নির্মম, বীভৎস, ভয়ানক- কোনো বিশেষণ দিয়েই এ ঘটনার বর্ণনা করা যায় না। একদল হিংস্র দুর্বৃত্তের ভয়াল থাবা, বর্বর উলস্নাসের সঙ্গে মিশে ছিল অসহায় এক নারীর বুকফাটা আর্তনাদ। তাকে তার সন্তানদের সামনে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়েছে। এ সময় ওই নারী ও তার ছেলেমেয়েদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এর চেয়ে অমানবিক বর্বর ঘটনা আর কী হতে পারে?
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ২ নম্বর চানন্দী ইউনিয়নের আদর্শ গ্রামে গত ১ জানুয়ারি রাতে 'স্থানীয় সন্ত্রাসীরা' সন্তানদের সামনে ওই নারীকে 'ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে' বিবস্ত্র করে নিপীড়ন চালায়। ভুক্তভোগী ৩২ বছর বয়সি ওই নারী গত ৫ জানুয়ারি জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-২ এ মামলাটি দায়ের করেন। এর আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে অন্য এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেশজুড়ে প্রতিবাদের মধ্যে সরকার ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে মৃতু্যদন্ডের বিধান করে। এবার নোয়াখালীর হাতিয়ায় ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এক গৃহবধূকে সন্তানদের সামনে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে ভাইরাল করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন লোক বিবস্ত্র অবস্থায় ওই গৃহবধূকে নির্যাতন করে টেনে-হিঁচড়ে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। অন্য একজন লাঠি দিয়ে ওই নারীর ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নারী সমাজকে শুধু নয়, বৃহত্তর নাগরিক সমাজকেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। ফেসবুকের পাতাজুড়ে ধিক্কার, ঘৃণা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এ লজ্জা, এই ক্ষত জাতিকে কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে- সেই প্রশ্নও রেখেছেন অনেকে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, 'আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের'। আর কবি আল মাহমুদের উচ্চারণ, 'হায়েনার দাঁত শুধু হামলে পড়ে/আমাদের শতাব্দীর অনাবৃত লজ্জার ওপর।'
অবাক ব্যাপার যে, যৌন নির্যাতন করছে কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা, ধনীর দুলাল। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, শিশু, যুবতী, আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। গত কয়েক বছরে রাস্তা-ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, চলন্ত বাসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটেছে এই পৈশাচিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। আমাদের নারী, শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এমনকি ধর্ষণের পর খুন হচ্ছে। আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি গির্জার পাদ্রিও ধর্ষণ করেছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারী ও পুরুষকে সমানভাবে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। যারা ধর্ষণ করে তারা মানুষ নয়। তারা নিজেকেই সম্মান করতে জানে না। তারা সমাজের কলঙ্ক, সমাজে বসবাসের যোগ্য নয়। এ ধর্ষকশ্রেণির বিচার যেমন করতে হবে, তেমনি নারীর অস্তিত্বের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা দিতে হবে। নারীকে দুর্বল করে রাখার সামাজিক ব্যাধি দূর করতে হবে সবার আগে।
\হনারীর প্রতি সহিংস আচরণ, অবমাননা এবং এর বিয়োগান্তক পরিণতি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। পৃথিবীব্যাপীই ঘটছে, তবে ইদানীং বাংলাদেশে যেন এর জোয়ার এসেছে। অপরাধীরা তো এ মানবসভ্যতারই অন্তর্গত, আমাদের চারপাশেরই বাসিন্দা। সবাই কোনো না কোনো পরিবারেই বেড়ে উঠেছে। সে পরিবার থেকে তারা কী শিক্ষা পেয়েছিল- এটাই আমাদের প্রশ্ন। আমাদের দেশেও নারী নির্যাতন রোধে আইন আছে; কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। শুধু আইন তৈরি ও পাস নয়- সংশ্লিষ্ট মহলকে সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করা উচিত।
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তার রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি। ইতিমধ্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অবাক ব্যাপার যে, দুর্নীতির বিপজ্জনক বিস্তারের কারণে তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতার নগ্ন দাপট বেড়েছে। অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত অথবা তাদের যথেষ্ট অর্থ আছে, যা দিয়ে তারা তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারে বা তাদের অপরাধকে দুর্বল করে ফেলতে পারে। দুর্বৃত্তদের খুঁটির জোর কোথায় এ প্রশ্ন সামনে চলে আসে। নারী অবমাননাকারীরা অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে অন্ধ। তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। তাদের টার্গেট সমাজের অসহায় নারী। যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য, এরা অসহায় নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ধরনের বর্বর ঘটনায় এমন এক কঠোর বার্তা দেওয়া উচিত যে, কোনো ব্যক্তি যদি এ ধরনের অপরাধে লিপ্ত হন তিনি রাজনৈতিকভাবে যে অবস্থানেই থাকুন না কেন তার শাস্তি হবে। কেবল তা হলে অপরাধীরা ভয় পাবে। সমাজে নারীকেন্দ্রিক অপরাধ কমে আসবে।
আমরা দেখছি একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। এর জন্য মূলত দায়ী জনগণের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত বাহিনীর দুর্বলতা ও উদাসীনতা। আমাদের দেশে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই সরকারকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে নারী নির্যাতন রুখে দাঁড়াতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্ব থাকে সব ধরনের অপরাধকর্মকে রুখে দেওয়া। কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো।
স্বীকার করতে হবে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু কিছু ঘটনা বাংলাদেশের অর্জনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এও মনে রাখতে হবে, যখন গণতন্ত্র সঠিকভাবে চর্চা করতে দেওয়া হয় না বা গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ে, জবাবদিহি থাকে না, ন্যায্যতার অভাব দেখা দেয়; সমাজে পেশিশক্তির দাপট নগ্ন হয়ে ওঠে, তখনই এ ধরনের অপরাধ ঘটতে থাকে। আমরা দেখেছি যেসব দেশে গণতন্ত্র চর্চার অভাব, আইনের শাসনের অভাব, যেখানে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, সেখানে অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে।
\হমনে রাখা জরুরি, সমাজে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ নারীরা। নারী স্বাধীনতার কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে, অথচ নারীরা অরক্ষিত, তা হলে সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে?
ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের অগোচরেই চারপাশে গড়ে উঠেছে এক অসুস্থ সমাজ, অশুভ চক্র. যেখানে নানা ধরনে নানা প্রক্রিয়ায় ঘটে চলেছে নারী অবমাননার ঘটনা। পরিচিত, ঘনিষ্ঠ, বিশ্বাসী মানুষের অবিশ্বাস্য চেহারা দেখতে হয়েছে নির্যাতনের শিকার নারীকে। ঘটনাগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা খোঁজ পাই না, টের পায় না স্থানীয় প্রশাসনও। সরকারের পরিকল্পতি উদ্যোগ এবং পুরুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই কেবল পারে এ চিত্রের বদল ঘটাতে।
সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক কলাম লেখক ও সাংবাদিক