প্রবাসীদের স্বপ্নের সারথী কেউ হয় না!

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

রিফাত কান্তি সেন চঁাদপুর সরকারি কলেজ
নিজের স্বপ্নকে মেলে ধরতে দেশ ছেড়ে জীবিকার টানে বিদেশে গমন। রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যে অথর্ কামান সেটাও পাঠিয়ে দিতে হয় দেশে। কি রৌদ্র, কি বৃষ্টি কাজ থেমে নেই। মাঝে মাঝে নিজের জীবনটাও অকালে চলে যায়। ফিরে না আর পৃথিবীতে। শত কষ্ট, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা সহ্য করে আপন জনের মুখে হাসি ফুটাবার তাগিদে দিনের পর দিন কলুর বলদের মতো খেটে চলেছেন দিবস, রজনী। সেই মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের খবর কজনাই বা রাখে। বলছিলাম প্রবাসীদের কথা। দেশে কাজ না পেয়ে অনেকেই ছুটছেন প্রবাসে। দেশের মায়া-মমতা ত্যাগ করে আপনজনদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশে যাত্রা। অতঃপর ভিনদেশে কষ্টের জীবন। তবু কী তাদের সুখ তাদের কখনো ধরা দেয়? প্রিয় পাঠক, তেমনই একটি গল্প তুলে ধরলাম আপনার সামনে। কারো জীবনের সঙ্গে মিলে গেলে লেখক দায়ী নন! রমজান মিয়া (ছদ্মনাম) থাকেন মধ্যেপ্রাচ্যের একটি দেশে। ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সবই আছে তার। সংসারের হাল ধরতে গিয়েছেন বিদেশে। নিজের ভাগ্য বদলের আশায় প্রবাসে গেলে ও ভাগ্য তার সঙ্গে করছে নিষ্ঠুর আচরণ। অথর্ কামালেও তার মাঝে নেই সুখ। প্রচÐ চাপা কষ্ট বিরাজ করছে তার মনে। ছেলে এবার মাধ্যমিকের গÐি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। বায়নার শেষ নেই। এটা দেও, ওটা দেও কত রকমের যে বায়না। বেচারা বায়না মিটাতে মিটাতে অস্তির প্রায়। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও সন্তানদের মানুষ করার জন্য সব আকুতি-মিনতিই মেনে নেন তিনি। মেয়ে এবার মাধ্যমিকের ছাত্রী। বায়নার শেষ তারও কম নয়। স্ত্রী তো যেন মনে করেন তিনি টাকার মেশিন। মাস না শেষ হতেই ফোন আর ফোন। তখন যেন ভালোবাসা তিনগুণ বেড়ে যায়। বাবা, ভাই, বোন, আপন আত্মীয়জন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব কত লোকের যে আবদার এখন রমজান আলীকে মেটাতে হয় তার খবর কে ই বা রাখে। সকলের আবদার মেটাতে গিয়ে বহু বছর দেশে ফেরা হয়নি তার। মায়া-মমতায় জড়ানো এ দেশটাকে ছেড়ে স্বপ্নের বাগান গড়তে ছুটে গিয়েছেন প্রবাসে। আসলেই কী ঐ প্রবাসীর স্বপ্নের সারথী আজও কেউ হয়েছে? অনেক বন্ধুই এখন আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। আবদার যে মেটাতে পারেননি! এমনকি অনেক আত্মীয়স্বজনও দিন-রাত গালাগালি করেন। কিন্তু সে মানুষটা ভালো আছে কী না সে খবরটা আদৌ কেউ জানতে চায়নি। একমাসে টাকা না পাঠালে স্ত্রী, সন্তানদের অভিমান চরমে। বেতন পেয়েছে কি না সে খবরটা নেয় না প্রয়োজনে ধার করে হলেও পাঠাতে হবে টাকা তাদের। ছেলে, সন্তান পরিজন সবাই মিলে দেশে ফুতিের্ত থাকলেও বিদেশের মাটিতে রমজান আলী আছেন বহু কষ্টে। শধু কী বিদেশেই কষ্ট? না এবার দেশের কষ্টের পথে আসা যাক। এক দশক পর দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তিনি। লাগেজ ভতির্ মালামাল। এয়ারপোটর্ এর ঝক্কি-ঝামেলা সামলে বাড়ি ফেরার পালা। সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন, কী এনেছেন তিনি! কেউই জিজ্ঞেস করেনি কেমন আছে! বাড়ি ফেরার পর সকলের চাহিদা অনুযায়ী জিনিসপত্র পেঁৗছে দিয়ে শূন্য লাগেজটাকেই সঙ্গী হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বুক ফেটে কান্না রোল উঠবে, কিন্তু লোক লজ্জার ভয়ে কান্না যে করতে পারছেন না তিনি। এজন, সেজন কত লোকে যে অনুদানের জন্য ভিড় জমাবে। আসলেই কী তিনি দাতা হয়ে গেছেন? তিনি বিদেশ করছেন বলে কী মহাকাশটা কিনে ফেলেছেন? এমন প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খায় তার মনে। কিন্তু সমাজের কাছে ছোট না হতে চাইলে তো আবদার যেভাবেই হোক মেটাতে হবে। সবাই শুধু দেখা হলেই তাকে জিজ্ঞেস করে কবে আবার ফিরবে বিদেশের মাটিতে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন তিনি। যে মাটির টানে বহু বছর পর দেশে ফিরেছেন। আলো-বাতাসে নিজের দেহটাকে ভাসিয়েছেন। যে দেশটার জন্য হাজার হাজার টাকা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অথর্নীতিকে চাঙ্গা করেছেন। সে দেশের লোকেরাই কিনা তাকে বলছে, এ দেশ ছেড়ে কবে যাবে ভিনদেশে। তিনি যেতে চান না, একথা সবাই অগ্রাহ্য করলেও ঠিক একজন করেন না। তিনি ‘মা’। মা বলে বাবা তোর আর বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই। তুই দেশেই থেকে যা। সবাই স্বাথর্পর হলেও তিনি হননি। এবার আরেক তরুণের গল্প শোনা যাক। আবদুর রহিম (ছদ্মনাম)। দেশে চাকরি না পেয়ে গিয়েছেন প্রবাসে। টাকা কামাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এতে নেই কোনো তৃপ্তি। ঘরের বড় বলে সমস্ত টাকা সংসারের পেছনেই ব্যয় করছেন। দেখতে দেখতে ৮ বছর হয়ে গেল প্রবাসজীবন। দেশে থাকতে ভালোবাসতেন গ্রামের নীলা আক্তার (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণীকে। স্বপ্নকে সাজাতে গিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন দূর প্রবাসে। কে জানতো ভালোবাসা এতটা নিষ্ঠুর। যাওয়ার ক’মাসের মধ্যেই ভালো ঘরে বিয়ে হয়ে যায় নীলার। দেশে ফিরে দেখা করতে চান তার সঙ্গে। পরিবার-পরিজন সকলেরই চাহিদা মিটিয়ে নিজের জীবনটা শুধু শূন্যের খাতায়ই রেখে দিয়েছেন তিনি। বুক ফাটা আতর্নাদ, যেন দেখার কেউ নেই। প্রবাসজীবনে কষ্টের কথা কাউকে না বললেও এবার মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন আর যাবেন না বিদেশে। ঐদিকে এ খবর পরিবারে জানাজানি হলে শুধু মা-ই বারবার বলছিলেন, ‘থেকে গেলে হয় না বাবা’। একমাত্র জগত জননী চায় ছেলে দেশে থাকুক, মায়ের কোলে থাকুক। অন্যদিকে স্বাথর্পর দুনিয়ার মানুষগুলো নিজেদের স্বাথের্র জন্য অন্যকে দূরে ঠেলে দিতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ভাই, বোন, বাবা, বন্ধুবান্ধব সবাই যেন শুধু দিতে পারলেই খুশি। ওই ছেলেটার মনের অবস্থা কেউই বুঝতে চাইল না। প্রবাসীদের যেন স্বপ্ন থাকতে নেই। জীবন-যৌবন টাকার পেছনে ছুটে বড় ক্লান্ত তারা। নিজ দেশে, নিজ মাটিতে এসে একটু শান্তির পড়শ অঁাকবে সেখানেও বঁাধা। দুনিয়াটা যেন মস্ত বড় স্বাথর্পরের কারখানা হয়ে গেছে। এখানে শুধু স্বাথর্পরদেরই বসবাস। বছরে দু’বার ঈদ এলেও সে ঈদটা যেন বিষাদময় হয় প্রবাসীদের। নিজ আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজনকে রেখে ঈদ উদযাপন করাটা খুবই কষ্টের। কিন্তু তারা কী এটা বুঝে? রোজা অধের্ক গেলেই তো পরিবারের লোকজন মাকেির্টংয়ের টাকা পাঠানোর জন্য গরমা-গরমি দিতে থাকেন। কিন্তু রোজা থেকেও যে প্রচÐ তাপদাহে কাজ করছেন সে চিন্তাটা কটা পরিবারই বা করে! প্রবাসী মানুষগুলো দিনের পর দিন শুধু খেটেই যাচ্ছে, বিনিময় শুধু লাঞ্চনা আর বঞ্চনাই পাচ্ছে। অতপর প্রবাসীরা ভালো থাকুক। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেই আমাদের অথর্নীতির চাকা হয় বেগবান। আমরা সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছি। সম্মান করা উচিত সব প্রবাসী ভাইদের। আর কোনো প্রবাসী ভাই যেন দুঃশ্চিন্তা করে বিদেশের মাটিতে প্রাণ না হারায় সেই কামনা। ভালো থাকুক প্রবাসীরা।