শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এখনো সুসংহত নয়

বাংলাদেশের সম্পদ বাংলার মানুষের কাজে লাগিয়ে বাংলাকে সমৃদ্ধ করা ও চিরতরে সার্বিকভাবে শোষণমুক্ত করা। তিনি প্রথম বুঝলেন এবং জনগণকে বোঝালেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির ভাগ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
ডা. এস এ মালেক
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

আসলে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়াতে প্রথিত ছিল পাকিস্তান ধ্বংসের বীজ। যে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর ভর করে পাকিস্তানের জন্ম; সেই ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাজনিত রাজনীতির কারণেই পাকিস্তানের অপমৃতু্য ঘটে। ভারতের স্বাধীনতা লগ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নামক পর্ব দুটি রাজনৈতিক দল ভারতের ২টি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, অর্থাৎ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে দুই দলের ভেতর যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা সুকৌশলে সৃষ্টি করেছিল; তার কারণেই ভারত বিভক্ত হয়। ব্রিটিশরা তাদের আর্থিক স্বার্থ সুদূরপ্রসারী করার জন্য ভারতের স্বাধীনতা লগ্নে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের যারা স্বাধীনতা সংগ্রামী, যারা একসঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছিল, তারা হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একই সময় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা ক্ষমতার লোভে উন্মাদ হয়ে দ্বিধাবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতার অনুমোদন দেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা ভেবেছিলেন আরও সময় অতিবাহিত হলে নেতৃত্ব হস্তান্তরিত হতে পারে। তাই বেশ তাড়াহুড়া করে স্যার শেরিনর্ যাডক্লিফের রোয়েদাদ অনুযায়ী মেনে নেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কৌশল ছিল প্রায় অভিন্ন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের নেতারা, যারা পরবর্তী সময়ে মি. জিন্নার নেতৃত্বে পাকিস্তানের স্বাধীন সরকার গঠন করলেন, তাদের ভেতর পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী, দক্ষ ও দূরদর্শী নেতার অভাব ছিল। তমিজ উদ্দিন খান, সুবর খান, আব্দুল ওহাব খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী এরা জিন্নাহর সমকক্ষ কোনো নেতা ছিলেন না। তাছাড়া পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের নেতাদের দালালি মনোভাব মিস্টার জিন্নাহর ও সহযোগীদের সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে ছিলেন। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের তখন যেসব নেতা মিস্টার জিন্নাহর খপ্পরে না পড়ে পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থাৎ বাঙালির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন; তারা স্রোতে গা না ভাসিয়ে ভিন্ন পরিকল্পনায় অগ্রসর হতে থাকেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, এরা ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের চাইতেও একটা নিরাপদ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাঙালির জন্য চিন্তাভাবনা করছিলেন। তরুণ ছাত্র নেতা শেখ মুজিব ছিলেন এই চিন্তা ধারার অনুসারী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের পূর্বেই কোলকাতায় বন্ধুবান্ধবদের বলেছিলেন, বাঙালিকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করার কথা। এইরূপ চিন্তাচেতনা নিয়েই বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন। তৎকালীন নেতারা ভেতর যারা প্রগতিশীল, বামপন্থি ছিলেন, তারাও ছিলেন, একই অনুসারী। তাদের ধারণা ছিল একটা স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টিতে যেসব উপাদান পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করে তার কোনোটাই পাকিস্তান সৃষ্টিতে বিদ্যমান ছিল না। তারা ভালো করে বুঝেছিলেন শুধু ধর্মীয় কারণে প্রায় ১২শ মাইল দূরে অবস্থিত দুটি ভূখন্ডকে, দুটি পৃথক জনসত্ত্বাকে একিভূত করে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করলেও, তা টিকিয়ে রাখা কষ্ট হবে। পাকিস্তানের জনগণের ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, আহার-বিহার, পোষাক-আশাক, চিন্তাচেতনা সবই ছিল পূর্ব বাংলার জনগণ থেকে পৃথক। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মকে জাতিসত্ত্বার মূল উপদান হিসেবে গ্রহণ করে একটা ধর্মরাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হলেও, জাতি রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব না। আসলে বাঙালি পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত হয়েও কখনো তারা জাতিসত্ত্বার প্রশ্নে আপস করতে রাজি হয়নি। পাকিস্তানপন্থি তথাকথিত কিছু ধর্মের ধব্জাধারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের দালালি করে নিজেদের স্বার্থসংরক্ষণ করলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কখনো বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনা থেকে বির্বজিত হয়নি। এ কারণেই ভাষা আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তারা মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। আসলে পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল এর উক্তি যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, তা বাঙালি জাতির ভেতরে এক ক্ষুব্ধ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, বাঙালিত্ব ও পাকিস্তানত্ব দুটি পৃথক সত্ত্বা। যার সমন্বয় সাধন কখনো সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই জাতিয়তাবাদী চেতনাভিত্তিক জাতি সত্ত্বার আন্দোলন শুরু হয় এবং সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেন। স্বায়ত্তশাসনের দাবি এর পূর্বেই উঠেছিল- কিন্তু ৬৬তে ৬ দফা ঘোষণা করে তিনি স্বায়ত্তশাসেনের গতি ও প্রকৃতি কী হবে, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দেন। ওই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল- পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে না দেওয়া।

বাংলাদেশের সম্পদ বাংলার মানুষের কাজে লাগিয়ে বাংলাকে সমৃদ্ধ করা ও চিরতরে সার্বিকভাবে শোষণমুক্ত করা। তিনি প্রথম বুঝলেন এবং জনগণকে বোঝালেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির ভাগ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

\হআর ৬ দফা ছিল এমন এক আন্দোলন- যা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তারিত করেন। ৬ দফাকে নির্বাচনে ম্যানডেট হিসেবে ব্যবহার করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে ১৬৯ এর ভেতর ১৬৭টি আসন পেয়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করলেন যে, বাংলার জণগণ একচ্ছত্রভাবে তার পেছনে রয়েছে এবং স্বাধীকারের প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে কোন আপস করতে রাজি নই। পাকিস্তান সরকার যখন '৭০-এর নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করে জোরজবরদস্তি করে বাংলাদেশে তাদের শাসন প্রক্রিয়া রাখতে চাইল; তখন অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করলেন, পূর্ব বাংলায় পকিস্তানের কোনো অস্তিত্ব নেই। তার নির্দেশনায় হয়ে দাঁড়ালো সরকার পরিচালনা আইন। একমাত্র সামরিক ছাউনিতে ছাড়া আর কোথাও তখন পাকিস্তানের পতাকা উড়াবার সাহস কারো নেই। রাষ্ট্র, প্রশাসন বিকল হয়েছে। সেনাবাহিনী জনগণ কর্তৃক অবরুদ্ধ। শেখ মুজিবই প্রকৃত পক্ষে মার্চ মাস ভরে স্বাধীন বাংলাদেশ শাসন করেছেন। এরপর ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি পাকিস্তানের মৃতু্যঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। সেই থেকে আমরা স্বাধীন।

এত বড় পরাজয়ের পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বিরোধিতা করেছিল, তারা পরাজয় মেনে না নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় প্রতিবিপস্নব ঘটিয়ে জাতির পিতাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। স্বাধীনতার নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচু্যত করে। '৭১-এর স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিল। আর একজন তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়া ও খুনি মোশতাক তাতে নেতৃত্ব দিলেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে দুইজন সামরিক শাসক পাকিস্তানের মতো সিভিল-মিলিটারি বু্যরোক্র্যাসি ধারায় (৭৫-৯০) এই ১৫ বছর দেশ শাসন করে। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সব অর্জনসমূহ বির্সজন দিলেন। ৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১৫ বছর নিরববিচ্ছিন্ন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাসীন হন এবং সেই থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির পুনর্যাত্রা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে- গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবিপস্নবের ধারায় পরিবর্তন করে দেশ ও জাতিকে গণতান্ত্রিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরে আনা এবং সে জন্য বাঙালির পক্ষে আবার তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হওয়া সম্ভব হয়েছে। আজ আমরা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। শেখ হাসিনার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে- যে কারণে তার পিতা বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন অর্থাৎ দেশ এবং জাতিকে চিরতরে শোষণমুক্ত করে, একটা কল্যাণমুখী, আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি। সেই লক্ষ্য নিয়ে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং এ কারণেই স্বাধীনতাবিরোধীরা যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে বিরোধিতা করেছিল ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনাকেও বিরোধিতা করে চলেছে। যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল, ঠিক একইভাবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যামে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আলস্নাহর মহান কৃপায় শেখ হাসিনা শুধু বেঁচেই নেই, দ্বিগুণ উৎসাহে পিতার আরোধ্য দায়িত্ব পালন করবার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। আর স্বাধীনতা বিরোধীরা ওতপেতে বসে আছে; কীভাবে, কখন, বিদ্যমান বাস্তবতার অবসান ঘটাবে। তাই দেখে শুনে মনে হয়, স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পরও আমাদের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব আমরা এখনো হয়তো চিরঞ্জীব করতে পারিনি। মহান জাতীয় ঐক্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়। ঠিক '৭১-এর মতো একমত ও এক পথে থেকেই সর্বাত্মকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে চরম ত্যাগী মনোভাব নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করতে সক্ষম হব। স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক সেই প্রত্যাশায় রইল।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে