মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক স্বার্থে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় জরুরি

নাগরিক স্বার্থে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। এ জন্য আইন প্রণয়ন জরুরি। উন্নয়ন প্রকল্প দীর্ঘসূত্রতা হ্রাসে সমন্বয় সাধন জরুরি। দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করা হোক।
আর কে চৌধুরী
  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এখন দুনিয়ার মেগা সিটিগুলোর একটি। এটি যেমন গর্বের তেমন লজ্জা ও হতাশার বিষয় হলো দুনিয়ার শীর্ষস্থানীয় সমস্যাসংকুল নগরী হিসেবে ঢাকার পরিচিতি। গত এক যুগে এ পরিচিতি কাটিয়ে উঠতে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক নগরীতে পরিণত করার জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বেসামাল অবস্থার অবসান ঘটেনি। ঢাকাকে বলা হয় যানজটের নগরী। ফুটপাত এমনকি রাস্তা বেদখল হয়ে যাওয়ার কারণে যানজট নগরবাসীর নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবার উচ্ছেদ সত্ত্বেও দখলমুক্ত হয়নি ফুটপাতগুলো। অভিযান শেষ হতে না হতেই ফিরে আসছে অবৈধ দখলদাররা। সংস্কারের অভাবে ভাঙা অনেক সড়ক। ভেঙে গেছে অনেক ফুটপাত। জরাজীর্ণ অলিগলি। অনেক ম্যানহোলে ঢাকনা নেই। উঁচু-নিচু মূলসড়কের কোথাও কোথাও আবার এক-দেড় ফুট গর্ত।

মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের পর ফের ট্রাক-পিকআপের দখলে চলে গেছে তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকার সড়কগুলো। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে ভবন। শীত আসতেই মশার উৎপাতে ঘুম হারাম নগরবাসীর। বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নগরীর তালিকায় বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম। নানা উদ্যোগের পরও গণপরিবহণে ফেরেনি শৃঙ্খলা। যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামায় যানজটে স্থবির নগরজীবন। গণশৌচাগার সংকটে পুরো শহরটাই যেন পরিণত হয়েছে শৌচাগারে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে প্রবচন ছিল- রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে ঢাকায় আছি। এখন মাছির উপদ্রব নেই বললেই চলে। তবে মশার উপদ্রব থাকে ১২ মাস। বেসামাল ঢাকাকে সামাল দিতে রাজধানীতে দুটি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পরও সংকট কাটেনি। রাজধানীর সমস্যাগুলোর সমাধানে সমন্বয় না থাকায় কোনো সমস্যার সুরাহা টানা দুরূহ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থার অবসানে সব সেবা কার্যক্রম সিটি করপোরেশনের আওতায় আনার কথা ভাবতে হবে।

রাজধানীবাসীর সেবার জন্য ৫৬টি সংস্থা জড়িত। তাদের কাজের সমন্বয় না থাকায় নগরবাসী সত্যিকার অর্থে কতটা সেবা পায় তা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় ঢাকা ইতিমধ্যে দুনিয়ার অন্যতম বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীতে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সিটি করপোরেশন নতুন রাস্তা, ফুটপাত তৈরির পরের মাসেই তা কেটে সুয়ারেজ লাইন বসাচ্ছে ওয়াসা। কখনো রাস্তা খুঁড়ে বিটিসিএল নিয়ে যাচ্ছে টেলিফোনের লাইন। নাগরিক সেবা বাড়াতে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হলেও কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটেনি। এ অবস্থায় গত বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু তাতেও জট খোলেনি। মেয়ররা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্য সেবা সংস্থাগুলোর সে দায়বদ্ধতা নেই। সেবা সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের আওতাধীন না হওয়ায় তারা মেয়রের নির্দেশনা মানতে বাধ্য নয়। রাজধানীর সেবা প্রদানকারী প্রতিটি সংস্থার প্রকল্প ও বরাদ্দ আলাদা। রাজধানীর উন্নয়নে স্থানীয় সরকার-স্বরাষ্ট্র-রেল-বিদু্যৎ ও জ্বালানি-গণপূর্ত-সড়ক ও যোগাযোগ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এ ছাড়া অর্থ, পরিকল্পনাসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় পরোক্ষভাবে ঢাকার উন্নয়নের অংশীদার। সমন্বয়হীনতার কারণে এ সংস্থাগুলোর সেবা যথার্থভাবে নগরবাসীর কাজে আসছে না। রাজধানীর উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অচল নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা- যা এড়াতে রাজধানীর সেবাদানকারী সব সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনতে হবে।

\হযে কোনো সময় যে কোনো রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি, ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা রাখা, নর্দমার ময়লা-আবর্জনা বৃষ্টির পানিতে পড়ে রাস্তাজুড়ে উপচে পড়া, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার ঢিবি, খানাখন্দপূর্ণ প্রধান সড়ক যুগ যুগ ধরে এমনই দৃশ্যের সঙ্গে বসবাস এবং বেড়ে ওঠা ঢাকা মহানগরবাসীর। সহ্য ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত আজ বাসিন্দারা। অবস্থা এমন যে, একবার যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা কাটাছেঁড়া হয়েছে, তার মেরামতে বছর গড়িয়ে যায়। মাসের পর মাস ধরে চলে নানা সংস্থার কথিত উন্নয়নের কাজ। মনে হয়, এসব কাজ চলবে অনন্তকাল ধরে। মানুষ দুর্ভোগ, যাতনা, যন্ত্রণা, কষ্ট যতই পোহাক, তাতে কিছু যায় আসে না সংশ্লিষ্টদের। আর এসব দেখার কোনো দায়ভারও যেন নেই তাদের। এই এক বিড়ম্বনা পোহাতে পোহাতে দিবস-রজনী পার করেন নাগরিকরা। একই রাস্তা এক বছরে বারবার খোঁড়াখুঁড়ির নজির রয়েছে। আজ ওয়াসা, কাল টিঅ্যান্ডটি, পরশু বিদু্যৎ, গ্যাস, তার পরদিন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল প্রভৃতি সংস্থা নির্বিকারভাবে কেটে চলছে রাস্তা, করছে খোঁড়াখুঁড়ি। উৎপাত আর আপদ-মুসিবতের মিশেলে তারা নিরন্তর একই কাজ করে যাচ্ছে। কারও সঙ্গে নেই কারও সমন্বয়; যে যার খেয়াল খুশিমতো যখন তখন খুঁড়ছে সড়ক। এর থেকে পরিত্রাণ বা নিস্তার নেই কারও। একই রাস্তা একবার ওয়াসা কেটে মাটি ভরাট করে, তো পরদিন আসে গ্যাস কর্তৃপক্ষ। এভাবে বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

নাগরিক স্বার্থে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। এ জন্য আইন প্রণয়ন জরুরি। উন্নয়ন প্রকল্প দীর্ঘসূত্রতা হ্রাসে সমন্বয় সাধন জরুরি। দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করা হোক।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে