শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উপমহাদেশে সশস্ত্র আন্দোলন

১৯০৮ সালে এসে ক্ষুদিরামের ফাঁসির মধ্য দিয়ে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল। অসহযোগ আন্দোলনে পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র আন্দোলন ভিন্ন একটা মাত্রা পেল।
ওমর খালেদ রুমি
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সাল। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। কেন গুরুত্বপূর্ণ তার ফিরিস্তি দেওয়া যা- তা কম নয়। অনেক লম্বা কাহিনি। ইংরেজদের শাসনের তখন ১৫০ বছর হয়ে গেছে। হিন্দুদের হাতের পুতুল বানিয়ে খেলতে খেলতে কখন যে এই দীর্ঘ সময়টা পেরিয়ে গিয়েছিল তা কেউ টের না পেলেও মুসলমানরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। জমিদারি, ব্যবসা আর চাকরি থেকে শুরু করে দালালি- সব কিছুই ছিল হিন্দুদের দখলে। আর মুসলমানরা তখনো ক্রীতদাসের মতো অমানবিক জীবনযাপনে ব্যস্ত। একদিক ইংরেজদের ক্ষোভ অন্যদিকে হিন্দুদের ঈর্ষার শিকার মুসলমান সম্প্রদায় জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে তলানিতে এসে পৌঁছে ছিল। হায়রে নিয়তি। অথচ এই মুসলমানরাই শত শত বছর ধরে এই ভূখন্ড শাসন করেছিল। অনেকেই বলে বাংলা ভাগ ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি। হতেও পারে। কিন্তু এর মধ্যে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগও যে নিহিত ছিল তাও তো মিথ্যে নয়। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক ব্রাহ্মণবাদী হিন্দু সমাজের এটা পছন্দ হলো না। তারা এর মধ্যে অনেক ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেল। ভালো-মন্দ যাই হোক এই বাংলা ভাগই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠল। একে ঘিরেই পরবর্তী সময়ে হিন্দু মুসলমান উভয়ের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে স্বরাজ-এর ছত্রছায়ায় স্বদেশি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আর সেই আন্দোলনই জন্ম দিয়েছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক ও সশস্র সংগ্রামের যুগপৎ পথ চলা। কারণ আমরা সবাই জানি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেস এবং ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল। তবে একথা সত্য স্বদেশি আন্দোলন তখনো সর্বসাধারণের আন্দোলন হয়ে উঠেনি। আর মুসলিম লীগও তখন সংগঠন হিসেবে একেবারেই শিশু। তবুও উপমহাদেশের মুসলমানদের চিন্তাধারা তাদের এটা অন্তত বুঝতে সাহায্য করেছিল বাংলা মায়ের শরীর দ্বিখন্ডিতকরণের প্রতিবাদে এই যে আন্দোলন যা মূলত উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদেরই প্রতিফলন তা কোনোমতেই তাদের আন্দোলন হতে পারে না। তাই তারা এর প্রতি ততোটা ভ্রূক্ষেপ করেনি। স্বদেশি আন্দোলনের সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা ছিল ক্ষুদিরামের ফাঁসি। জনৈক ইংরেজ কর্মকর্তাকে মারতে গিয়ে যদিও ভুলবশত অন্য কাউকে মেরে বসেছিলেন কিন্তু এ ঘটনাই ছোট ক্ষুদিরামকে মহানায়কে পরিণত করেছিল।

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সবারই হৃদয় ছুঁয়েছিল। কারণ আন্দোলনের উদ্দেশ্য যাই থাক, ক্ষুদিরামের এই ইংরেজ বিদ্বেষ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সব শ্রেণির মানুষকে কাঁদিয়েছিল। তাই তো তার স্মৃতি মানুষ আজও বয়ে বেড়ায়। সবার মুখে মুখে তার মুখেরই গান- "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"। বাংলা মায়ের শরীর বিচ্ছিন্নকরণের দুঃখে হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজের এই মায়াকান্না ইংরেজদের খুব একটা পছন্দ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। দেড়শ বছর ইংরেজদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে তাই দমনপীড়ন চালাতে খুব একটা দ্বিধা করেনি ইংরেজ শাসকরা। কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। স্বদেশি আন্দোলনকারীদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল ইংরেজ। অবশেষে তারা তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তারা বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে। আন্দোলনের গতি কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়। এদিকে ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। চলেছিল ১৯১৯ পর্যন্ত। নানা কারণে স্বরাজ আন্দোলন খুব একটা জমেনি। ১৯২০ থেকে ১৯২২ সালে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন অনেকটা বাধ্য হয়েই। ১৯১৯ এর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড এবং এর নির্মমতা গান্ধীজিকে এই প্রথম কিছুটা সহিংস পথে হাঁটতে বাধ্য করল। কিন্তু চৌরিচৌরার ঘটনা তার চেষ্টায় পানি ঢেলে দিল। গান্ধীজি আন্দোলন থামাতে বাধ্য হলেন। কিন্তু এই আন্দোলন সর্বস্তরে যে মোমেন্টাম তৈরি করেছিল তার ফলস্বরূপ ভিন্নধারার সশস্র প্রতিবাদের জন্ম হলো। বঙ্গভঙ্গের সূত্র ধরে যে সশস্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তার মূল খুঁজতে গেলে আমাদের আরও অতীতে ফিরে যেতে হবে। যখন প্রথম ইংরেজরা এলো মীর কাসিম প্রথম চেষ্টাটা করলেন বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে যেতে কিন্তু তিনি সক্ষম হলেন না। বাংলার কপাল পুড়ল স্থায়ীভাবে। সেই সঙ্গে পুরো উপমহাদেশেরও। শোষণ যা ইংরেজদের পাশাপাশি দেশীয় ধনিক শ্রেণিরাও চালিয়েছিল তা সাধারণ মানুষকে এতটাই নিঃস্ব আর খেলার উপকরণে পরিণত করল যে, ১৭৬৯ আসতে না আসতেই দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেল। মরল কেবল নিঃস্ব আর অসহায় মানুষগুলো। সময় যতই গড়াতে লাগল পরিস্থিতি ততটাই খারাপ হতে লাগল। প্রতিবাদও শুরু হলো। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। রাজা রামমোহন রায় এগিয়ে এলেন সামাজিক সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে। তিনি সতীদাহ প্রথা রদ করাতে সক্ষম হলেন। তিতুমীর এগিয়ে এলো জমিদারদের বিরুদ্ধে তার কর্মসূচি নিয়ে। সৈয়দ আহমদ শহীদ ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি শিখদের বিরোধিতা করে মাঠে নামলেন। রাম মোহনের মৃতু্যর পর তারই দেখানো পথে হাঁটলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বিধবা বিবাহ চালু ও বহু বিবাহ রোধ করার যে প্রত্যয় নিয়ে সামনে আগালেন তাতে সফলও হলেন। এ ঘটনা অবশ্য কিছুটা পরের। কারণ মাঝখানে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়ে গেল তার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, তা শুধু ঈস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির যে ভীতটাই কাঁপিয়ে দিল তাই নয়, বরং তা কোম্পানির রাজত্বকেই শেষ করে দিল আর নিয়ে এলো ব্রিটিশ রাজের সরাসরি শাসন। আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছি ঘটনা প্রবাহ সামনে আগাচ্ছিল ঠিকই তবে প্রতিবাদ হচ্ছিল যার যার জায়গা থেকে অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় দুটো আলাদা আলাদাভাবে যার যার মতো সামনে আগাচ্ছিল। এবার আরও সামনে আগালে আমরা স্যার সৈয়দ আহমদের উত্থান দেখতে পাব। তার সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করব নওয়াব আলী চৌধুরীর সংস্কার কর্মসূচি। এসব ঘটনাপ্রবাহ যখন চলছিল তখন ১৮৮৫ খিষ্টাব্দে কংগ্রেসের জন্ম সমস্ত হিসাব উল্টাপাল্টা করে দিল। এই একটি পস্নাটফর্মে সবার জড়ো হওয়াটা হিন্দুরা ভালোভাবে নিলেও মুসলমানরা ভালোভাবে নিতে পারেনি। কারণ ছিল। অতীতের দগদগে ঘা। হিন্দুদের ইংরেজ তোষণ। কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে চলা। মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া। আরও কত কি? এখানে বলে রাখতে চাই, উভয় ধর্মের জনগোষ্ঠীর দ্বারা যে সংস্কার বা আন্দোলন কর্মসূচি চলছিল তার পক্ষে বিপক্ষেও লোকের অভাব ছিল না। রামমোহনের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের বিপরীতে যেমন হিন্দু ধর্ম রক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠা করা হয় তেমনি ওয়াহাবী আন্দোলনের আধুনিক মনস্কতার বিরুদ্ধে ও অবস্থানের বিরুদ্ধে অবস্থানের ব্যাপারে প্রগতিশীল মুসলিম অগ্রনায়করা যেমন স্যার সৈয়দ আহমদ সোচ্চার হন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। ইংরেজ বিরোধিতা না হয় মানা গেল কিন্তু মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে রেখে পশ্চাৎপদ করে তোলার ব্যাপারটা সচেতন সমাজ মানবেই বা কেন? আর এই ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে হিন্দু সমাজের আরও একজন এগিয়ে এলেন। তিনি ঠাকুর দয়ানন্দ সরস্বতী। ১৮৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন আর্য সমাজ। আর তার দ্বারা পরবর্তী সময়ে যিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত হলেন তিনি আর কেউ নন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের। তাই তার ওপর ঠাকুর দয়ানন্দের প্রভাবের ব্যাপারে যে কথাটা বলা সবচেয়ে সঠিক হবে তা হলো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ধারাবাহিকতাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর মূলত এই তিনজনের মিলিত প্রচেষ্টায়ই একটা পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা এক কথায় বলতে গেলে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এই জেগে ওঠা মতবাদকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিলেন তিনজন। এরা হলেন- বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল ও লালা লাজপৎ রাই। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে এসে এদের তৈরি করা উর্বর ক্ষেত্রে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে শ্রী অরবিন্দ ঘোষ যোগ করলেন এক ভিন্ন মাত্রার কর্মসূচি। যতীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সহায়তায় তিনি যে ক্ষেত্র তৈরি করলেন তার হাত ধরেই ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রমথনাথ মিত্রের সহায়তায় সতীশ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে অনুশীলন সমিতি এবং ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তারই ভ্রাতা বারিণ ঘোষ ও বাঘা যতিনের নেতৃত্বে যুগান্তর সমিতি গড়ে উঠল। পরবর্তী সময়ে বিপস্নবী পুলিন বিহারি দাসের নেতৃত্বে ঢাকায় ঢাকা অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠে যার মন্ত্রণাদাতা ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল। আর এভাবেই হিন্দু জাতীয়বাদী আন্দোলন একটা ভিন্ন মাত্রা লাভ করল।

১৯০৮ সালে এসে ক্ষুদিরামের ফাঁসির মধ্য দিয়ে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল। অসহযোগ আন্দোলনে পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র আন্দোলন ভিন্ন একটা মাত্রা পেল।

এ সময় যে সব উলেস্নখযোগ্য ঘটনা ঘটল তাহলো কাকোরি ট্রেন ডাকাতি, যার সঙ্গে পন্ডিত রামপ্রাসাদ বিসমিল, আশফাকুলস্নাহ খান, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখের নাম জড়িত। এরপর ভগৎ সিং এবং তার সহযোগীদের বিভিন্ন হামলা যার সঙ্গেও চন্দ্রশেখর আজাদের নাম জড়িত থাকতে দেখা যায়। সবশেষ উলেস্নখযোগ্য ঘটনা হলো মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের অস্রাগার লুণ্ঠন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশ সরকার অগণিত সশস্র বিপস্নবীকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিলে অনেকেই এই পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে তারা কংগ্রেস অথবা বাম আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেলে সমগ্র আন্দোলন তার গতিপথ হারায়। আর এই সময় গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ও জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এমন একটা পর্যায় পৌঁছে যায় যে, হিন্দু ও মুসলমান উভয় জনগোষ্ঠী যার যার পস্নাটফর্ম বেছে নেয়।

ওমর খালেদ রুমি : কবি ও কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে