সোশ্যাল মিডিয়ার কবল থেকে তরুণদের রক্ষা করা উচিত

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

মহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
বর্তমান সময়ে পৃথিবীকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে যে প্রযুক্তি তার নাম দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া। আমরা যাকে ফেসবুক নামে চিনি এটাই একটি সোশ্যাল মিডিয়া। এ রকম আরও অনেক সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে যেমন- টুইটার, মাইস্পেস, গুগল পস্নাস, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি। এই সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের পুরনো সেই দিনগুলোর কথা ভুলিয়ে দিয়েছে, যে কোনো এককালে আমরা চাইলেই আমাদের প্রিয় জনের খোঁজ নিতে পারতাম না। আজ আর সেইসবপ্রাণ নেই। মানুষ সেই দিনগুলোকে মনেও করে না খুব একটা। কারণ নিত্য-নতুন প্রযুক্তি আমাদের সবকিছুকেই আপন করে দিয়েছে। বর্তমানে খুব কম বয়সেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেন বেশিরভাগ তরুণ। আর এ কারণেই সেই সব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ফলে তরুণদের মাঝে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে তা অপূরণীয়। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালে মানুষ যখন গৃহান্তরীণ এবং শরীরী যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজ জীবনকে সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। তাই করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপকহারে প্রচার-প্রচারণায় তরুণরা এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। তাই এর প্রভাবটাও ব্যাপকহারে পড়ছে। স্কুল-কলেজের বাইরেও ভার্চুয়াল জগতে হাজার হাজার বন্ধু হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় কার কত বেশি বন্ধু, কার ফলোয়ার বেশি বা কার পোস্টে কত লাইক এইসব নিয়ে চলে নানা প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে তারা যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করে, তখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করে এবং অধিক সময় রাত জাগে। অনেকেই রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকে ফলে পড়াশোনায় অমনোযোগ, ঘুম নষ্ট, খিটখিটে মেজাজ, বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্ক করার প্রবণতা, কারও সাথে কথা না বলা বা অসামাজিক হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। অতিরিক্ত সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে স্কুল-কলেজে যেতে চায় না, পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারে না। এভাবে তাদের সৃজনশীলতার সক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। যার দরুন পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়। ফলে তাদের মানসিক চাপ আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা নিজেদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। সোশ্যাল মিডিয়া তরুণ-তরুণীদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়। প্রায় ৯০ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্কদের সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্তত একটি প্রোফাইল আছে।? সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বা ফটো পোস্ট অথবা শেয়ার করা যায়; যোগাযোগ খোঁজা যায়; বন্ধু-বান্ধবদের প্রোফাইল দেখা যায়; নানা ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া যায়; চ্যাট করা যায়; মেসেজ পাঠানো যায়; গেমস খেলা যায়? সবচেয়ে বড় কথা, বাস্তব জীবনে বন্ধু-বান্ধব খুঁজতে যত সময় লাগে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোয় তার চেয়ে অনেক সহজে একটা বড় 'ফ্রেন্ডস সার্কল' গড়ে তোলা যায় এর ফলে খুব সহজেই একে অপরের খুব কাছে আসা যায়। অপরদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণ-তরুণীদের জন্য ফাঁদ পেতে বসে থাকে কিছু অসাধু মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তরুণরা অলস হচ্ছে, কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণরা সমাজে ভালো-মন্দ দু'ধরনের ভূমিকাই রাখছে।?তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দিনের খুব বড় একটা সময় এই মাধ্যমে ব্যস্ত থাকায় তরুণদের অলসতা বাড়ছে তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। তরুণরা অনবরত ব্যবহার করে চলেছে ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া। কিছুসংখ্যক অভিভাবক শিশুদের এই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারটিকে খুব হালকাভাবে নিচ্ছেন। তো কিছুসংখ্যক অভিভাবক একেবারেই এর বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন। অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে তরুণদের আচার-আচরণ অনেক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে শিষ্টাচার, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের রীতিমতো চরম অবক্ষয় হচ্ছে। অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে তরুণদের মনে খারাপ চিন্তার উদ্রেগ ঘটে যা তাদের অপরাধের দিকে ধাবিত করে। আবার, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাতপ্রবৃত্তি। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন মেয়ে বন্ধু পাওয়া যায়, তেমনি ছেলে বন্ধুও। তাদের এই পারস্পরিক আলাপচারিতা ও যোগাযোগের ফলে তাদের আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে এক অবৈধ সম্পর্কের। আর সেই অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও বা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে পরবর্তীতে বস্ন্যাকমেইলের মতো ঘটনা ঘটে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত এমন অনৈতিক সম্পর্কের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার এই কবল থেকে রক্ষা করতে সন্তানের হাতে স্মার্ট ফোনের বদলে সাধারণ ফোন দেয়া উচিত। নয়তো ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন দেবেন না। এতেও না হলে ডেটা প্যাকের নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিন। ইউটিউবের কনটেন্টেও বিধিনিষেধ আরোপ করুন। বাবা-মায়েদের চেয়ে স্মার্ট ফোন সম্পর্কে তারা বেশি জানে। সুতরাং আপনাকেও অনেক সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। নিজেরা সন্তানদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান। একসঙ্গে সিনেমা হলে যান, কফিশপে গিয়ে আড্ডা দিন। ক্যারিয়ার তৈরির জন্য এই বয়সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওদের ক্যারিয়ার গড়ার দিকে আগ্রহী করে তুলুন। সন্তানকে সাহায্য করুন। বন্ধুদের বাড়িতে এনে গল্পগুজব করতে বলুন। বই, খবরের কাগজ পড়ায় উৎসাহ দিন। ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ক্রিকেট, সাঁতার ইত্যাদির প্রতি উৎসাহ বাড়াতে পারেন। এগুলো তাদেরকে মোবাইল থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবে এবং অনেকখানি সামাজিকও করে তুলতে সাহায্য করবে। অতিরিক্ত পর্যায়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আকৃষ্ট হয়ে থাকার ফলে তরুণরা বন্ধুশূন্যতায় ভুগতে পারে। অনলাইনে হাজার বন্ধু থাকা সত্ত্বেও সামনা সামনি কথা বলার জন্য যদি কাউকে না পাওয়া যায়, তবে সেই বন্ধুত্বের কোনো মূল্য নেই। এর ফল হিসেবে হীনম্মন্যতায় ভোগা, একাকিত্বের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার মতো ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। তাই আমাদের উচিত সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরের যে জগতটি আছে, তার সাথে তরুণদের আরও বেশি যোগাযোগ সৃষ্টি করানো। সোশ্যাল মিডিয়া বলি বা যে কোনো কিছু যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, তার কিছু নেগেটিভ দিক তো থাকবেই এবং ব্যবহারকারীরা যদি সে সব দিক সম্পর্কে সতর্ক না থাকে, তাহলে জনপ্রিয় মাধ্যমগুলো জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে খুব সহজে। এছাড়া নষ্ট হয়ে যেতে পারে নিজের সাজানো জীবন! তাই সব ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। আমি বলব, আমরা যদি আমাদের আকাশসীমাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। ভালো জিনিসই শুধু আমরা তরুণদের ঢুকতে দেব, খারাপগুলো ঢুকতে দেব না?তাহলে অনেক কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। বাজে ওয়েবসাইট ঢুকতে নিরুৎসাহিত করব।? কিছু নিয়মনীতি যদি থাকে, মিডিয়াতে অন্যকে অপদস্থ করা যাবে না।?কেউ কিছু করলে তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে? কিন্তু হুট করেই সামাজিক যোগাযোগে কিছু বলা যাবে না।? যেমন ধরুন, রাজন হত্যার বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই জনমত গড়ে উঠেছে।?খারাপ জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয় থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক সময় তরুণরা এমন সব ওয়েবে প্রবেশ করে, যা পেশাদার নারী-পুরুষের রঙ্গলীলায় ভরপুর রয়েছে। ফলে তাদের বাস্তব জীবনে জৈবিক চাহিদা বিকৃত হচ্ছে এবং মানসিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সমাজের নিকৃষ্ট কাজ করতেও তাদের মনে কোনো দ্বিধার সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে তাদের দ্বারা সমাজে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়। আমাদের তরুণ সমাজকে এসব অপরাধ এবং অবক্ষয় থেকে বাঁচাতেও রুখতে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি এবং মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার থেকেও দূরে রাখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাছাড়া আমাদের সাইবার আইনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরী করে তুলতে হবে। সর্বোপরি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তরুণ সমাজকে উপরোক্ত কাজগুলো থেকে বিরত রাখা সম্ভব।