মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ

সার্বিক বিবেচনায়, মিয়ানমারে নতুন সরকারের আমলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকেই গ্রহণ করতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জাতিগত নিধনের চিত্র তুলে ধরে আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে।

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

হাফিজুর রহমান
মিয়ানমারের রাজনীতিতে উর্দিপরা জেনারেলদের হস্তক্ষেপের ইতিহাস দীর্ঘ। দেশটিতে গণতন্ত্রের সংকট ও বছরের পর বছর সামরিক শাসনের জাঁতাকলে জনগণকে পিষ্ট করে রেখেছিল সেনাবাহিনী। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হলেও ১৯৬২ সালে মিলিটারি কু্যয়ের পর দেশটি সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। শুরু হয় উর্দিপরা জেনারেলদের আধিপত্য বিস্তারের খেলা। ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে সেনা শাসন অব্যাহত ছিল। যদিও ১৯৯০ সালে বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক স্রোতের ধাক্কা লেগেছিল দেশটিতে। সেই সুবাদে একটি অবাধ, সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ৩৯২টি আসন পেয়ে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সামরিক জান্তা নির্বাচনী ফলাফলকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে সু চিকে ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করে দেয় ও গৃহবন্দি করে এবং 'স্টেট পিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল'-এর মাধ্যমে দেশ পরিচালনা শুরু করে। অতঃপর ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক উপায়ে সবার অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে প্রায় ৫০ বছরের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চিত্র লেপ্টে রয়েছে মিয়ানমারে। বর্তমানেও এর ছাপ পুরোপুরি বিলীন হয়নি। ফলে উদার গণতন্ত্রের মূল উপাদানগুলোর দেখা মেলেনি মিয়ানমারে। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির পার্লামেন্টের ৭৫ শতাংশ আসন পূর্ণ হয় জনগণের ভোটে, বাকি ২৫ শতাংশ আসন উর্দিপরা জেনারেলদের জন্য বরাদ্দ। অর্থাৎ এদিক থেকে মিয়ানমারকে বলা যায় ৭৫ শতাংশ গণতন্ত্রের রাষ্ট্র। কেননা, পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে মাত্র ৭৫ শতাংশ। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গত ৮ নভেম্বর দেশটির দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের অনানুষ্ঠানিক ফলাফল অনুযায়ী অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ৩৪৬টি আসন পেয়েছে। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২২টি আসন। প্রধান বিরোধী দল ইউএসডিপি ২৪টি আসন পেয়েছে। বাকি ৪৬টি আসনের ফলাফল এখনো স্থগিত রয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী এনএলডি দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করবে। যদিও সেনাবাহিনী সমর্থিত প্রধান বিরোধী দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রশ্ন তুলেছে। মিয়ানমারের এবারেরর সাধারণ নির্বাচনে গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক দুটি উপাদানের উপস্থিতির দেখা মেলেনি। এক, যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী পঁচিশ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত সেহেতু এখানে সরকার গঠনে সাংবিধানিকভাবে শতভাগ নির্বাচিত প্রতিনিধির অনুপস্থিতি রয়েছে। দুই, এবারের সাধারণ নির্বাচনে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সাংবিধানিকভাবে তাদের প্রাপ্ত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সার্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়নি। বহুজাতিক রাষ্ট্র মিয়ানমারে প্রায় ১৩৫টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলের পর অং সান সু চি ৩৯টি সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলকে বিজয়ী দল এনএলডির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ২০১৫ সালে দলটি ক্ষমতায় এলেও এরকম ঘোষণা এটাই প্রথম। এটা নিঃসন্দেহে একটা বহুজাতিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্বাচন থেকে দূরে এবং ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে মিয়ানমার কতটা শক্তিশালী জাতি গঠন করতে পারবে, সেটিই এখন একটা বড় প্রশ্ন। মিয়ানমারে ১৩৫টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠী থাকলেও উর্দিপরা জেনারেলদের দীর্ঘ সামরিক শাসনের আওতায় দেশটিতে শক্তিশালী জাতি গঠন হয়নি বরং জাতিবিদ্বেষ বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সব থেকে নির্মমতার শিকার ও নির্যাতনের বলি জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গারা হলো পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা জনগাষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ১৯৭০'র দশক থেকেই চলে আসছে। তখন থেকেই মিয়ানমার সরকার, সামরিক বাহিনী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গারা। অ্যামনেস্টি ইটারন্যাশনালের মতে, ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা তৎকালীন সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে। তবে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন পুলিশ ক্যাম্প ও সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে মিয়ামারের সেনাবাহিনী 'অভিযানের' নামে নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্যাতন, গণধর্ষণ ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে দেশটির সেনা সদস্যরা। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের নারী ও মেয়েদের গণধর্ষণসহ যৌন নিপীড়ন করেছে। এমনকি ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের পর নির্বিচারে হত্যাও করেছে। জাতিসংঘ রাখাইন রোহিঙ্গাদের ওপর ওই নির্যাতনকে 'এথনিক ক্লিনজিং' বলে আখ্যায়িত করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মিয়ানমারের ওই কর্মকান্ড গণহত্যার শামিল বলে সমালোচনা করছে। রোহিঙ্গাদের বর্বরতা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মিয়ানমারের 'গণতন্ত্রকামী' নেত্রী ও দেশটির কার্যত নেতা অং সান সু চিরও কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন তারা। যদিও রোহিঙ্গা জনগাষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের জন্য মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাচর্চা বিশেষভাবে দায়ী। নির্যাতন ও গণহত্যার ধারাবাহিকতার পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ মানুষ কোনো রকম জীবন বাঁচিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরই পরিপ্রক্ষিতে বর্তমানে পুরনো-নতুন মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এখনো অনুপ্রবেশের ঢল থামছেই না। সর্বশেষ, এবারের সাধারণ নির্বাচনেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় টানেনি মিয়ানমার বরং সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এখানে স্পষ্ট লক্ষণীয় যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের মূলধারার জাতিগোষ্ঠী মনে করে না এবং রোহিঙ্গা ইসু্যকে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ভাবে না। ফলে কার্যত বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে মিয়ানমারের নতুন সরকারও কোনো ভূমিকা পালন করবে না। অতএব, নির্বাচন বা নতুন সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হবে না। অপরদিকে পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর আধিপত্য ও মিয়ানমারের দোআঁশলা গণতন্ত্র বরাবরই রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। সার্বিক বিবেচনায়, মিয়ানমারে নতুন সরকারের আমলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকেই গ্রহণ করতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জাতিগত নিধনের চিত্র তুলে ধরে আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। হাফিজুর রহমান : কলাম লেখক