বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের উন্নয়ন

বাংলাদেশে উন্নয়ন অর্থনীতির সূচনা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই- আজ আমাদের সবাইকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে।

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

রেজাউল করিম খোকন
আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের দিকে। ফলে অর্থনীতির সূচকগুলোর পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও মৌলিক পরিবর্তন আসছে। শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, ব্যাংক-বিমা, বিভিন্ন সেবা খাত, যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগোপযোগী ধ্যান-ধারণা, চিন্তাভাবনা। আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক রূপান্তর আজ গোটা বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। যে বাংলাদেশকে এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিল আন্তর্জাতিক একটি মহল তারাও আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করছে, প্রশংসা করছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য যোগ্য নেতৃত্বদানকারী অসাধারণ এক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্বের কথা বারবার আলোচিত হচ্ছে। এর সূচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে প্রায় সাড়ে তিন বছর সময়কালে বঙ্গবন্ধু চষে বেড়িয়েছেন সমগ্র বাংলাদেশ। বাংলার জনপদে ঘুরে ঘুরে প্রত্যক্ষ করেছেন এ দেশের মানুষের জীবনযাপন। অনুভব-উপলব্ধি করতে চেয়েছেন তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি। কীভাবে দেশটিকে ক্রমেই এগিয়ে নেওয়া যায় সমৃদ্ধির দিকে তার পরিকল্পনা করেছেন এবং খুব দ্রম্নত সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। সারাদেশের সুষম উন্নয়নের দিকে তার বিশেষ নজর ছিল। কোনো অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নয় সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদও এলাকার উন্নয়নে কী করা প্রয়োজন তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, ধারণার উন্মেষ হয়েছে এভাবে। স্রেফ জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে নয়, উন্নয়নের নতুন জোয়ার সৃষ্টির পেছনেই বঙ্গবন্ধুর সময় কেটেছে তখন। দৃঢ়তার সঙ্গে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করতে করতে এ দেশের বুভুক্ষু মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ভেঙে পড়া প্রশাসনিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। বিধ্বস্ত রাস্তঘাট, পুল, কালভার্ট তৈরির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতার ব্যবস্থা করেছিলেন। ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন সব প্রাথমিক শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ওই কয়েক বছর সময়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়া বিধস্ত ব্যবসাবাণিজ্য চাঙা করে তুলেছিলেন তিনি অসাধারণ কৌশল প্রয়োগে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জন্য বড় প্রয়োজনটি ছিল বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি। কারণ, স্বীকৃতির মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে কৌশিক ঋণ ও সাহায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন, 'বিশ্বের সব মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি, বাংলাকে স্বীকৃতি দিন।' যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের আবেদনও ছিল ওই ভাষণে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মধ্যে বিশ্বে ১৩১টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বীকৃতি দেয়নি এমন দেশের মধ্যে ছিল মাত্র চীন, সৌদি আরব, ইরান ও জর্দান। অবশ্য বঙ্গবন্ধু তার অনবদ্য কূটনৈতিক তৎপরতায় উলিস্নখিত দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের পটভূমি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য হয়েছিল। একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে স্থান লাভ করেছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। অবাক করা বিষয় হলো, ১৯৭২ সালের গোড়ায় যে দেশটি স্বীকৃতি ও বান্ধবহীন ছিল, সে দেশটি দুই বছরের মধ্যে ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। যার অনবদ্য প্রচেষ্টা এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তায় এটা সম্ভব হয়েছিল তখন- তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটা না মেনে উপায় নেই। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যত দ্রম্নত সম্ভব অগ্রগতির পথে নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে চট্টগ্রাম আর মোংলাবন্দরের মাইন অপসারণ করে বন্দরকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে সচল করে তুলেছিলেন খুব কম সময়ের মধ্যে। ভারত প্রত্যাগত এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সফলভাবে। দেশের কৃষক শ্রেণি ও কৃষি ব্যবস্থার ভাগ্য পরিবর্তন ও আমূল সংস্কারের জন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে/নামমাত্রমূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন; এ দেশের কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অসামান্য আরো অনেক অবদানের মধ্যে রয়েছে : দেশের ৫৮০টি শিল্পকারখানাসহ পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সব সম্পদ জাতীয়করণ, হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান, মাদ্রাসা বোর্ডের পুনর্গঠনসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপন এবং মদ, জুয়া, রেসকোর্সে ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতাসহ সমাজবিরোধী অনেক কার্যকলাপ দক্ষতার সঙ্গে কঠোর হস্তে বন্ধ করার মতো দুঃসাধ্য কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনন্য প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ খুব দ্রম্নতই যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বিদ্যমান ক্ষতসমূহ মুছে উন্নয়নের পথে চলতে শুরু করেছিল। যে দেশটিতে স্বাধীনতা অর্জনের পরপর কিছুই ছিল না উলেস্নখ করার মতো। একটা বড় শূন্য দিয়ে নতুন দেশটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ছিল না কোনো সংগঠিত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, এমনকি বেসামরিক প্রশাসন চালানোর মতো উপযুক্ত অবকাঠামো। না ছিল সুসংগঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা। বরং এর বিপরীতে ছিল ক্ষুধার্ত কোটি মানুষ আর সারাদেশ জুড়ে ঘরবাড়ি সম্পদ হারা সর্বস্বান্ত, দুঃস্থ, বাস্তহারা মানুষের হাহাকার। আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত। বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য আসছিল না। ওই সময়ে বিশ্বব্যাংক আর কিছু পূর্ব ইউরোপীয় মিত্রদেশ যদি সাহায্য সহযোগিতা না করত, তাহলে কী যে অবস্থা হতো সদ্য স্বাধীন দেশটির তা কল্পনা করতেও শিউরে উঠতে হয়। এরকম একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়া বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সূচিত হয়েছিল তার সুফল বাংলাদেশ পেতে শুরু করেছিল মাত্র দু-আড়াই বছরের মধ্যে। আজকের বাংলাদেশের যে সমৃদ্ধি, উন্নয়নের মহাসোপানে যে অভিযাত্রা তার সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের মানুষের কথা তিনি ভাবতেন সব সময়। কীভাবে এ দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে, উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে পারবে সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন মাত্র কয়েক বছরেই। তার সূচিত বিভিন্ন কর্মসূচি এবং পদক্ষেপ দ্রম্নতই সুফল বয়ে আনতে শুরু করেছিল। গত পাঁচ দশকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ সম্মানজনক একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার অসাধারণ বিচক্ষণতা, দেশকে ক্রমেই আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়, দৃপ্ত সাহসী পদক্ষেপ; সর্বোপরি দেশের মানুষের জনগণের প্রতি অপরিসীম মায়া ও ভালোবাসা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম করেছে। আজ বলতে দ্বিধা নেই, জাতির পিতার দেখানো পথ ধরে এগিয়ে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বাংলাদেশ। পঞ্চাশ বছর আগেই বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের যে নতুন চিন্তাধারার সূচনা করেছিলেন তা এখনো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি এবং দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আকুলতা প্রতিটি পদক্ষেপ ও কর্মকান্ডে বারবার ফুটে উঠেছে। আজকের বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরাও বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার অসাধারণত্ব অকপটে স্বীকার করছেন। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই স্বপ্ন পূরণের পথ ধরে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। নির্মম ঘাতকের বুলেট তার সেই পথ চলাকে রুদ্ধ করে দিলেও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তা থেকে মাঝখানে বিচু্যত হলেও বাংলাদেশ আবার সেই পথ ধরেই এগোচ্ছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন অর্থনীতির সূচনা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই- আজ আমাদের সবাইকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক