন এবং নারীর সঙ্গে অপব্যবহার ইত্যাদিও বোঝায়। এটি সমাজে মহিলাদের প্রতি অমানবিক ও অনৈতিক আচরণের মধ্যেও প্রকাশ পায়। সহিংসতার শিকার নারী বা পুরুষ উভয়েই হতে পারে। আবার নারী বা পুরুষ বা উভয়ের দ্বারা সহিংসতা সংঘটিত হতে পারে। সাধারণত সবশ্রেণির পুরুষই সহিংসতার শিকার হন না; কিন্তু সব শ্রেণির নারীই সহিংসতার শিকার। যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন হচ্ছে নারী-সহিংসতার অন্যতম দিক। জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ নারী তাদের জীবনে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ হয় তাদের পরিবারের বা খুব কাছের সদস্য দ্বারা। পারিবারিক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ঘটনা হচ্ছে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। নারীদের নির্যাতিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যৌতুক। যদিও আমরা ঘটা করে প্রচার করছি যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া দুটিই অপরাধ। কিন্তু আমাদের প্রচার-প্রচারণা আদৌ সুফল বয়ে আনছে কি? না এখনো কোনো সুফল পাইনি। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অসংখ্য নারীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। তা ছাড়া এ সব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতনও নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীব্যাপী এ সব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃতু্য হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে। দেখা যায়, সমাজের শিক্ষিত, সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষ দ্বারাই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। সারা বিশ্বে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীরা একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এ নিয়ে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি হয়েছিল আলোড়ন। এ আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছিল #মি টু। কিন্তু কতখানি ফলপ্রসূ এ আন্দোলন? প্রশ্ন থেকেই যায়। সফলতা পাওয়া গেলেও তা সম্পূর্ণ কি? সঠিক উত্তর পাওয়া কষ্টসাধ্য। বরং দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনকারীরা প্রভাব ও প্রতিপত্তির কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। নারীর ওপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সাম্প্রতিককালে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। নারীর ওপর সহিংসতার আরেকটি কারণ, তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। নারী নিজ পরিবারেও নির্যাতিত হচ্ছে। পরিবার পেরিয়ে বাইরেও নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের। অনেক নারী চাইলেও নিজ পরিবারের কাছেও সহিংসতার কথা বলতে পারেন না। দেখা যায়, অনেক সময় পরিবারই নির্যাতিত নারিকে দোষী সাব্যস্ত করে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীই এ সব অত্যাচার সহ্য করেন বাধ্য হয়ে। নারী নির্যাতনের মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে বিরামহীনভাবে চলছে ধর্ষণ। একের পর এক লোমহর্ষক খবর সবাইকে অস্থির করে দিচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদ্রাসায়ও ধর্ষণসহ নানা কায়দায় চলছে নারী নির্যাতন। শিক্ষকতার মহান দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিও নাম লেখাচ্ছেন ধর্ষকের খাতায়। মানুষের আস্থার জায়গা বলে কিছু থাকছে না। পবিত্র শিক্ষাঙ্গন আজ অপবিত্র। নিজের ঠিকানা, নিজের ঘর পর্যন্ত কলুষিত। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যা ভাবাও যায় না, লিখতেও হাত কাঁপে। ধর্ষণ-নির্যাতনের কটি খবরই বা মিডিয়ায় আসছে? বহু মা-বোন লুকিয়ে রাখছে তাদের নির্যাতনের খবর। অনেক অসহায় ধর্ষিতা নীরবে নিভৃতে কাঁদছে বছরের পর বছর। নারীর প্রতি ধর্ষণ-নির্যাতন মহামারির রূপ নিয়েছে। যে কোনো মূল্যে এ অবস্থা থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে হবে, বাঁচাতে হবে জাতিকে। কারও একার পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই সবাই মিলে নিতে হবে সমন্বিত ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ। একজন নারী শুধু শারীরিকভাবেই কিন্তু সহিংসতার শিকার হয় না। বরং প্রতিনিয়ত মানসিকভাবেও সমাজে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে নারীকে হেয় করা হচ্ছে। নারীদের প্রতি এ বিদ্বেষমূলক যে আচরণ, তার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সেটা আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে শুধু আন্দোলন নয়, নারীর প্রতি এ সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বে নারীর অধিকার আদায় নিয়ে কাজ করছে এমন অনেক সংগঠন রয়েছে। শুধু সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করাই কাজ নয়, সহিংসতার শিকার প্রতিটি নারীকে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নারীর প্রতি যে মূল্যায়ন, তা বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। পারিবারিকভাবে এ বিষয়গুলোতে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে মানুষের মানবিক দিকগুলোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব গণপরিবহণে নারীদের যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে যে সব হটলাইন কাজ করে, সেগুলোর কার্যক্রমকেও সঠিক নীতিমালায় আনতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষের যে সচেতনতামূলক অংশগ্রহণ, সে বিষয়েও এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, নারীর প্রতি এ সব সহিংসতা ঘটাচ্ছে সমাজের পুরুষরাই। তাদের সচেতন না করে আমরা কখনোই এ বিষয়ে গোটা সমাজে বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনতে পারব না। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনই নারীদের জন্য সমাজে একটি নিরাপদ স্থান গড়ে তুলতে পারে। ফলে, রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ের নারী-পুরুষকে সমন্বিতভাবে নারীর প্রতি সহিংসতামূলক আচরণ বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সবার জানা উচিত যে নারী-পুরুষের এই যে বৈষম্য, সেটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই আলোচনার বিষয় নয়, বরং সারা বিশ্বে এখন নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রতিটি দেশ, সমাজ ও সংস্থা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে চলেছে। নারীর লড়াই এখন শুধু নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে নয়, বরং মানুষের গোঁড়ামি, একগুঁয়ে নিয়মকানুনের বিরুদ্ধেও এখন নারীকে লড়াই করতে হয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়। কেননা, ছোট-বড় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের জন্য এখন নারীর অধিকার রক্ষায় শুধু নির্ধারিত ইসু্য নয়, বরং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে যে সব সংস্থা কাজ করে, তাদের একই নীতিমালা অনুসরণ করে একই লক্ষ্যে সব সময় অবিচল থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার গড়ে তোলা জরুরি। এখানে নারী সদস্যরা সহিংসতার ব্যাপারে সাহায্য করবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার কাজ করছে। নারীদের জন্য যে সব সেবার ব্যবস্থা করেছে, সেগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য গণমাধ্যমই পারে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। এ সব সেবাই তাদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রামপর্যায় থেকে শুরু করে সংসদেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নারী ও শিশুবিষয়ক উন্নয়ন কমিটি আছে। এ কমিটিগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। জনগণ যেন তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ব্যক্তি থেকে সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। এ ক্ষেত্রে নিজে নির্যাতন থেকে দূরে থাকলেই চলবে না, সেই সঙ্গে আমাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া যে কোনো নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।