শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
নির্বাচনোত্তর মিয়ানমার

সু চির বিজয় ও সেনা সমর্থিত দলের আসন হ্রাস কী বার্তা দিচ্ছে

পার্লামেন্টের অধিবেশন বসার আগে মোটা দাগে দুটি নতুন ঘটনা ঘটেছে। এর একটি হলো স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এ মাসের ৫ তারিখে 'নিউ পিস আর্কিটেকচার' নামে তার এক নতুন সমঝোতা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। মিয়ানমার পোস্ট অনলাইন জানাচ্ছে, তিনি দেশের শান্তি প্রক্রিয়ায় একটি নতুন 'অ্যাপ্রোচ' এনেছেন, যার নাম দিয়েছেন 'নিউ পিস আর্কিটেকচার'। তিনি চান রাজনৈতিক দল বা গ্রম্নপগুলো, সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন সংগঠন এবং সর্বসাধারণ এতে অংশ নিক।
আহমদ মতিউর রহমান
  ১২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আগামী ১ ফেব্রম্নয়ারি মিয়ানমারের নতুন পার্লামেন্টের অধিবেশন বসতে যাচ্ছে। গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেশটির ডিফেক্টো নেত্রী তথা স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিশাল বিজয় অর্জন করে টানা দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় বসছে। দেশটা যেহেতু আর্মি কবলিত, ডেমোক্রেসির কথা বলা হলেও এনএলডি ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া সত্ত্বেও ডেমোক্রেসি চালু করতে পারছে না। পদে পদে আর্মির বাধা। সেই কারণে দলের প্রধান সু চি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারছেন না, তার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে নতুন পদ স্টেট কাউন্সেলর। আরাকান থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন ও এই সমস্যার জাতিসংঘের দেওয়া ফর্মুলায় সমাধানের রাস্তায় 'গণতন্ত্রপন্থি' নেত্রী সু চি যাচ্ছেন না। এজন্য তাকে কম অপমানের জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে না। তাকে দেওয়া বহু পুরস্কার ফিরিয়ে নিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। দাবি উঠেছে নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গা। এ পরিস্থিতিতেও গুটিকয়েক রোহিঙ্গা যারা আসতে সক্ষম হয়নি, রাখাইন রাজ্যে, ইয়াঙ্গুনে তাদের উপর চলছে অ্যাট্রোসিটিজ মানে নির্যাতন। এনএলডি গণতন্ত্রী হতে পারছে না সেনাবাহিনীর কারণে। তারা সরকারে, পার্লামেন্টে, অন্যান্য রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের বডিগুলোতেও বিনা ভোটে কোটার মাধ্যমে ঢুকে ভাগ বসাচ্ছে আর কার্যত ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন নির্বাচনে এনএলডি আগের চেয়ে বেশি আসন পেলেও অবস্থার যে পরিবর্তন হবে তেমন কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। সেনা সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) আসন সংখ্যা কমে গেছে। তারা নির্বাচনে অনিয়মেরও অভিযোগ তুলেছে। এবার দেখে নেওয়া যাক ইউনিয়ন অ্যাসেমবলি বা পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে তাদের আসন সংখ্যা। নির্বাচন হয়েছে এমন ৪৭৬টি আসনের মধ্যে এনএলডি পেয়েছে ৩৯৬টি আসন (৮৩ শতাংশ)। ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৩৩টি আসন (প্রায় ৭ শতাংশ)। এ দলের ক্ষোভের কারণটা বোঝাই যাচ্ছে। এছাড়া শান ন্যাশনালিটিজ লীগ ফর ডেমোক্রেসি পেয়েছে ১৫টি আসন, অন্য ১০টি ছোট দল পেয়েছে ৩২টি আসন। এসব দলের মধ্যে আছে দুটি রাখাইন পার্টি, দুটি কাচিন পার্টি, তাং, মন, পা-ও, কিয়াথ ওয়া জোমিরা একটি করে আসন পেয়েছে। মোট ৯০টি দল নির্বাচনে অংশ নেয় এবং মাত্র ১৩টি দলের প্রার্থীরা উভয় কক্ষে জয়ী হয়। বাকি দলগুলো কোনো আসনে জেতেনি।

ইউনিয়ন বা কেন্দ্র, স্টেট ও আঞ্চলিক আইনসভায় ১১১৭ আসনে নির্বাচন হয়। তার মধ্যে এনএলডি পেয়েছে ৯২০টি (৮২ দশমিক ৩ শতাংশ)। আর ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৭১টি আসন (৬ দশমিক ৪ শতাংশ)। ২০১৫ সালের নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল ১০ শতাংশ আসন। এ হারের কারণে দলটির প্রধান ইউ থান তায়ে ভোটে কারচুপি ও মারাত্মক অভিযোগ এনে এক ভিডিও বার্তা প্রচার করেছিলেন। তিনি পুনর্নির্বাচনও দাবি করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাতে কান দেয়নি।

২০০৮ সালে পাসকৃত সংবিধান অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্টের অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মিয়ানমারের দি ইরাবতী পত্রিকা জানাচ্ছে, পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের স্পিকাররা অধিবেশনের তারিখ সেই মতে নির্ধারণ করেছেন। তারা পার্লামেন্টের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক ঘোষণায় বলেন, বর্তমান অ্যাসেমবলির মেয়াদ শেষের একদিন পর অধিবেশন ডাকা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি বর্তমান অ্যাসেমবলির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। নতুন পার্লামেন্ট অধিবেশনে বসার পর উভয় চেম্বারের স্পিকার নির্বাচন হবে। এর পর নির্বাচন হবে ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং নিয়োগ দেওয়া হবে নতুন মন্ত্রীদের। ইউএসডিপি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ আনলেও সামরিক বাহিনী পার্লামেন্টে তাদের ২৫ শতাংশ কোটায় ১৬৬ জন নতুন মনোনীত সামরিক বাহিনী সদস্যের নাম প্রকাশ করেছে। তাদের মধ্যে তিন জন মেজর জেনারেল ও ২১ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার অফিসার রয়েছেন। পার্লামেন্টের সব কক্ষে ২৫ শতাংশ এবং মন্ত্রিসভায়ও সেনাবাহিনীর কোটা রয়েছে।

পার্লামেন্টের অধিবেশন বসার আগে মোটা দাগে দুটি নতুন ঘটনা ঘটেছে। এর একটি হলো স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এ মাসের ৫ তারিখে 'নিউ পিস আর্কিটেকচার' নামে তার এক নতুন সমঝোতা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। মিয়ানমার পোস্ট অনলাইন জানাচ্ছে, তিনি দেশের শান্তি প্রক্রিয়ায় একটি নতুন 'অ্যাপ্রোচ' এনেছেন, যার নাম দিয়েছেন 'নিউ পিস আর্কিটেকচার'। তিনি চান রাজনৈতিক দল বা গ্রম্নপগুলো, সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন সংগঠন এবং সর্বসাধারণ এতে অংশ নিক।

\হতিনি আরও চান- নেশনওয়াইড সিসফয়ার এগ্রিমেন্টে (এনসিএ) স্বাক্ষর করেনি এমন পক্ষগুলোও এতে শামিল হোক। ১০টি দল এনসিএতে স্বাক্ষর করে। ২০২২ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকে সামনে রেখে তার এ কর্মসূচি।

সু চির সরকার নরদার্ন এলায়েন্স নামে পরিচিত চারটি দলের একটি জোটের সঙ্গেও আলোচনার প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। এ এলায়েন্সের দলগুলো হলো কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও আরাকান আর্মি (এএ)। সবই সশস্ত্র শাখা। আলোচনার লক্ষ্য হলো- তাদের সঙ্গে দলগতভাবে দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করা। খুবই ভালো ও নতুন উদ্যোগ সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্ব সংস্থাগুলোর মাথাব্যথার বড় কারণ যে রোহিঙ্গা ইসু্য, তার ব্যাপারে কোনো কিছু বলা নেই। এখানে থাকা আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের কোনো পক্ষ নয়। আরও একটি কথা স্মরণযোগ্য, রাখাইন স্টেট ও চিন স্টেটের পালেথাতে দুই বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী (তাতমাদো) এবং আরাকান আর্মি গত নভেম্বরে একটি 'আনঅফিশিয়াল' বা অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এর পর তাদের হাতে আটক তিন জন সাবেক এনএলডি প্রার্থীকে মুক্তি দেয়। একই দিনে বর্মি সেনাবাহিনীও আরাকান আর্মির তিন জন সেনাকে মুক্তি দেয়।

দ্বিতীয় ঘটনা বা খবরটি হলো- চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর মিয়ানমার সফর। দি ইরাবতীর আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে মি ওয়াং মিয়ানমার সফর করবেন। মাসের শুরুতে এ সফরের আভাস দেওয়া হলেও কোনো তারিখ দেওয়া হয়নি। তিনি এখন তাঞ্জানিয়া সফর করছেন। তার মানে সফরটি এখনো হয়নি। মি. ওয়াং কি আলোচনা করবেন সে প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইরাবতী আভাস দিয়েছে, সফরকালে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে এনএলডি সরকারের দায়িত্বপালনের বিষয়ে তাদের সমর্থন সহযোগিতার আশ্বাস দেবেন, করোনার কারণে পিছিয়ে পড়া চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর (সিএমইসি) নির্মাণ কাজে গতি ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেবেন, যা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) ইনিশিয়েটিভের অংশ। তিনি আরও বলেন, আলোচনায় রাখাইনে যেসব সমস্যা রয়েছে সেসব ইসু্যও থাকতে পারে। মি. ওয়াং ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছেন। নির্বাচনের পর মিয়ানমারে এটাই হবে কোনো বিদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর। দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইসু্য মিয়ানমার এড়িয়ে যেতে চাইলেও সেটা অন্যভাবে হলেও এসে যাচ্ছে। চীন কতখানি করতে পারবে এ ব্যাপারে ভাষ্যকাররা সন্দিহান। তবে আলোচনা হওয়াকে তারা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। নতুন মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর সু চির রিকনসিলিয়েশন প্রসেস কতখানি অগ্রসর হয় আর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরেই বা কি হয় তা দেখতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

আহমদ মতিউর রহমান : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে