শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আসুন, বিবেকের আদালত জাগ্রত করি

উন্নত মানুষ হতে হলে আমাদের আচারণে ও জ্ঞানচর্চায় উন্নত হতে হবে। বর্তমান প্রজন্ম নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষে পরিণত হচ্ছে। যা চারদিকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এর জন্য মূলত আমরাই দায়ী! আমরা ক্রমাগত অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছি।
আশিকুর রহমান
  ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

জীবনযুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পথে আমরা সবাই ভুল করি। মানুষ হিসেবে আমরা কেউই শতভাগ পারফেক্ট নই। সবার মধ্যেই অনেক দুর্বলতা আছে, অজ্ঞতা আছে। এখন আমরা যদি সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চাই, তাহলে আত্মসমালোচনার কোনো বিকল্প নেই। এটি অনেকটা আয়নার মতো। আয়নায় যেমন আমরা প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক কার্যাবলি সঠিক না বেঠিক তা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি। জটিল অঙ্কের হিসাব মেলাতে যেমন বারবার চেষ্টা করতে হয়, তেমনি জীবনের হিসাব মেলাতে হলে ব্যক্তিজীবনের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। নতুবা পালহীন নৌকার মতো জীবন উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে থাকে। আরবিতে একটা প্রবাদ আছে, 'সবচেয়ে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বা বিচক্ষণ মানুষ হলো ওই ব্যক্তি যে নিজের দোষ-ত্রম্নটি দেখে।' কিন্তু আমরা অন্যের ভালো-মন্দের বিচার যেভাবে করতে পারি, সেভাবে নিজের বিচার করি না। এমন মানুষ কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা অন্যের দোষ-ত্রম্নটি উদঘাটনের পূর্বে আত্মসমালোচনা করেন। অধিকাংশ মানুষ নিজে ভ্রান্তির মধ্যে ডুবে থেকে অন্যের সংশোধনে বেশি উদগ্রীব! অন্যের দায়িত্ব যেন তার কাঁধে পড়েছে। আমরা প্রকাশ্যে অন্যের সমালোচনা করি আবার নিজেও তাতে লিপ্ত হই। যেন আমি ছাড়া পৃথিবীর সবাই খারাপ। নিজেকে উপেক্ষা করে শুধু অন্যের দোষ চর্চা করলে সমাজে পরিবর্তন আসে না। নিজেকে আবিষ্কার করতে পারাই বুদ্ধিমানের কাজ। এজন্য গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, 'নো দ্যাই সেলফ'। এই কথাটি জীবন চলার চাবিকাঠি। নিজেকে জানার চেষ্টা করলেই প্রকৃত সার্থকতা পাওয়া যায়। সত্য আমাদের ডাকে সাড়া দেয়। সমাজব্যবস্থা পরিশুদ্ধ ও উন্নত হয়।

আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যর্থতার বোঝা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিই। পরীক্ষায় আমাদের আশানুরূপ ফলাফল না হলে শিক্ষকের দোষ, প্রতিষ্ঠানের দোষ, সিস্টেমের দোষ। অথচ পড়াশোনা না করে দিনরাত যখন ভবঘুরে হয়ে সময় নষ্ট করি, সেটা বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা বা নেশার জগতে ডুব দেওয়া অলস ছেলেটাও একসময় বেকার হয়ে সিস্টেমের দিকে আঙ্গুল তোলে। সমাজব্যবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। বিশ্বায়নের তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ যুগে অন্যের সমালোচনা করে এলে কোনো লাভ নেই। আলোকিত মানুষ হওয়ার চেষ্টায় সবাই তৎপর। কেউ আপনার নায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বসে নেই। নিষ্ঠুর এ পৃথিবীতে আপনাকে নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে। হতে হবে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। অন্যথায় এ সমাজ আপনাকে গণ্য করবে না। আমরা সবাই সিস্টেমের দোষ দিই। অথচ সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য কতটুকু ভূমিকা রেখেছি আমরা? পরিবার, রাষ্ট্র থেকে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথার্থভাবে মানার চেষ্টা করি আমরা! আমরা নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করি না অথচ স্বপ্ন দেখি পৃথিবী বদলে যাবে। এটা কী আদৌ সম্ভব? পরিবর্তনের জন্য দরকার পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক মানুষ। আর যিনি নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ করেন, তিনিই দেশপ্রেমিক। বিভিন্ন চেতনার বুলি আউড়ে, চাটুকারিতা করে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের চেয়ে যারা নিজের কাজটা একাগ্রচিত্তে করে যান, তারাই সোনার বাংলার সোনার সন্তান।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এদেশে ক্যারিয়ার নিয়ে সবাই কমবেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন। অথচ কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ার গড়তে কতজন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন! বেশিরভাগই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর বৈষম্যের দিকে আঙ্গুল তোলেন। আসলে মানুষ বলে কাজ কোথায় আর কাজ বলে মানুষ কোথায়? যার দরুন আমরা বিদেশ থেকে প্রতি বছর মানুষ ভাড়া করে তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা করে দিই। বর্তমানে টিকে থাকতে হলে দরকার বৈশ্বিক প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলতে পারলে আপনার অবশ্যই কদর আছে। আমাদের মেনে নিতেই হবে, ছোট্ট এ দেশটাতে সবার কর্মসংস্থান করা মোটেই সহজ নয়। এর কর্মবাজারে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হবে। হঁ্যা, সমাজে অনেক অন্যায্য বিষয় স্থান পেয়েছে, অনেক অযোগ্য মানুষ যোগ্য স্থানে বসে আছে। কিন্তু কেন জানি না, আজকের বিপস্নবী ছাত্রটায় আগামী দিনে দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। আজকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চারি জনতার কেউ কেউ পরবর্তীতে ধর্ষকে পরিণত হন। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ তোলা মানুষটাই এক সময় এগুলোর পৃষ্ঠপোষক হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নীতিবাক্য আর ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা ছেলেটাও চুপিচুপি পর্নোগ্রাফি দেখায় মত্ত হয়। তাহলে কী বলা যায়, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সাধু, যতক্ষণ না সুযোগ পায়। সেদিন এক হাসপাতালে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দেখি দীর্ঘ লাইনে শত শত রোগী ও তার স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দেখলাম এক ভদ্রলোক চুপিচুপি ১০০ টাকা দিয়ে দ্রম্নত সিরিয়াল নিয়ে নিল। অথচ সেখানে অনেক মুমূর্ষু রোগীর সমাগম ছিল। এটা কী শুধু সে করেছে! আমাদের অনেকেই এমন পন্থা অবলম্বন করে। অথচ সেই আমরাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুলি আউড়াই। মূলত ক্ষমতা আর সুযোগ দিলে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে প্রকৃত আবিষ্কার করা যায়।

নোংরা রাস্তা দেখলে আমরা সমালোচনা করতে শুরু করি, আবার আমরাই অসতর্ক হয়ে বা ইচ্ছে করেই উচ্ছিষ্ট বস্তু ফেলি চলার পথে। এমন যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা মানুষটাও একসময় দোষ দেয় সিস্টেমকে। করোনায় অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃতু্যবরণ করছে। অথচ আমরা কতজন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি নিজের বিবেককে প্রশ্ন করলেই উত্তর মেলে। সামাজিক দূরত্বের লেশমাত্র নেই এদেশে। আমরা সবাই নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাবার প্রাপ্তির প্রত্যাশা করি। অথচ বাজারে গিয়ে কৃত্রিম আকর্ষণীয় রঙের ফল না হলে আমরা কিনতে চাই না। রাস্তা-ঘাটে আমরা অন্যের মা-বোনের দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করি অথচ আমাদের পরিবারের সঙ্গে এমনটা হলে ক্ষুব্ধ হই। আমরা এমন অনেক দিকনির্দেশনা ও বক্তব্য দিয়ে থাকি যা আমরা কখনই করি না। পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ বোধহয় অন্যের সমালোচনা করা আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজেকে পরিবর্তন করা। পবিত্র কোরআনের সূরা শামস- এ বলা হয়েছে 'প্রকৃত তারাই সফল হলো যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল, তারা ধ্বংস হলো যারা আত্মাকে কলুষিত করল।' মূলত সমাজের প্রতিটি স্তরে শুদ্ধ মানুষই কল্যাণ বিনির্মাণ করতে পারে।

আমরা বিপক্ষ মতকে একেবারেই সহ্য করতে পারি না। ভিন্ন মত দেখলেই গা জ্বালা করে। আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করার চেয়ে কাদা ছোড়াছুড়ির চর্চা করে থাকি। এদেশে দলীয়করণ রাজনীতিতে দেশপ্রেম মুখ্য বিষয় নয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের লোভাতুর মন দুর্নীতির হাতছানিকে রুখতে পারে না। এ দেশের সর্বাঙ্গে যে মরিচা পড়েছে তা থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সুশাসন ও সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের উন্নতি মানেই কিন্তু আমাদের উন্নতি।

উন্নত মানুষ হতে হলে আমাদের আচারণে ও জ্ঞানচর্চায় উন্নত হতে হবে। বর্তমান প্রজন্ম নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষে পরিণত হচ্ছে। যা চারদিকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এর জন্য মূলত আমরাই দায়ী! আমরা ক্রমাগত অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছি।

মানুষের প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা দিতে আমরা ভুলে গেছি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অধিকাংশ অপরাধীরাই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে শৈশবে বা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, বঞ্চনা ও ভালোবাসাহীনতার দাবানলে দগ্ধ হয়ে। মানুষ হিসেবে আমরা সবসময় চাই, অন্যরা যেন আমাদের ভালোবাসে। কিন্তু আমরা অন্যকে প্রকৃতই মানুষ হিসেবে গণ্য করতে চাই না। লোক দেখানো নীতি-নৈতিকতার বুলি আওড়ালেও, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ঠিকই অনৈতিক কাজে লিপ্ত হই। আলোকিত মানুষ হতে হলে মন থেকে ইতিবাচক হওয়া চাই। আমরা সবাই জাতি গঠনের একেকজন সৈনিক। একজন ভালো মানুষ দয়াশীল এবং ভদ্র স্বভাবের হয়।

আমাদের নফসের কুমন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ যুদ্ধে টিকে থাকতে না পারলে আমাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। নিজের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভুলগুলো শুধরানো সবচেয়ে বেশি জরুরি। সুন্দর মুহূর্তগুলো যেন অপ্রীতিকর কর্মে নষ্ট না হয় সেদিকে সুদৃষ্টি দিতে হবে। নিজের মধ্যে সবজান্তা ভাব দূর করতে হবে। সব কার্যক্রমে বিবেকের আদালত জাগ্রত করে বিচার করতে হবে। ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে চিন্তিত হতে হবে। অন্যরা আমাকে মূল্যায়নের আগে, নিজেকে নিজেই মূল্যায়ন করে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারলেই জীবনের সার্থকতা।

আশিকুর রহমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে