বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অসীম মমত্ব ও অক্ষয় ভালোবাসা। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দ্বিমত পোষণ করা মোটেই সমীচীন নয়। অতীতে এ মহান নেতাকে যারা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করেছে এবং বর্তমানেও করছে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। মুক্তিযুদ্ধ সত্য ও জীবন্ত ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বাঙালির জন্য অনশ্বর, অমর।

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এমন একজন বিকল্পহীন অদ্বিতীয় নেতা, রাজনীতির ইতিহাসে বরপুত্র যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক জাগরণ ও উত্থান। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয়প্রাপ্তির জটিল ও কঠিন পথপরিক্রমায় অনুঘটকও ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ও জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার কারণেই হয়ে ওঠেন একটি জাতির মহান স্থপতি। রাজনীতির শুরু থেকে বাঙালির ন্যায্য অধিকার ও দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সোচ্চার ছিলেন। তিনি ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কূটনৈতিক ও কৌশলগত কারণে ৭ মার্চ ১৯৭১ সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে তিনি কাব্যিক ভাষায় পূর্ব বাংলার জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। এ অলিখিত ভাষণে নিহিত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকল্পের পূূর্ণ প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর এ সাহসী ডাকে সাড়া দিয়েই ৩০ লাখ শহীদ, অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও ২ লাখ মা-বোনের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে তার অমরত্ন। আজ আমরা স্বাধীন দেশে বুক চিতিয়ে, মাথা উঁচু করে চলতে পারি। মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ১৯৭১ ভাষণটি ছিল বিশ্বের নিপীড়িত-বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের কাছে মুক্তি বার্তাবাহী এক চিরঞ্জীবী সুধা। এ ভাষণটি বর্তমান প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা, নতুন দিগন্তের হাতছানি, আগামীতে স্বপ্ন বোনার ভিত্তি। ওই ভাষণের ঘোষণা অনুযায়ী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৪ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, 'বাংলাদেশের মুক্তির ইচ্ছাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না। কারণ প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকে মরণ বরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর আত্মমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই।' অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির উপর গণহত্যা শুরুর পর পরই বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে যা বাংলার মানুষ সাধারণভাবে মেনে নেয়নি, বরং জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়; প্রহসনমূলক বিচারে মুতু্যদন্ড ঘোষণা করা হয়; এমনকি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় মনোবল ভাঙার জন্য সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়। এ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাপ্নিক সংগ্রামে হিমালয়ের মতো অটল ও অবিচল। অবশেষে সব ধরনের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনে; কিন্তু বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুবিহীন বিজয় অপরিপূর্ণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সামরিক সরকার ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ওইদিনই বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে প্রথমে লন্ডন এবং পরে দিলিস্ন হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন যাকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে তিনি কখনো কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি। স্বদেশের মাটিতে আবেগময় বীরোচিত সংবর্ধনা জানানোর পর বঙ্গবন্ধুকে রমনা রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ৭ মার্চ ১৯৭১ ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন। ওই স্থানে একটা ডজ ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, '...আমার মৃতু্য আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব। আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব- জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।' পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বলেন, 'ভুট্টো সাহেব, আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে।' ওই ভাষণের শেষপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার দুটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃতি করে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'সাত কোটি বাঙ্গালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙ্গালি করে মানুষ করোনি। কবি গুরু তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছ, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।' বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালেই যেমন দেশের সংবিধান দিয়ে যান, তেমনই আইন-কানুন প্রণয়নসহ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে দেশকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুকে সে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুযায়ী দেশকে গড়ে তোলার সময়টুকু দেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সপরিবারে হত্যার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে দেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয় যার ধারা '৯০ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং চড়াই-উতরাই পেরিয়ে '৯১ সাল থেকে দেশে সে গণতান্ত্রিক ধারা সূচিত হয়েছিল ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও তার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের 'রোল মডেল'। কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের যা অর্জন তা শ্লাঘার যোগ্য। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ৯১ ভাগ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, কর্নফুলি ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের মতো মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজ দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে চলছে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, কার্যকরভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা, তৈরি পোশাক, প্রবাসী জনশক্তি, রেল-নৌ ও যোগাযোগ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ-মাদক-দুর্নীতি নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, বিনামূল্যে বই প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, শিশু-মাতৃমৃতু্য হ্রাস, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে শতবছরের 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০' বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের বিরামহীন এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে আগামী প্রজন্ম একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশে বসবাস করতে সক্ষম হবে- ইনশাআলস্নাহ। এজন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিককরণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ, সামাজিক বৈষম্য-বঞ্চনার অবসান, ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণ, ঝরেপড়া মানুষকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণ, গবেষণা-প্রযুক্তির সমন্বয়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ, মানবাধিকার-সুশাসন-জবাদিহিতা নিশ্চিতকরণের জন্য সম্মিলিত কর্মপ্রয়াস যার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে সমতাভিত্তিক একটি মানবিক উন্নয়ন সমাজব্যবস্থা। তাই তো বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'এ স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।' বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অসীম মমত্ব ও অক্ষয় ভালোবাসা। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দ্বিমত পোষণ করা মোটেই সমীচীন নয়। অতীতে এ মহান নেতাকে যারা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করেছে এবং বর্তমানেও করছে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। মুক্তিযুদ্ধ সত্য ও জীবন্ত ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বাঙালির জন্য অনশ্বর, অমর। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু এদেশের ইতিহাসে সে সবের অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের জাতির পিতা, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্রষ্টা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণীত রোডম্যাপ অনুযায়ী উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হোক মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকীও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ঘোষিত মুজিববর্ষে আমাদের অঙ্গীকার। প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ডিরেক্টর, বোর্ড অব ডিরেক্টরস, জীবন বীমা করপোরেশন, ঢাকা