বিয়ে বিচ্ছেদ ও সামাজিক অস্থিরতা

আমার চিন্তা একটা জায়গায় এসেই আটকে যাচ্ছে, তা হলোÑ এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের (যেহেতু এখন অনেকটা মহামারীর মতো অবস্থা) জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি তো কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেশি, তাহলে তাদের মেধাটাকে ব্যবহার করছে না কেন? জীবনের সব ধাপে তরতর করে এগিয়ে বৈবাহিক ধাপে উষ্ঠা খেতে দেখা যাচ্ছে অনেককেই!

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আনোয়ারা আজাদ
শেষ পযর্ন্ত বিয়েটা ওদের ভেঙেই গেল। বেশি না, তিন মাসের মধ্যেই মামলা ডিসমিস! নাই নাই করেও পঞ্চাশ লাখ টাকার মতো বাদ্য বাজনাসহ খরচাপাতি করে অবশেষে তিন মাসের মাথায় গিয়ে টা টা বাই বাই! নাহ্, একেবারে যা তা ফ্যামিলির ছেলে/মেয়ে! থাকা সম্ভব নয়। ওরা যতটুকু বলে, গাজির্য়ানদের পালে বাতাস লাগানো আরও তিন মাত্রা বেশি! ছেলের/মেয়ের মা-টা এত বাজে বকে যে সহ্য করা যায় না। মানলাম আমাদের ছেলের/মেয়ের একটু মেজাজ বেশি, অসহিষ্ণুও অনেকটা, তাই বলে ওদেরটাও কম, একশ গুণ বেশি বজ্জাত!’ এরকমটাই এখন বেশি হচ্ছে। এসবই শুনছি প্রতিনিয়ত। রিলেশনগুলোর মধ্যে ব্রেকআপ ট্রেন্ড চলছে এখন। প্রতিদিন বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ জমা হচ্ছে জায়গামতো। বিস্তর লেখালেখিও হচ্ছে এসব নিয়ে, পড়তে পড়তে নিবার্চন নিয়ে মাথায় জট পাকানোর অবস্থা উবে গিয়ে এটাই জেঁকে বসছে এখন! এমনকি ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভয়াবহ সমস্যাটাও মাইনর হয়ে গেছে! আহ-হারে, জঁাকিয়ে সংসার করতে পারছে না পোলাপানগুলো! সংসার গড়ে উঠছে না! সংসার করতে পারছে না বলে সামাজিক স্ট্রাকচারও বদলে যাচ্ছে। শেষ পযর্ন্ত এই স্ট্রাকচার কেমন আকার ধারণ করে পুরোটা অঁাচ করতে না পারলেও আংশিক করা যাচ্ছে অবশ্যই। বিয়ের আগের ফ্যান্টাসি তিন মাসও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকের শুনেছি তিনদিনেই ঠুস! তারপরেই মাথা খারাপের মতো অবস্থা! সিরিয়ালগুলোয় দেখা ফকির-মকিরের কাছে তাবিজ-টাবিজ নেয়ার জন্য ছুটছে! ভাবা যায় কী ভয়াবহ অবস্থা? শিক্ষিত পোলাপান সব! একা হয়ে যাওয়ার পর হুঁশ ফিরছে। এটা ভালো কী মন্দ, নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না! যদিও অনেকেই মত দিচ্ছেন, মারামারি করার চেয়ে ব্রেকআপই ভালো! হ্যঁা, অবশ্যই মারামারি করার চেয়ে ব্রেকআপ ভালো। তবে সবাই তো মারামারি করে না, সামান্য ঠুনকো ব্যাপার নিয়েই শুরুটা তৈরি করে ফেলে। আমাদের এক বান্ধবীর বিষয়টা জানি বলেই লিখতে হচ্ছে আজ। বান্ধবীর বিয়ের প্রথম ঈদে তার বর তাকে কোনো উপহার মানে শাড়ি-কাপড় দেয়নি বলে বান্ধবীর মা আর কোনোদিন ওই বাড়িতে পাঠায়নি তাকে। সেই বান্ধবী এখনো একাই রয়ে গেছে। ভাবা যায়? সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই এটা নিয়ে নানা গবেষণায় মাথা ঠুকে মরছেন, দিক-নিদের্শনা দিচ্ছেন, ফলাফল সেই মোকদ্দমা আর পঞ্চাশ লাখ টাকার গচ্চা! উপহার-টুপহার যেটুকু পাওয়া যায় মেরেকেটে পঁাচ লাখ উঠে আসে বলে মনে হয় না। শখের বারোভাজা! ইস্স, এই পঞ্চাশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে রাখলে মাসে চল্লিশ হাজার টাকা ইন্টারেস্ট চোখ বন্ধ করে পাওয়া যায়! যাদের অনেক কষ্ট করে এই টাকা জোগাড় করে স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য সব কিছু অ্যারেঞ্জ করতে হয় তাদের জন্য বলা। কালো টাকার হরিলুট যাদের অ্যাকাউন্ট উপচে রেখেছে এসব ফকিরা হিসাব-নিকাশ তাদের না করলেও চলবে! কিন্তু আমজনতার এসব হিসাব-নিকাশ না করলে চলবে? শেষে কৃষক গণি মিয়ার মতো অবস্থা যে! বাট্রার্ন্ড রাসেল তার ‘দি কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থে পরিবার, সুখ, দুঃখ, প্রতিযোগিতা, পাপবোধ, উপভোগ, ক্ষমতা ইত্যাদি নানা বিষয়, যা কিনা মানুষের জীবনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো ওঠানামা করে। সব বিষয় নিয়েই ঝেড়েপুছে বলেছেন তিনি, বাদ যায়নি যৌনতার বিষয়গুলোও। এগুলো জড়িয়ে ও চচার্ করেই মানুষ বেড়ে ওঠে, একটা সময়ে নিজস্ব দশর্ন তৈরি করে পালন করতে করতে মরে ভুত! মরে গেলেও কিছু মানুষের দশর্ন বেঁচে থাকে, যা থেকে অন্যরা জ্ঞান অজর্ন করে। অবশ্য নিজস্ব দশর্ন তৈরি হওয়ার সময় যার যার অবস্থানে অটল থেকে কিছুটা ঘাপলা বঁাধায়! এতে কী হয়? নৈরাশ্যবাদ তৈরি হয়, দুঃখ তৈরি হয়, উপভোগের মাত্রার রকমফের হয়, জোর করে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চায় ফলে আসল যে লক্ষ্য, যে জিনিসটি মানুষের প্রয়োজন, ‘সুখ’, সেটি দরজা দিয়ে ঢোকারই পথ পায় না! সুখও যে সৃষ্টি করতে হয়, কয়জনের মাথায় ঢোকে? যুগ যুগ ধরে বিয়ে, সংসার এসবের মধ্যেই জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব ঘাপটি মেরে বসে আছে। যার যার জীবন তাকেই আবিষ্কার করে নিতে হয় সুখ ও মুক্তি। জীবনযাপনে মুক্তি না হলে সুখ আসে নাকি! ইদানীং প্রতিযোগিতা ও অহমিকার মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে, উপভোগের ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে জীবন বিষিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সুখ তাদের আশপাশে উঁকি দেয়ারও সাহস পাচ্ছে না! আমাদের জীবনের একটা বড় উদ্দেশ্য তো সুখ অজর্ন করা, নয়কি? টাকা-পয়সা, নাম-খ্যাতি যাই থাকুক না কেন, সুখ ছাড়া সব ফক্কা! কিন্তু কোথা থেকে জানি ¯েøা-মোশনে এই দুটো জিনিস শিরায় শিরায় ঢুকে দিশাহারা করে দিচ্ছে। প্রতিযোগিতা ও অহমিকার মিথস্ক্রিয়ায় সিক্ত হয়ে জীবনকে আনন্দহীন ও নিদ্রাহীন করে দিচ্ছে। অতঃপর মানুষ নৈরাশ্যবাদে ডুবে যেতে যেতে মৃত্যু চিন্তায় সময় কাটাচ্ছে! ফলে আত্মহত্যার সংখ্যাও বেড়ে গিয়ে সমাজকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অথচ মৃত্যু চিন্তায় যে সময়টুকু ব্যয় হয় সেই সময়টাতে সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করার ভাবনা মানুষকে প্রফুল্ল করে, মুক্তির স্বাদ এনে দেয়। এই সত্যটা বুঝতে পারলে, প্রতিযোগিতার ভুত মাথা থেকে তাড়াতে পারলে জীবনটা অনেকটাই হালকা মনে হতে বাধ্য। আমার চিন্তা একটা জায়গায় এসেই আটকে যাচ্ছে, তা হলোÑ এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের (যেহেতু এখন অনেকটা মহামারীর মতো অবস্থা) জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি তো কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেশি, তাহলে তাদের মেধাটাকে ব্যবহার করছে না কেন? জীবনের সব ধাপে তরতর করে এগিয়ে বৈবাহিক ধাপে উষ্ঠা খেতে দেখা যাচ্ছে অনেককেই! বুঝলাম সব বাদ দিলেও পাসোর্নালিটিতে এসে ঠোকর লেগে যাচ্ছে, তো, এরা এরকম একটা অধ্যায়কে কীভাবে সফল করে তুলতে হবে সেটাতে মনোযোগী হচ্ছে না কেন? আর যদি মনোযোগী না হতে চায়, মানে তেমন গুরুত্বপূণর্ মনে না হয়, তাহলে প্রথম থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে না কেন? কেন এসব পুরনো সামাজিকতা থেকে বের হয়ে শান্তিপূণর্ নতুন পথ বের করতে পারছে না? বিয়ের তিন মাস আগে থেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের ঘুম হারাম করে (তাদের দেয়ার জন্য শপিংমলগুলোতে হয়রান হয়ে সবাই গিফট খঁুজে বেড়ায়), হলুদের অনুষ্ঠানে নিজেরাও (পাত্র-পাত্রী) নেচে কুদে হুলস্থুল করে বিয়ের তিন মাস পূরণ হওয়ার আগেই ডিভোসর্ পেপারে সাইন করা শেষ! সবাই যখন কেবল খেঁাজ নেয়া শুরু করেছে যে তাদের দাম্পত্য কেমন চলছে! ততক্ষণে বেচারা বর-বধূ আবার সিঙ্গেল! সামলে নিলে তো ভালো কিন্তু পুরো পরিবারকে যদি অস্থির করে তোলা হয়, তাহলে ভাবার কথা। এসব দেখে-শুনে মনে হয়েছে যে, বিবাহপূবর্ একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। আজকাল বাবা-মায়েরা চাকরিজীবী হওয়ার কারণে তাদের দাম্পত্য, প্রেম-ভালোবাসা দেখার সুযোগ ছেলেমেয়েদের বোধহয় তেমন একটা হয় না ফলে সেই জায়গাটা শূন্য থেকে যাচ্ছে। বিষয়গুলোর গভীরতা অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। স্টেপ বাই স্টেপ ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য তাই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। খুঁজলে নিশ্চয় পথ আবিষ্কার হয়ে যাবে। শান্তির পথ, সুখের পথ। প্রেম-ভালোবাসায় সিক্ত দুজন মানুষ দেখতে আমরা ভালোবাসি। যত যাই বলি না কেন, প্রেম ছাড়া জীবন অথর্হীন, সবাই বোঝে। প্রেম-ভালোবাসা থেকে বের হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, মানুষের শিরায় শিরায় প্রেম, এ জন্মগত। আর, একা একা জীবন কাটানোও কি সম্ভব? মা-বাবা কী সারাজীবন থাকে, সাপোটর্ দেয়ার জন্য? বন্ধু-বান্ধবরা, বন্ধুই, পাটর্নার নয়। জীবনে পাটর্নার লাগেই। আবার পাটর্নার থাকা মানেই শুধু ‘বেড অব রোজেস’ নয়। কঁাটাও থাকে। কঁাটাটাকেও স্বীকার করে নিতে হয়। একেবারে তেল আর জল হলে অন্য কথা। তখন টা টা বাই বাই না বলে উপায় নেই। জীবনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে ধৈযর্ ও ত্যাগের ভ‚মিকা অনস্বীকাযর্। খুব সহজে যে বস্তু হাতের মুঠোয় চলে আসে তার মূল্য বুঝতেও ভুল করে অনেকে। এখানেই গোল বঁাধে। অহেতুক দুঃখ সৃষ্টি করে, একটা ক্রাইসিস তৈরি করে। এটা এক সময়ে স্বভাবেও পরিণত হয়। এটা এক ধরনের বিলাসিতাও বটে! অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়। তাই অস্থির না হয়ে অসহিষ্ণু না হয়ে একটু ধৈযর্ ধরতে হয়। কারণ দীঘর্স্থায়ী কোনো কিছু পেতে চাইলে সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। হুটহাট সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাই একটু সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুবই জরুরি। আনোয়ারা আজাদ: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট