বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালীন শিক্ষাচিত্র :কিছু প্রস্তাব

এই মহামারির কবে নাগাদ অবসান ঘটবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। আর আমাদের দেশের সব পর্যায়ের নাগরিকদের করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনতেও ঢের সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে; তাই নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এ দেশের সরকারকেও শিক্ষা খাতে আরও জোরালোভাবে সুনজর দিতে হবে।
ড. আবদুল আলীম তালুকদার
  ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

সারাবিশ্বে এখন করোনা মহামারির (কোভিড-১৯) দ্বিতীয় ঢেউ জোরালোভাবে আছড়ে পড়ছে। গত কয়েক দিন যাবত মৃতু্য ও আক্রান্তের হার এ যাবতকালের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। বিশ্বজুড়ে মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় চলছে করোনাভাইরাসের তান্ডবে। নানা আশঙ্কা ও করোনা ভাইরাস প্রতিনিয়ত তার জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তন করছে জেনেও উন্নত দেশগুলো তাদের উদ্ভাবিত টিকা নিজ নিজ নাগরিকদের মাঝে প্রয়োগ শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে, আমাদের দেশেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্যসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের অবস্থা শোচনীয়। জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সব দেশেই। ফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও মরণব্যাধির আক্রমণকে মোকাবিলা করে জীবন ও জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধির আলোকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও মানুষের জীবনকে সচল রাখার সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। উন্নত দেশে করোনার যে ধরনের প্রভাব পড়েছে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। কাজেই এই বৈশ্বিক সমস্যা সফলভাবে মোকাবিলা করতে আমাদের প্রত্যেককে মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, কাজ করতে হবে সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

এখন চলছে নতুন বছরের প্রথম মাস। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সব শিক্ষার্থীই নতুন বই হাতে পেয়েছে। কথা ছিল এ সময় শিক্ষার্থীরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে বিদ্যালয় পানে ছুটে চলার। কিন্তু অমোঘ বাস্তবতায় এখন আমরা তাদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে হাতে এখন আমরাই তুলে দিচ্ছি মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ-কম্পিউটারের মতো যান্ত্রিক ডিভাইস। এটা এখন পরিস্থিতি ও সময়ের নিদারুণ দাবিও বটে। কিন্তু সেই ডিভাইসের ব্যবহার এখন শুধু ক্লাসের সময়ে সীমাবদ্ধ নয়। পড়া কালেক্ট করা, হোমওয়ার্ক সাবমিট, গ্রম্নপস্টাডি- এসবের অজুহাতে সারাক্ষণই যেন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের সঙ্গে এরা নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। তারা যেন এখন এক নতুন ভার্চুয়াল জগতে ভেসে বেড়াচ্ছে।

প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের দেশে ৪ কোটির অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেসব দুরন্ত ছেলেমেয়ে তার সহপাঠীদের সঙ্গে মিলে মিশে লেখাপড়া ও মাঠে খেলাধুলা করত, তারা এরপর থেকেই ঘরবন্দি। দেশে কয়েক মাস লকডাউন চলার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে- একথা অনস্বীকার্য। দিনের পর দিন তাদের সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে দূরত্বও তৈরি হয়েছে- একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চলমান আছে। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জুম অ্যাপস, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ওয়েবএক্স, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউবের মতো বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল ক্লাসে অংশ নিচ্ছে। এছাড়া রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংসদ টিভিসহ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম প্রচার করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কজন শিক্ষার্থী অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে? তারা কী শিখছে? তার কতটুকু গ্রহণ করতে পারছে? আর দীর্ঘসময় অনলাইন ক্লাস তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?

আমি নিজে সরকারের শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে বাস্তবে যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো বর্তমানে অনলাইন বা ভার্চুয়াল ক্লাসের সুবিধা প্রকৃতার্থে সব শিক্ষার্থী গ্রহণ করতে পারছে না। এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫-৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ হিসেবে আমরা যা জানতে ও প্রত্যক্ষ করতে পারছি তাহলো, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশেরই ক্লাসে অংশগ্রহণ করার জন্য স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ নেই। প্রত্যন্ত গ্রাম, পশ্চাদপদ চরাঞ্চল, হাওরাঞ্চল অথবা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভার্চুয়াল শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা তো নেই-ই- ইতার সঙ্গে কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ গ্রহণেরও ব্যবস্থা নেই। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহর বাদে দেশের উপজেলা পর্যায়ে থ্রি-জি/ফোর-জি নেটওয়ার্ক বা ব্রডব্যান্ড সুবিধা সহজে দেখা মেলে না। ফলে ইন্টারনেটের দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে নিরবচ্ছিন্ন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার সুবিধা সবাই পায় না। অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের সবগুলো পাঠ সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না, আর না বুঝতে পারলেও শিক্ষকদের কাছ থেকে আবার প্রশ্ন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছে না। তাই তাদের অনেক বিষয়ে পড়াশোনায় ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, তা সঠিক পদ্ধতির পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হচ্ছে না। তাই তাদের পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়াও অনলাইনে পাঠ গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন ডিভাইসের স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকায় শিক্ষার্থীদের চোখে নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার কারো কারো এ সময় মাথা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। একটানা দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে পাঠ গ্রহণ করার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর ঘাড়ে ও মেরুদন্ডে ব্যথাসহ আরো কতিপয় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। যা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা অনলাইনে ক্লাস করার কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হচ্ছে- যা তাদের অকালপক্ক হওয়ার আশঙ্কাকে ত্বরান্বিত করছে বৈ কি।

আবার অনেক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক অভিযোগ করছেন যে, বর্তমানে অত্যন্ত সংকটময় মহামারি পরিস্থিতিতে যেখানে তাদের সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাড়তি ব্যয় বহন করা তাদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আবার নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ সরবরাহের ঘাটতি ও ইন্টারনেটের দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে অনলাইনে ক্লাস করার সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের পাঠদান ঠিকমতো দেখতে ও শুনতে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে তারা অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পরবর্তী সময়ে তারা সময় সুযোগ করে শুধু স্স্নাইড দেখে বা শুধু বইপুস্তক দেখে নিজে নিজে পড়ে বুঝতে চেষ্টা করছে।

অপরদিকে অনলাইন ক্লাসের সুবিধার আওতায় সব শিক্ষার্থী আসতে না পারলেও যত সংখ্যক শিক্ষার্থী এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারছে, তা-ই বা কম কিসে? এটাকে আমাদের ভালো দিক হিসেবে ধরে নিতে হবে। আর দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এখন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নানান প্রযুক্তি অবলম্বন করে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন- যা আমাদের রীতিমতো আশান্বিত করছে।

\হএই মহামারির কবে নাগাদ অবসান ঘটবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। আর আমাদের দেশের সব পর্যায়ের নাগরিকদের করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনতেও ঢের সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে; তাই নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এ দেশের সরকারকেও শিক্ষা খাতে আরও জোরালোভাবে সুনজর দিতে হবে।

প্রতি বছর সরকার কর্তৃক প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রায় ১১৫০ কোটি টাকার বই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করে থাকে। যদি বর্তমান সরকার অনলাইন শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বইয়ের পরিবর্তে ই-বুক বিতরণ করে তাহলে আগামী দিনে শিক্ষা খাতের ব্যয় অনেকটা সাশ্রয়ী হবে। কারণ পাঠ্যবই প্রতি বছরই নতুন করে প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করতে হয়। আগের বছরে পঠিত বইগুলো পরের বছরে আর ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। অথচ ই-বুক পরবর্তী বছরগুলোতে কারিকুলাম-সিলেবাস পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য সরবরাহ করতে কোনো প্রকার অসুবিধে নেই। শিক্ষার্থীদের চাহিদানুযায়ী প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সরকারি প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিনামূল্যে বা ভর্তুকি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা ও কম্পিউটার-স্মার্টফোন প্রদান করে পাঠ ফলপ্রসূ ও সবার উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য ইন্টারনেট প্রোভাইডারদের স্বল্পমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারের পক্ষ থেকেই করতে হবে। বাংলাদেশের সব উপজেলা-ইউনিয়ন-গ্রামকে ফোর-জি ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সব শিক্ষকর আইটি দক্ষতা বাড়াতে তড়িৎ গতিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমতাবস্থায় শিক্ষা সরঞ্জামাদি, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ওয়েব ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও কম্পিউটার ক্রয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সহজশর্তে সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আর শিক্ষার্থীরা যাতে অতিরিক্ত অনলাইন আসক্ত না হয় তার দিকে শিক্ষক-অভিভাবক সবার অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

ড. আবদুল আলীম তালুকদার :কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে