সবর্নাশা নদীভাঙন ঠেকান

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মুনযির আকলাম কুমিল্লা
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ভাঙন? অনেকের জীবন দুবির্ষহ হয়েছে এই ভাঙনে? নদ-নদী ভাঙনে প্রতিবছরই হাজার-হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি শত শত কোটি টাকার সম্পদ নদীগভের্ বিলীন হচ্ছে। বাস্তুভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে দরিদ্র মানুষ আরও হতদরিদ্র হচ্ছে। কমছে ফসলি জমির পরিমাণও। বষার্ মৌসুমে উজানের বৃষ্টির মাত্রা যত বাড়ছে, ভাটি এলাকায় নদীভাঙনও তত তীব্রতর হচ্ছে। চোখের সামনেই আকষ্মিকভাবে ভাঙনের করাল গ্রাসে তলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। বাড়ি-ঘর পুড়ে গেলে ভিটেটুকু থাকে। বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করা যায়। কিন্তু নদীর ভাঙনে মাথা গেঁাজার ঠঁাইও মেলে না। শুরু হয় মরণ-দশা। নদীভাঙনের শিকার হয়ে প্রতিবছর হাজারো পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। ভ‚মিহীন এ পরিবারগুলো বেড়িবঁাধের ওপর আশ্রয় নেয়া ছাড়াও জীবন-জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাতে হয় রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোতে। এ নদীভাঙনের শিকার হয়ে দূরে গিয়ে নতুন কোনো বেড়িবঁাধে বসতি গড়ে ভাঙনকবলিত মানুষ। এক সময় যাদের ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, শস্য ভরা মাঠ তারাই নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখন নগরজীবনে হতদরিদ্র মানুষের তালিকাভুক্ত হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে দঁাড়িয়েছে। বন্যা, সাইক্লোনের কারণে ব্যক্তির ক্ষতি হলেও সে জমি হারায় না। কিন্তু নদীভাঙনে মানুষ জমি, এমনকি ভিটেবাড়িও হারায়। এ সমস্যা নিরসনে নদীব্যবস্থাপনার দিকে বেশি নজর দিতে হবে। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার. ইছামতি, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খঁা, গড়াই, কণর্ফুলি, মধুমতি, সুরমা, কুশিয়ারা, পদ্মা, মহানন্দা, মুহুরী, শঙ্খ, করতোয়া প্রভৃতি নদ-নদীর ভাঙনে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে; আর এতে বাড়ছে আশ্রয়হীন পরিবারের সংখ্যা। বাংলাদেশে নদীভাঙন প্রলয়ঙ্করী দুযোের্গর মতোই বিপজ্জনক হলেও ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের অবস্থা পরিবতের্ন সরকারি কিংবা বেসরকারি পযাের্য় উন্নয়নমূলক প্রকল্প একেবারেই নামমাত্র। একদিকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি, আরেক দিকে নদীভাঙন দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সীমাহীন দুভোের্গর কবলে ফেলেছে। আর সীমান্ত নদীভাঙনে গৃহহীন মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয়। সিইজিআইএসের তথ্যানুযায়ী, নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে যারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ লোক টাকা-পয়সার অভাবে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করতে না পারায় গৃহহীনে পরিণত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ গৃহহীন ভাসমান মানুষ রয়েছে এবং প্রতিবছর এদের সংখ্যা গড়ে লক্ষাধিক করে বাড়ছে। ভাসমান এসব মানুষ সাধারণত বঁাধ, রাস্তা, পরিত্যক্ত রেল সড়ক, খাস চর বা খাস জমি প্রভৃতি স্থানে ভাসমান জীবনযাপন করে। অভাবের তাড়নায় এরা শহরমুখী হয় এবং শহরের বস্তিগুলোতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে জজির্রত হয়। ভাঙন যেখানে হয়, সেখানকার মানুষ কেন গরিব হয়ে যাচ্ছে? কারণ জমি জলে গেলে তা কোনোভাবে তারা উদ্ধার করতে পারছেন না, প্রভাবশালী কেউ সেই জমিটা নিজের নামে করে নিচ্ছেন পরবতীের্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, নদীভাঙন রোধের কি কোনো উপায় নেই? আজ নদীশাসন প্রকল্প ও তহবিল সঙ্কট বড় অন্তরায় আমলাতান্ত্রিক দীঘর্সূত্রতা আর তহবিল সঙ্কটে নদ-নদীভাঙন রোধ প্রকল্পগুলো সময়মতো আলোর মুখ দেখছে না। ভাঙন প্রতিরোধে একাধিক নদীশাসন প্রকল্প,পানি উন্নয়ন বোডর্, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকলেও নানা দীঘর্সূত্রতায় তার বাস্তবায়নে সঠিক সুফল হয়নি আজ পযর্ন্ত। কিন্তু আগ্রাসী নদীর স্রোতে ভাঙন থেমে নেই এখনো। নদীভাঙন এক প্রকার প্রাকৃতিক দুযোর্গ। এ দেশে সাধারণত বষার্কালে উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুন নদীর পানি বেড়ে যায় এবং তা প্রচÐ গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। এসময় উপক‚লীয় অঞ্চলের নদীসংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র তোড়ে সৃষ্টি হয় নদীভাঙনের। বাংলাদেশে এটা স্বাভাবিক চিত্র হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আর স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোডের্র দেয়া তথ্যমতে, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছে। আরও প্রায় ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিতে পারে। এতে কৃষি জমির এক বিরাট অংশ নদীগভের্ তলিয়ে যাবে। অথচ এর বিপরীতে যে চর জেগে উঠছে, তা অপ্রতুল। ভাঙনে গত চার দশকে দেশের প্রায় এক লাখ হেক্টর ভ‚খÐ হারিয়ে গেছে নদীগভের্। এর মধ্যে সীমান্ত নদীভাঙনে বাংলাদেশ হারিয়েছে ৫০ হাজার একর ভ‚মি। তবে সাময়িকভাবে ভাঙন ঠেকানো গেলেও তা কেন স্থায়ী সমাধান নয়? বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভুত জলবায়ু পরিবতের্নর কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বলে ধারণা করা হয় বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। নদীভাঙন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দঁাড়িয়েছে। বিশেষত জলবায়ু পরিবতর্নজনিত ঝুঁকি, বষার্ মৌসুমে নদ-নদীতে পানি বাড়া এবং নদীগুলো চ্যানেল পরিবতর্ন করায় দেশে নদীভাঙনের তীব্রতাও বাড়ছে। ফলে প্রতিবছর দেশের নদী তীরবতীর্ অসংখ্য মানুষ বসতভিটাসহ আবাদি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। এ অবস্থায় নদীভাঙনের আগাম তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরি।