পাঠক মত

সামাজিক কর্মনীতিতে ওয়াদার গুরুত্ব

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাটাই মূল লক্ষ্য। আমরা সমাজে বসবাস করছি। এই সমাজে আমরা নানা ধরনের কাজ করে থাকি। তন্মধ্যে ওয়াদা পালন অন্যতম। ওয়াদা পালন ইসলামের অন্যতম একটি অধ্যায়। ওয়াদা শব্দের অর্থ, অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রম্নতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। পরিভাষায় বলতে গেলে, কারও সাথে কোনো অঙ্গীকার করলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। সামাজিকভাবে প্রকৃত মানুষ চেনা যায় ওয়াদা পালনের মাধ্যমে। ওয়াদা পালনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। সমাজে সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। মানুষের চরিত্রগত দিক বুঝা যায় ওয়াদা পালনের মধ্য দিয়ে। তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে কতিপয় ব্যক্তি রয়েছে যারা কিনা ওয়াদা পালন না করে ভঙ্গ করে থাকেন। এতে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় এবং অবিশ্বাসযোগ্য মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজে সে যত বড়ই সম্মানী ব্যক্তি হোক না কেন। সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। ওয়াদা পালনের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আলস্নাহ তা'আলা বলেন, *হে ঈমানদারগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূরণ করো। (সূরা-মায়েদা :০১) অন্যত্র আয়াতে বলা হয়, *আলস্নাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সেই অঙ্গীকার পূর্ণ করো এবং পাকাপাকি কসম করার পরে তা ভঙ্গ করো না। আর এই ব্যাপারে তো তোমরা আলস্নাহকে জামিন করেছ। তোমরা যা কর আলস্নাহ তা জানেন। (সূরা আন-নাহল: ৯১) পবিত্র কুরআনে যেমন ওয়াদা পালনের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ঠিক তেমনি হাদিস শরীফেও ওয়াদা পালনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তার মধ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে রাসূল (সা.)-এর ওয়াদা পালনের জন্য তিনদিন একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা। *হযরত আবদুলস্নাহ ইবনে আবু হাসমা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে একদা আমি তার কাছ থেকে কেনাকাটা করি। যার কিছু মূল্য পরিশোধ করতে বাকি রয়ে গিয়েছিল। আমি তার সাথে ওয়াদা করেছিলাম যে, আমি অবশিষ্ট দাম নিয়ে তার নির্ধারিত স্থানে এসে হাজির হব। আমি এই প্রতিশ্রম্নতির কথা ভুলে গেলাম। তিনদিন পরে আমার স্মরণ হলো। এসে দেখলাম তিনি সেই নির্দিষ্ট স্থানে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, তুমি আমাকে খুব বিপদে ফেলেছিলে। আমি তিনদিন ধরে তোমার অপেক্ষা করছি। (আবু দাউদ) উক্ত হাদিসের দ্বারা বুঝা যায়া রাসুল (সা.) ওয়াদা পালনে কত সোচ্চার ছিলেন। এর থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আর অথচ আমরা খেয়াল তামাশায় ওয়াদা ভঙ্গ করে ফেলি। আমরা ছোট কিংবা বড়দের দুষ্টামির ছলে বলে থাকি, তোমাকে আমি কিছু দেব। আর যদি তা পালন না করা হয় তাহলে অবশ্যই গুনাহগার হবে। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে যে, *হযরত আবদুলস্নাহ ইবনে আমের (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমার মা আমাকে ডাকলেন। তখন রাসূল (সা.) আমাদের ঘরে বসা ছিলেন। মা বললেন, এদিকে এসো। তোমাকে আমি কিছু দিব। তখন রাসূল (সা.) মাকে বললেন। তুমি তাকে কি দিতে ইচ্ছা পোষণ করেছ? তিনি বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দিতে ইচ্ছা করেছি। তখন রাসূল (সা.) তাকে বললেন, সাবধান! যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তবে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা কথা বলা লেখা হতো। (আবু দাউদ) সুতরাং, আমাদের ব্যক্তি জীবনে এমন খেয়াল তামাশায় বা দুষ্টামির ছলে এমন কাজটি করা হতে বিরত থাকতে হবে। কেননা এর ভয়াবহতা কঠোর। আর এই ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত। যেমন হাদীসে ইরশাদ হয়েছে যে, *হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি। (১) কথা বললে মিথ্যা কথা বলে। (২) ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে। (৩) আমানত রাখলে তা খেয়ানত করে। (তিরমিযি) উক্ত হাদিসের মাধ্যমে বুঝা যায়, ইসলামে কতটা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ওয়াদা পালনের ব্যাপারে। তবে হঁ্যা, যদি কোনো বিশেষ কারণে ওয়াদা পালন করতে না পারে এতে কোনো অপরাধ হবে না। যেমন হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, *হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি ওয়াদা করার সময় যদি তা পূরণের নিয়ত রাখে কিন্তু পরে (কোনো বিশেষ অসুবিধার কারণে) তা পূরণ করতে না পারে। তবে এতে তার অপরাধ হবে না। (তিরমিযি) পরিশেষে বলা যায়, সমাজে সম্মানের সাথে জীবন-যাপন করতে হলে অবশ্যই ওয়াদা পালনে সোচ্চার হতে হবে। সামাজিক কর্মনীতিতে ওয়াদার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আসুন, ইসলামি বিধি-বিধান মেনে চলি, পরকালের সম্বল গড়ি। মু. সায়েম আহমাদ শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মহান আলস্নাহতায়ালার সব সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষকেই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন করে তৈরি করেছেন। মানুষ নারী ও পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও অনেকেই হরমোনজনিত সমস্যার কারণে নারী-পুরুষের সহজাত গুণাগুণ ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেন না, যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করি এবং সমাজে তাদের অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখা হয় বলে তাদের 'হিজড়া' বলে ডাকা হয়। হিজড়া বলে ডাকা কাম্য না হলেও এটিই এখন সমাজ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের মানুষের কাছে তারা নামমাত্র মানুষ হিসেবে গণ্য হলেও তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে অনীহা সমাজের মানুষের, স্বয়ং পরিবারের সদস্যরাই তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্ম নেওয়া সন্তানদের পরিবার থেকে বের করে দেয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে সমাজে অভিশাপ মনে করা হয়। যে সব পরিবারে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্ম নেয়, তাদের অপয়া হিসেবে আখ্যায়িত করে এ সন্তানকে বুঝ হওয়ার পর সমাজচু্যত করে দেওয়ার ফলে তারা নিজেদের মতো বাঁচার জন্য অন্যান্য তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে দলভুক্ত হয়ে বসবাস করে। তবে অনেক পরিবারই আছে, যারা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের বের করে না দিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই বেড়ে ওঠার সুযোগ দেন। যারা স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করে, পরিবারের কাজকর্ম করে। সমাজচু্যতদের মতো বিশৃঙ্খলা করে না। পবিত্র কোরআনেও সব মানুষকে নর-নারী হিসেবে গণ্য করে তাদের অধিকার, করণীয় ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে বলেছেন। পবিত্র কোরআন কিংবা হাদিস শরীরে তৃতীয় লিঙ্গ বলে আলাদা কোনো জীবনব্যবস্থা রাখা হয়নি তাদের জন্য। আলস্নাহতায়ালা ইরশাদ করেন 'হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে। (সুরা- হুজরাত-১৩)। আর আমি বানিয়েছি তোমাদের জোড়ায় জোড়ায় (পুরুষ-নারী) সুরা-নাবা-৮)। মহানবী (সা.) এসব মানুষ হিজড়া বলে সম্বোধন করতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, 'তোমরা এদের হিজড়া বলো না, এরা নারী বা পুরুষ'। আমরা তাদের হিজড়া বলার পরিবর্তে সুন্দর ভাষায় তৃতীয় লিঙ্গ বললেও মূলত তৃতীয় লিঙ্গ বলতে কিছু নেই, এটি বলার সুবিধার্থে সৃষ্ট মাত্র। তারা নারী বা পুরুষ, শুধু অক্ষমতাই অন্যান্য মানুষ থেকে আলাদা করে রেখেছে। তারা অন্যান্য নারী-পুরুষের মতোই গণ্য হয়ে সব ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধাদি ভোগ করার অধিকারী হবেন এবং মৃতু্যপরবর্তী জীবনেও তাদের নারী অথবা পুরুষ হিসেবেই গণ্য হয়েই তাদের কর্মফল পাবেন। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম হিসেবে, পবিত্র ইসলামে সবাইকে মানুষ হিসেবে গণ্য করলেও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে অপয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে 'হিজড়া দেখলে দিনটি ভালো কাটবে না' মর্মে কুসংস্কারে বিশ্বাস করে তাদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়, যা কাম্য নয় এবং সৃষ্টির সেরা মানুষকে ঘৃণা করার মতো নিকৃষ্ট কাজের সামিল। সম্প্রতি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে মুফতি মুহাম্মদ আবদুর রহমান আজাদের একান্ত প্রচেষ্টায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। সমাজ যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখে, তাদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন শুরু করা যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। মাওলানা আজাদের মাধ্যমে কুসংস্কারমুক্ত হয়ে তাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করে মৌলিক অধিকার প্রদানের যে জাগরণ শুরু হয়েছে তা চলমান রাখার মাধ্যমে দেশের সব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে অন্য আট-দশজন মানুষের মতোই গণ্য করে তাদের সব সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ঘৃণার চোখে না দেখে, অপয়া মনে না করে, সমাজ থেকে বের করে না দিয়ে পরিবারের মধ্যেই তাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়াসহ তাহাদের প্রাপ্য সব অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটা প্রথমত তাদের পিতা-মাতা, ভাই-বোনদেরই করতে হবে। এ ছাড়া যারা ইতিমধ্যেই সমাজচু্যত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছেন, তাদের পূর্ণ অধিকার প্রদানের মাধ্যমে বসবাসের সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। জুবায়ের আহমেদ শিক্ষার্থী ডিপেস্নামা ইন জার্নালিজম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম) কাঁটাবন, ঢাকা