উন্নত জাতি ও সুন্দর পৃথিবী গড়তে হলে বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই

বই সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধার জন্য হয়তো আমরা টেকনোলজির সহায়তা নিচ্ছি বটে, কিন্তু টেকনোলজি কখনোই মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প হতে পারে না। বই ব্যবহার সহজ ও আনন্দদায়ক। প্রযুক্তি যেহেতু জটিল চিন্তার ফসল, তাই জটিল প্রযুক্তি শিগগিরই সহজ-সাধারণ বইয়ের জায়গা দখল করতে সক্ষম হবে না। আর হলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বই থেকে আমরা যা চাই ও পাই তা যদি অন্য মাধ্যম যেমন- ই-বুক, অডিও বুক, পিডিএফ ফরম্যাটে এবং মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট থেকে আরও সহজ শর্তে পেতে পারি তাহলে আমাদের সে পথেই যাওয়া উচিত।

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

মোনায়েম সরকার
'পুস্তক' একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ- বই, গ্রন্থ ইত্যাদি। মানবসভ্যতা বিকাশে 'পুস্তকের' গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান পুস্তকের কালো অক্ষরের নিপুণ বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। এই অসীম জ্ঞানভান্ডার হতে যত ইচ্ছা জ্ঞান আহরণ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব। যে জীবন বই বিমুখ, সে জীবন প্রকৃত অর্থে জীবনই নয়, বইহীন জীবন যেন প্রাণহীন দেহের মতোই মূল্যহীন। পলস্নীকবি জসীমউদ্‌দীন ঠিকই বলেছেন, 'বই আপনাকে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সব কালে নিয়ে যেতে পারে। যে দেশে আপনার কোনো দিন যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বইয়ের রথে চেপে আপনি অনায়াসে সে দেশে যেতে পারেন।' পুস্তক মূলত দূর ও কাছের মধ্যে, অতীত এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সাঁকো বেঁধে দেয়; সেই সাঁকোর সাহায্যে আমরা অবাধে জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে পারি। পৃথিবীতে প্রথম কবে বইয়ের ব্যবহার শুরু হয় তার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। আদিম মানুষ যখন লিপি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি, তখন তারা গুহাচিত্র অঙ্কন করে মনের ভাব প্রকাশ করত। সেই হিসেবে গুহাচিত্রই তখন লিপির স্থান অধিকার করেছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। ধীরে ধীরে মানুষ যখন লিপি আবিষ্কার করে, তখন সেই লিপিতেই তারা তাদের অভিজ্ঞতা সংরক্ষণের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। যেদিন থেকে লিপি আবিষ্কার হয়, সেদিনই পুস্তক প্রকাশের সম্ভাবনা মানুষের মনে প্রবল হয়ে ওঠে। নানা রকম পদ্ধতি অনুসরণ করে বই প্রকাশে সক্ষম হয় জ্ঞানপিপাসু মানুষ। একটি বই আমরা এখন যে অবস্থায় দেখি, সে অবস্থায় পেতে হাজার হাজার বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষের শ্রম ও মেধা যুক্ত হয়ে আছে গ্রন্থ আবিষ্কারের পেছনে। আমাদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সংগত কারণেই তাই অতীত যুগের মানুষের কাছে ঋণী। এই ঋণ শোধ করে নয়, স্মরণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, 'যতদিন লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ থাকে ততদিন মানুষ জ্ঞানী থাকে। আর যখনই তার ধারণা জন্মে যে, সে জ্ঞানী হয়ে গেছে, তখনই মূর্খতা তাকে ঘিরে ধরে।' সক্রেটিসের কথার প্রতিধ্বনি করেই বলতে চাই- জ্ঞানী হওয়ার একমাত্র পথ জ্ঞানান্বেষণ, আর এই জ্ঞানান্বেষণ তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন ব্যক্তির সঙ্গে বইয়ের যোগাযোগ বিরামহীন ও নিবিড় হয়। শুরুতেই বলেছিলাম লিপি আবিষ্কারের কথা। লিপি সর্বপ্রথম কারা আবিষ্কার করেন এ নিয়ে লিপিবিশারদরা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রদান করলেও অধিকাংশ লিপিবিশারদই মনে করেন, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভূখন্ড থেকে লিপি আবিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এগুলো হলো- চীন, মিশর এবং ভারতবর্ষ। চীনের উপকথা অনুসারে সাং চিয়েন নামের এক ড্রাগন মুখো লোক প্রাচীনকালে চীনা অক্ষরগুলো তৈরি করেছিলেন। মিশরের উপকথা অনুসারে পাওয়া যায় অন্য তথ্য। সেখানে বলা হয়, পাখির মতো মাথা আর মানুষের মতো দেহ বিশিষ্ট দেবতা থথ্‌ মিশরীয় লিপি আবিষ্কার করেন। ভারতের উপকথা মতে, হিন্দু দেবতা ব্রহ্মা ভারত বর্ষের প্রাচীন লিপি আবিষ্কার করেছিলেন। তার নামানুসারে ঐ লিপির নাম হয় ব্রাহ্মীলিপি। এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন বর্ণমালাভিত্তিক লিপিটি হলো 'ফিনিশীয় লিপি'। এই ফিনিশীয় লিপি ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ফিনিশীয় জাতি প্রথম আবিষ্কার করেন। তাদের লিপিতে ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। গ্রিক ও ইহুদিরা ফিনিশীয়দের কাছ থেকে বর্ণমালার ধারণা লাভ করে। গ্রিক বর্ণমালায় বর্ণের সংখ্যা ২৪টি। তারা ব্যঞ্জনবর্ণের পাশাপাশি স্বরবর্ণেরও প্রচলন করেছিলেন। পরে গ্রিকদের কাছ থেকে রোমানরা লিপির ধারণা পায়। রোমান বর্ণমালা থেকে পরে প্রায় সমস্ত ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা তৈরি হয়। ভারতবর্ষের ব্রাহ্মীলিপির পেছনেও ফিনিশীয় লিপির প্রভাব আছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে প্রাচীন ভারতীয়রা সম্ভবত নিজেরাই লিপি আবিষ্কার করে থাকতে পারেন। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লিপির মর্মোদ্ধার করতে পারলে ভারতীয় লিপির রহস্য আবিষ্কার করা সম্ভব হতে পারে। লিপি আবিষ্কারের পর মানুষের সামনে সম্ভাবনার একটি নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়। লিপি মানুষের জ্ঞানচর্চার পথকে সুগম করে তোলে। লিপি আবিষ্কারের পরে আরেকটি আবিষ্কার প্রয়োজন ছিল পুস্তকের জন্য, সেটি হলো 'কাগজ'। প্রাচীন যুগে কাঠে, গাছের বাকলে ও পত্রে, হাড়ে, চর্মে খোদাই করে লিপি লেখা হতো। সেটি ছিল অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও সংরক্ষণের জন্য খুবই কষ্টকর। কাগজ আবিষ্কার হওয়ার পরেই পুস্তকের ভুবনে আসে আমূল পরিবর্তন। ইতিহাস সাক্ষী দেয় চীনারাই প্রথম কাগজ আবিষ্কার করেন। হান জাতির গোত্রভুক্ত 'চাই লুন' নামক ব্যক্তি প্রথম আধুনিক কাগজ উৎপাদন করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। চাই লুন ২০০ খ্রিস্টাব্দে কাগজ আবিষ্কার করলেও চীনে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকেই কাগজের প্রাচীন রূপ বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয়। লিপি এবং কাগজ আবিষ্কারের ফলে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। আজ আমরা বই বলতে যা বুঝি তা আসলে লিপি ও কাগজেরই অসাধারণ সমন্বয়। কাগজের গুণগত মানেরও প্রকারভেদ আছে। পুস্তক নানাভাবে মানুষের জ্ঞানের চাহিদা মিটিয়ে আসছে। এক একটি বই যেন জ্ঞানের এক একটি রাজ্য। পৃথিবীতে বিচিত্র রকমের গ্রন্থ আছে। ধর্মীয় গ্রন্থ, সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ, ইতিহাস, আইন ও রাজনীতি সংক্রান্ত গ্রন্থ, শিক্ষা ও চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ ইত্যাদি। এসব গ্রন্থের মধ্যে মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা ও আগামী স্বপ্ন লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। মানুষ ইচ্ছে করলেই প্রয়োজনীয় জ্ঞানের চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ থেকে মিটিয়ে নিতে পারে। বই হলো এমন এক রত্নভান্ডার- যেখানে থেকে যত ইচ্ছে জ্ঞান রূপ রত্ন সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু কখনোই সে অমূল্য রত্নভান্ডার শেষ হওয়ার নয়। কবি-দার্শনিক ওমর খৈয়াম যথার্থই বলেছেন, 'রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো খোলা হয়ে যাবে, কিন্তু একখানা বই চিরযৌবনা, যদি তেমন বই হয়।' বই চির নতুন, চির সম্ভাবনাময় সত্তা। ধুলো জমে হয়তো বইয়ের বাহ্যিক অংশ জীর্ণ শীর্ণ হয়, কিন্তু বইয়ের প্রাণ কখনো মলিন হয় না, মৃতু্যবরণ করে না। এ কারণেই বই অমর, শাশ্বত রূপ নিয়ে আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমরা এখন বিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষের যুগে বসবাস করছি। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী নতুন আবেগ, নতুন স্বপ্ন ও নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছি। অনেক পুরাতন জিনিসই আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে এসে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি। অনেক কিছুই গ্রহণ করেছি বাস্তবতার চাপে পড়ে। আজ অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, জাগতিক বুদ্ধিদীপ্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যেখানে সর্বপ্রসারী রূপ নিয়ে মানুষের মুখোমুখি হয়েছে, তাতে বই তার আবেদন ধরে রাখতে পারবে কিনা, আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেই চাই- বইয়ের আবেদন কখনোই মানুষের অন্তর থেকে মুছে যাবে না। আমরা যদি প্রাচীন লাইব্রেরিগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব- সেদিনের লাইব্রেরিতে বই ছিল না, বইয়ের পরিবর্তে সেদিন ব্যবহৃত হয়েছে পোড়ামাটির চাকতি, হাড় ও চর্মের উপকরণ। মাটির চাকতির সংগ্রহশালাই ছিল পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরির উদাহরণ। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য এশিয়া মাইনর কেন্দ্রিক অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার অন্যতম রাজা আসুরবানিপাল একাধারে যোদ্ধা, শাসক, গ্রন্থপ্রেমী ও গ্রন্থগারিক ছিলেন। আসুরবানিপালের সুবিশাল লাইব্রেরিটি ৩০ হাজার মৃন্মায় চাকতি দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল। এগুলোর দৈর্ঘ্য ছিল ১৫ ইঞ্চি, প্রস্থে ১২ ইঞ্চি এবং পুরু ছিল এক থেকে দেড় ইঞ্চি। বর্তমান ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো আসুরবানিপালের ২০ হাজার চাকতি গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে। সময় বদলালে মানুষের চাহিদাও বদলায়। আজ কাগজের বই সম্পর্কে যে অমূলক আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আকৃতি অনুসারে বইয়ের পরিবর্তন যুগে-যুগে, কালে-কালে বহুবার হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতে আরো বেশি হবে। নতুন দিনের সঙ্গে নতুনভাবে মানিয়ে নেবে নতুন দিনের মানুষ। কিন্তু একটু হিসাব করলেই বোঝা যাবে- এত শিগগিরই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আধুনিক পৃথিবীতে ৭০০ কোটি লোকের বসবাস। এই ৭০০ কোটি মানুষ আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি যতই নড়াচড়া করুক, হাতে গোনা কিছু মানুষ বাদে বাকি সবাই কাগজে মুদ্রিত বইয়ের ওপরেই সর্বাধিক আস্থাবান। বই সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধার জন্য হয়তো আমরা টেকনোলজির সহায়তা নিচ্ছি বটে, কিন্তু টেকনোলজি কখনোই মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প হতে পারে না। বই ব্যবহার সহজ ও আনন্দদায়ক। প্রযুক্তি যেহেতু জটিল চিন্তার ফসল, তাই জটিল প্রযুক্তি শিগগিরই সহজ-সাধারণ বইয়ের জায়গা দখল করতে সক্ষম হবে না। আর হলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বই থেকে আমরা যা চাই ও পাই তা যদি অন্য মাধ্যম যেমন- ই-বুক, অডিও বুক, পিডিএফ ফরম্যাটে এবং মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট থেকে আরও সহজ শর্তে পেতে পারি তাহলে আমাদের সে পথেই যাওয়া উচিত। আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অপার সম্ভাবনাময়। এমন দিন হয়তো আমাদের সামনে আসছে, যেদিন কাগজ কলমের আর দরকার হবে না, মানুষের মৌখিক নির্দেশেই সব কাজ সম্পন্ন হবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত শত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানব হৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।' একেকটি বই, একেকভাবে একেকটি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়। যার যেমন তৃষ্ণা ও বুদ্ধি, বই থেকে সে তা-ই খুঁজে পায়। আমাদের যৌবনে আমরা শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করেছিলাম। এখনো আমরা লড়াইয়ের পথ থেকে অবসর নেইনি। হয়তো বয়সের কারণে রাজপথে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে আগের মতো স্স্নোগান দিতে পারি না, তাই বলে লড়াইয়ের মাঠ পরিত্যাগ করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্জয় প্রান্তরে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আমরা এক সময় স্স্নোগান দিতাম- 'ভুখা মানুষ বই ধরো, কেননা, ওটা হাতিয়ার।' আজো আমাদের নবীন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে টলস্টয়ের সেই অমরবাণী উচ্চারণ করতে চাই- 'জীবনে শুধু তিনটি জিনিস প্রয়োজন, বই, বই এবং বই।' বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী। উন্নত জাতি ও সুন্দর পৃথিবী গঠন করতে হলে বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই। অন্যান্য মনীষীর মতো আমি অন্তত এটাই মনে করি। মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ