সুশাসনের জন্য কিছু প্রস্তাব

সরকারি নীতি সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা ও জনগণের জীবনযাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করে মিটিং মিছিল করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে কাউকে জেল-জুলুম ও অন্য কোনো হয়রানি করা যাবে না।

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

জাফরুলস্নাহ্‌ চৌধুরী
রাতে ভোট ডাকাতির দেশ হিসেবে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ পরিচিত। নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার জন্য ঘৃণা প্রকাশ এবং নীরব প্রতিবাদে সরকারি ও বিরোধী দলের সমর্থকরা নির্বাচন পরিহার করেছেন। উন্নয়নের বিপরীতে চরম দুর্নীতি, খুনখারাবি, যৌন নিপীড়ন ও কিশোর গ্যাংস্টারের দ্রম্নত বিকাশ ঘটছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ কুমিলস্না জেলায় গত ২০ বছরে অজ্ঞাত পরিচয় ২৬০০ জনের লাশ পাওয়া গেছে। মাত্রাতিরিক্ত সড়ক দুর্ঘটনা, মাদকাসক্তি বৃদ্ধি ও বিনা বিচারে হত্যা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। একটি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সরকারি কার্যালয়ে দুই বছর যাতায়াত করতে হয়। গাড়ির ফিটনেসের জন্য দীর্ঘ হয়রানি সুনিশ্চিত ও সর্বজন বিদিত। দৃষ্টি সরানোর জন্য জঙ্গি আবিষ্কার ও বিরোধী রাজনীতিবিদদের হয়রানি সরকারি শৃঙ্খলা রক্ষার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে লোকমুখে প্রচারিত ও চিহ্নিত। এ অবস্থার বিপরীতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুষ্ঠু নির্বাচনে সব নাগরিকের বসবাসযোগ্য মানবিক গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সহজে কার্যকর সম্ভব নিম্নলিখিত প্রস্তাবের দ্রম্নত বাস্তবায়নের জন্য সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ ও জনগণের সুবিবেচনা প্রসূত আলোচনা ও সমর্থন কাম্য। সবার জন্য গণতন্ত্রের সুফল মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন শাসনব্যবস্থাপনায়- কেন্দ্রিকতা নয়, ঢাকা নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় শাসন নয়, স্থানীয় জনগণ নির্বাচিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন- (ক) ক্রমে মাফিয়া রাষ্ট্রের পথে অগ্রসরমান বাংলাদেশের মূল সমস্যাকেন্দ্রিকতা এবং বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা বিভাগসহ জনসেবামূলক সব বিভাগে অপরিসীম দুর্নীতি ও জবাবদিহিতাহীনতা। ১৮০ মিলিয়ন (১৮ কোটি) জনগণের দেশকে একটি শহর থেকে নিয়ন্ত্রণ পাগলামির নামান্তরমাত্র। কেন্দ্রিকতা দুর্নীতি ও দুর্ভোগ উভয় বাড়ায়। কেন্দ্রিকতা সুশাসনের চরম প্রতিবন্ধকও বটে। এ অবসানের নিমিত্তে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে সমগ্র বাংলাদেশকে ১৭টি প্রদেশ/স্টেটে বিভক্ত করে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় জনসাধারণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ভোটে নির্বাচিত ১০০ জন সদস্যের প্রদেশ/স্টেট বিশিষ্ট সংসদ সৃষ্টি হবে সুশাসনের প্রথম পদক্ষেপ। সকল প্রদেশ/স্টেট সংসদে নূ্যনতম ২৫% নারী নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ হবে যৌক্তিক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে 'না' ভোট দেওয়ার সুবিধা অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। 'না' ভোট নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হবেন বিরোধী দল থেকে। প্রত্যেক প্রদেশ/স্টেটে কেন্দ্রীয় সরকার একজন গভর্নর নিযুক্ত করবেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সেনা ও পুলিশপ্রধান, সচিব, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী, শ্রমিকনেতা, সাংবাদিক, বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ এবং মহিলা নেত্রীরা গভর্নর পদে নিযুক্তি পাবেন। প্রত্যেক প্রদেশ/স্টেটে ১০ জনের অনধিক মন্ত্রিসভা থাকবে। এক-তৃতীয়াংশ মন্ত্রী হবেন নারী সংসদ থেকে। মন্ত্রী সভায় টেকনিকেল ক্যাটেগরিতে অতিরিক্ত মন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ সুবিধা থাকা বাঞ্ছনীয় হবে। কেবলমাত্র কেন্দ্র এবং প্রদেশ/স্টেট নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হবে। অন্যসব স্থানীয় সরকার (উপজেলা, ইউনিয়ন ও শিক্ষাবোর্ড প্রভৃতির) নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ হলে জনসেবায় আগ্রহী অধিকসংখ্যক ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন। থানা পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা ও জনগণের জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন, শিল্প, গণপরিবহণ, বয়োবৃদ্ধ সেবা প্রদেশ/স্টেটের নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্বে থাকবে। প্রদেশ/স্টেটের সব সরকারি কর্মচারী, চিকিৎসক, শিক্ষক, পুলিশ ও অন্যান্য সব বিভাগের কর্মচারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ, উন্নতি ও শাস্তির বিধান নিয়ন্ত্রিত হবে প্রাদেশিক/স্টেট পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যদের জীবনপঞ্জী জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে নিয়োগের আগে প্রকাশ করা হবে। তাদের নিয়োগ সংসদ দ্বারা চূড়ান্ত করা হবে। প্রদেশ/স্টেটের ৬০% চাকরি সংশ্লিষ্ট প্রদেশের স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। বাকি ৪০% চাকরিতে অন্য প্রদেশ/স্টেটের যোগ্যপ্রার্থীরা নির্বাচিত হবেন। প্রদেশ/স্টেটের সব কর্মচারীদের পরিবারসমেত সংশ্লিষ্ট প্রদেশ/স্টেটের কর্মস্থলে অবস্থান করতে হবে। তাদের ছেলেমেয়েদের স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে হবে। সব সরকারী চাকরিজীবীদের অবশ্যই অধূমপায়ী ও পান সেবনে বিরত থাকতে হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী, প্রকৌশলী চিকিৎসক কোনোরূপ প্রাইভেট প্রাকটিশ, কনসালটিং ব্যবসা বা কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত হবেন না। এরূপ ব্যবসায়ে যুক্ত থাকলে নূ্যনতম শাস্তি হবে ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড। দুর্নীতি ও নারী নিপীড়নে জড়িত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত সাপেক্ষে বরখাস্ত হবেন এবং সব অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। সরকারি নীতি সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা ও জনগণের জীবনযাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করে মিটিং মিছিল করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে কাউকে জেল-জুলুম ও অন্য কোনো হয়রানি করা যাবে না। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও কিশোর অপরাধের কারণ চিহ্নিত করে মৃতু্যদন্ডের ফাঁসির পরিবর্তে নূ্যনতম ১০ বছর এবং সর্বোচ্চ ৪০ বছরমেয়াদি সশ্রম কারাদন্ডের বিধান করে দেশের সর্বত্র সব নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। মৃতু্যদন্ডের পরিবর্তে ইনজেকশন দিয়ে ধর্ষককে নপুংষক বানানোর বিষয়টি আলোচনা হতে পারে। একই সঙ্গে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় মেয়েদের আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং প্রতিরোধ বিষয়ে পথনাটকের মাধ্যমে প্রচার করা হবে। রাতের গণপরিবহণে সাদা পোশাকে পুলিশ থাকবে নারী নিপীড়ন প্রতিহত করার জন্য। গভর্নর, মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিচারপতি ও উচ্চপদের সরকারি কর্মচারীদের নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ তিনজন পুলিশ প্রহরা দেওয়া হবে। ট্রাফিক পুলিশের পরিবর্তে ট্রাফিক ওয়ার্ডেন প্রথা প্রবর্তন করা হবে যৌক্তিক সড়ক শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে। উদ্বৃত্ত পুলিশদের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নে নিয়োগ করা সম্ভব হবে। (খ) কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব বিমানবন্দর, সমুদ্র ও নৌবন্দর, রেলপথ, আন্তঃসংযোগকারী জনপথ, সব জলপথ ও নদী, উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি, বৈদেশিক বাণিজ্য, দেশরক্ষা ও সামরিকবাহিনী, আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট (ঠঅঞ) ও পররাষ্ট্র নীতি-নির্ধারণ, কেন্দ্রীয় বাজেট তৈরি, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীয় অনুদানের অডিট, স্টেট গভর্নর নিয়োগ এবং চূড়ান্ত (ঞবৎঃরধৎু) স্বাস্থ্যসেবা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামান নিশ্চিতকরণ এবং উচ্চমানের গবেষণা কেন্দ্রীয় সরকারের মূল দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি দুর্নীতি মামলা দ্রম্নত নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্টে সিনিয়র বিচারপতির সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতি বছর সব রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী, বিচারপতিদের এবং ব্যবসায়ী ও করপোরেট পরিচালক ম্যানেজারদের সম্পদের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে জনসাধারণের অবলোকন ও মতামতের নিমিত্তে। সবার ইনকামট্যাক্স রিটার্ন জনসাধারণের অবলোকনের জন্য উন্মুক্ত করা হলে দুর্নীতি দমন সহজ হবে। \হসবার জন্য সাশ্রয়ী ব্যয়ে স্বাস্থ্য মাত্র ১০ (দশ) কোটি টাকা বিনিয়োগে ইউনিয়নের সব জনসাধারণকে সর্বাধুনিক চিকিৎসাসুবিধা দেওয়া সম্ভব। (ক) ১৯৯৪ সালে বিআইডিএসের গবেষণায় ড. হোসেন জিলস্নুর দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশের দরিদ্রতা নির্মূল না হওয়ার অন্যতম কারণ ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা। সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া দরিদ্রতা ও দুর্ভোগের অবসান হবে না। প্রদেশের রাজধানী ও বড় শহরের সব নাগরিকদের একজন জেনারেল প্রাকটিশনার চিকিৎসকের (এচ) সঙ্গে নিবন্ধিত করে তাদের চেম্বারে পরামর্শ ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সুবিধা ও প্রয়োজনে হাসপাতালে প্রেরণ (জবভবৎ) ব্যবস্থা প্রবর্তন আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার ভিত্তি যা প্রদেশ/স্টেট থেকে কেন্দ্রীয় রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। মূল পরিবর্তন আনতে হবে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (টঐঋডঈ)। প্রস্তাবিত প্রদেশ/স্টেটে গড়ে ৩০০ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র আছে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র প্রায় এক একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রায় সব সেন্টারে দোতলা বিল্ডিং আছে। একটি ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার। লোকসংখ্যা আগামী ১৫ বছরে ৭০ (সত্তর) হাজারে উপনীত হবে। (খ) ৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের চতুর্দিকে ৬ ফুট উঁচু নিরাপত্তা বেষ্টনী, গভীর নলকূপ ও ইলেকট্রিসিটি পুনর্নির্মাণ, চিকিৎসক, ডেন্টাল সার্জন, ফিজিওথেরাপিস্ট, ফার্মাসিস্ট, মেট্রন, অপারেশন থিয়েটার নার্স ও সিনিয়র টেকনিশিয়ানদের জন্য ১০টি ৬০০-৭০০ বর্গফুটের পারিবারিক বাসস্থান, ২০টি ১৫০-২০০ বর্গফুটের একক বাসস্থান, ২০ জন নার্সিং ও মেডিকেল ছাত্রদের জন্য ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, ডাইনিং রুমের সুবিধাসহ ডরমেটরি এবং দাঁতের চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপি বিভাগ, উন্নতমানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্যাথলজি ল্যাবরেটরি, রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র, রেডিওলজি-আলট্রাসনোগ্রাফি বিভাগ ও দুটি অপারেশন থিয়েটার সমন্বিত ৩০ শয্যার একটি হাসপাতাল ও বহির্বিভাগ নির্মাণে। হাসপাতালে ৫ শয্যার হেমোডায়ালাইসিস ও ৫ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা ব্যবস্থাও থাকবে। (গ) বাকি ৪ (চার) কোটি টাকা ব্যয় হবে অ্যাম্বুলেন্স, জেনারেটর, ৩০০ গঅ এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, নেবুলাইজার, ডিফিব্রিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর ও কার্ডিয়াক স্টেথোসকোপ, সিরিঞ্জপাম্প, ভেনটিলেটর, অ্যানাসথেসিয়ামেসিন, হেমোডায়ালাইসিস ইউনিট, বাইনোকুলার মাইক্রোসকোপ, বায়োকেমিস্ট্রি ইলেকট্রলাইট ও হেমোটোলজি অ্যানালাইজার, অটোক্লেভ, স্টেরিলাইজার, কলোরিমিটার, বয়স্ক ও নবজাতকের অ্যাম্বু ব্যাগ, পালস অক্সিমিটার, ফ্লোমিটার সমেত ২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, আধুনিক হাসপাতাল শয্যা, অপারেশন টেবিল ও থিয়েটারের উজ্জ্বল বাতি, ট্রলি ও হুইলচেয়ার, একাধিক রেফ্রিজেটর, ইনকিউবিটর, রক্তের গ্যাস অ্যানালাইজার, চক্ষু পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, রেটিনোসকোপ ও অপারেটিং মাইক্রোসকোপ, এক্স-রে সুবিধাসমেত ডেন্টাল চেয়ার এবং ছোটখাটো অন্যান্য সরঞ্জামগুলো এবং ফিজিওথেরাপির জন্য আলট্রা সাউন্ড, ইন্টার ফেরেনসিয়াল থেরাপি, ইনফ্রারেড রেডিয়েশন, ট্রাকসন ও এক্সারসাইজ যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য ২০ ধরনের ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের ল্যাবরোটরিতে ৫০ প্রকার পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। প্রায় সব ধরনের গাইনি, জেনারেল সার্জারি অর্থোপেডিকস, কান ও গলার অপারেশন এবং চক্ষু বিভাগে টেরিজিয়াম, কলোজিয়ন, ডিসিআর, ডিসিটি ও ক্যাটারেক্ট অপারেশনগুলোর অতিরিক্তও মুসলমানী (ঈরৎপঁসপরংরড়হ) ও অন্যান্য ছোট অপারেশনগুলো করা যাবে। স্বাস্থ্য সুবিধা জনগণের বাসস্থানের কাছে পৌঁছবার লক্ষ্যে সব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (টঐঋডঈ) ক্রমে প্রয়োজন সংখ্যক চিকিৎসক, ডেনটিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ফার্মাসিস্ট, নার্স, প্যারামেডিক ও টেকনিসিয়ানের সার্বক্ষনিক অবস্থান নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সম্ভব। আগামী দশ বছরে প্রত্যেক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে নূ্যনতম সার্বক্ষনিক ৬ (ছয়) জন চিকিৎসক, দুজন করে ডেনটিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ল্যাবরেটরি ও এক্স-রে বিভাগে দুজন করে টেকনিসিয়ান প্রয়োজন হবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যানকেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী চিকিৎসক হবেন উপজেলা কর্মকর্তা (টঘঙ) পদমর্যাদার। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকেন্দ্রে প্রতি বছর দুজন নবীন ইন্টার্ন চিকিৎসক এক বছর অবস্থান করে ইন্টার্নশিপ ট্রেনিং নেবেন। চিকিৎসকরা হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে চিকিৎসাসেবা দেবেন। চিকিৎসকরা পর্যায়ক্রমে কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, রক্ত পরিসঞ্চালন সহপ্যাথলজি, রেডিওলজি, সার্জারি, গাইনি, শিশু, অ্যানাসথেসিয়া, চক্ষু ও নাক-কান-গলার ছয় মাসের সার্টিফিকেট কোর্স করার সুযোগ পাবেন। এ সার্টিফিকেট অর্জনের পর তারা জুনিয়র বিশেষজ্ঞ হিসেবে অতিরিক্ত ভাতা পাবেন। তারা মেডিকেল ও নার্সিং ছাত্রদের শিক্ষকতার জন্যও একটি ভাতা পাবেন। তারা নিকটবর্তী মেডিকেল কলেজের লেকচারার (প্রভাষক) পদবিও পাবেন। উভয় ভাতার পরিমাণ ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকার কমাহওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। টঐঋডঈ-এর সব সার্বক্ষনিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিনে ভাড়ায় বাসস্থান দেওয়া হলে সেখানে অবস্থান আকর্ষণীয় হবে। মেডিকেল ছাত্ররা ইউনিয়ন সেন্টারে প্রতি বছর একমাস প্রশিক্ষণ নেবে। তাদের জন্য ডরমেটরির ব্যবস্থা থাকবে। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হবে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যানকেন্দ্রে। চিকিৎসকরা নিয়মিত কমিউনিটি ক্লিনিক ও ফার্মেসিগুলো পরিদর্শন করবেন এবং কঠিন রোগীদের চিকিৎসা দেবেন প্রয়োজনে তাদের উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে প্রেরণ (জবভবৎ) করবেন। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যানকেন্দ্রের চিকিৎসকরা নিয়মিত স্কুল স্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। চিকিৎসকরা পরিবার পরিকল্পনা এবং পাবলিক হেলথ পরিদর্শক ও তাদের সহকারীদের কার্যক্রমও তদারকি করবেন, গ্রামের দাইদের প্রশিক্ষণ দেবেন এবং বাড়িতে নিরাপদে স্বাভাবিক প্রসব করানো তদারকি করবেন। বিঘ্ন প্রসবের প্রসূতিকে হাসপাতালে প্রেরণে (জবভবৎ) উৎসাহিত করবেন। (ঘ) ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি অনুসরণ করলে সব ওষুধের মূল্য ১৫ দিনের মধ্যে ৫০% কমে অর্ধেকে নেমে আসবে। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে সব ল্যাবরেটরি চার্জ, ওঈট চার্জ ও অপারেশন চার্জ অনেক কমে আসবে। এতে জনগণের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ব্যয় সাশ্রয় হবে। সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক স্বাস্থ্য বিমা প্রচলনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকাশ্যে ধূমপান ও পান সেবন বন্ধ করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ কমবে। বায়ুদূষণ কমবে ফলে অসংক্রামক রোগও কমবে। সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সকল অতিদরিদ্র ও দরিদ্র পরিবার এবং শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যে নিয়মিত রেশনে চাল, ডাল, তেল ও চিনি প্রদান করা হবে যাতে পুষ্টিহীনতা দূরীভূত হয় এবং কর্মদক্ষতা (চৎড়ফঁপঃরারঃু) বাড়ে। সকল প্রকার খাদ্য, পেঁয়াজ, ডাল, রসুন ও অন্যান্য মসলায় স্বয়ংসপূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে প্রতি বছর প্রত্যেক প্রদেশ/স্টেটে নূ্যনতম ৫০০০ (পাঁচ হাজার) কোটি টাকা কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হবে বীজ, সার ও সেচের জন্য। এ বিনিয়োগ এনজিওকর্মীদের মাধ্যমে প্রদান করলে কৃষক সময় মতো পাবেন। টাকা পৌঁছানোর জন্য এনজিও পাবে ৩% এবং শস্য উৎপাদন ও বিক্রির পর টাকা কৃষক থেকে সংগ্রহ করে সরকারকে ফেরত দেওয়ার জন্য পাবেন ৪%। কৃষকের পণ্যের ন্যায্য দর নিশ্চিত করে শহরে সরবরাহ করা হবে কিছু বাড়তি দরে। এতে কৃষক ও শহরবাসী উভয়ে লাভবান হবেন। মধ্যস্বত্ব ভোগী বিলোপ হবে। শীতের সময় বিকালে ও রাতে অবসর বিনোদনের জন্য পালাগান, শিক্ষামূলক নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে কৃষক পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। \হসবার জন্য আধুনিক শিক্ষা দশম শ্রেণি শিক্ষা পর্যন্ত অধ্যয়ন সবার জন্য বাধ্যতামূলক হবে। প্রাইমারি শিক্ষায় ৫টি শ্রেণি থাকবে। প্রাইমারি স্কুলে চারুকলা, শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও গান-বাজনার ব্যবস্থা থাকবে। প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষা নিজ নিজ স্কুলে হবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রদেশ/ স্টেটভিত্তিক 'বৃত্তি' (ঝপযড়ষধৎংযরঢ়) পরীক্ষা হবে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিত বয়োবৃদ্ধরা প্রাইমারি স্কুলে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা এবং তদারকি করার সুযোগ পাবেন। প্রত্যেক প্রদেশ/স্টেট নিজস্ব ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ জনসেবকদের তথ্য কারিকুলামেও যুক্ত হবে। স্থানীয়পর্যায়ে এ সব টেক্সট বই প্রণীত, মুদ্রিত ও প্রকাশিত হবে। সব প্রাইমারি স্কুলে তিন জন নারী শিক্ষক থাকবেন। প্রত্যেক প্রাইমারি স্কুলে ছাত্রীদের জন্য আলাদা পায়খানা-প্রস্রাবখানা থাকবে, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্যও টয়লেট ব্যবস্থা রাখা হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে প্রাইমারি স্কুলের পাশে একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, পাঠাগার এবং বিনোদন ব্যবস্থা থাকবে। বয়স্ক ও বয়োবৃদ্ধরা বিকালে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খেলাধুলায় অংশ নিতে পারবেন। সব হাইস্কুলে ভোকেশনাল শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। ছেলেমেয়েদের লিঙ্গ সমতার জ্ঞান এবং আত্মরক্ষার শিক্ষাও দেওয়া হবে। প্রাইমারি স্কুলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের, আরবি ভাষার হরফের সঙ্গে পরিচিত করানো হবে। কলেজপর্যায়ে আরবি, ফরাসি, চাইনিজ, জাপানি, সোহলী, কোরিয়ান, স্পেনিস প্রভৃতি একটিতে কথোপকথন শিক্ষা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানে সহায়ক হবে। যুদ্ধংদেহী ভারতের আগ্রাসন এবং মিয়ানমারের অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দেশকে রক্ষায় সহায়তার জন্য সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ৬ (ছয়) মাস সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ খরচ বহন করবে কেন্দ্রীয় সরকার। সব মাদ্রাসায় আরবি ভাষা ও ধর্মীয় শাস্ত্রের বু্যৎপত্তির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শিক্ষাদান করা বাঞ্ছনীয়। মাদ্রাসা শিক্ষায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শিক্ষার সুযোগ অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। পঞ্চম প্রস্তাব : সবার জন্য কর্মসংস্থান বাংলাদেশের অধিকাংশ কর্মসংস্থান কৃষি, শিল্প, গণপরিবহণে এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। শহরের ফুটপাতে দোকানদারী করে কয়েক লাখ পরিবার জীবিকা অর্জন করে। এ ছাড়া পৃথিবীর শতাধিক দেশে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লাখ বাংলাদেশের নাগরিক শ্রমে নিয়োজিত। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। সারা পৃথিবীতে বয়োবৃদ্ধের সংখ্যাও বাড়ছে, বাংলাদেশে ১০% অনধিক, তবে উন্নতগুলোয় ২৮% পৌঁছেছে। তাদের সেবা শুশ্রূষার জন্য তরুণদের ছয় মাস সেবাপ্রদান প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে শিক্ষিত বেকাররা কৃষি সমবায় ও বিদেশে বয়োবৃদ্ধদের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পাবে। স্বল্পশিক্ষিত বেকারদের কৃষি ও স্থানীয় শিল্পে কর্মসংস্থান হবে। তাদের বিদেশে কৃষিনির্ভর শিল্পে কর্মসংস্থান হবে উচ্চ বেতনে। তবে স্পেনিস ও আফ্রিকার অন্যতম ভাষা সোহলীতে কথোপকথন শিখলে উচ্চ আয়ে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কৃষিতে কর্মসংস্থানের জন্য সহায়ক হবে। বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে যা আয় করে ৪০ লাখ তরুণ শিক্ষিত বেকাররা বিদেশে বয়োবৃদ্ধদের সেবা দিয়ে সমপরিমাণ আয় করবে। চালক ছাড়া কেউ রিকশা, বেবি ট্যাক্সি ও নৌকার মালিক হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রেও মধ্যস্বত্ব্ব ভোগী মালিকের বিলুপ্তি হবে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য ও কর্তব্য। জাফরুলস্নাহ্‌ চৌধুরী : ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র