রোহিঙ্গা সংকট এবং বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব

জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নতির জন্য ভালো চিন্তা করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যাকেও কখনো অগ্রাহ্য করেননি।

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

ব্যারিস্টার নুসরত জাহান তানিয়া
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট আজ একটি বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সে দেশের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম নাগরিকদের মানবিক দিক বিবেচনা করে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের এই মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি মূল্যায়ন বিদেশি রাষ্ট্রগুলো করলেও দীর্ঘদিন সাহায্য সহযোগিতা করেনি বা তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তাই মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সীমানায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংঘাত ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে, আবার কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে মানবিক কাজকে অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) জাতিসংঘের প্রধান বিচারিক অঙ্গ। এটি ১৯৪৫ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে এটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, আদালতের দুটি ভূমিকা রয়েছে: প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এর কাছে জমা দেওয়া আইনি বিরোধ নিষ্পত্তি করা (এর রায়গুলোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্য আপিল ছাড়াই); এবং দ্বিতীয়ত, যথাযথ অনুমোদিত জাতিসংঘের সংস্থা এবং এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত আইনি প্রশ্নগুলোর পরামর্শমূলক মতামত দেওয়া। জেনারেল অ্যাসেম্বলি এবং জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিল নয় বছরের মেয়াদে নির্বাচিত ১৫ জন বিচারকের সমন্বয়ে এই আদালত গঠিত। আদালত একটি রেজিস্ট্রি দ্বারা সহায়তা করে, এর স্থায়ী প্রশাসনিক সচিবালয়- যা জাতিসংঘ সচিবালয়ের স্বাধীন। নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের পুরো অঞ্চলটির নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সমস্যাটি মিয়ানমার তৈরি করেছিল, এর সমাধান অবশ্যই মিয়ানমারের করা উচিত। তিন বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে; আফসোস, একটি রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সমস্যাটি সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি বর্তমানে অসম্ভবের পথে। সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। কক্সবাজারে শরণার্থী পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জের জটিলতা এর পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাহিদা মিটানোর জন্য আরও উন্নততর উপায় অনুসন্ধান করার প্রয়োজন। এই চিন্তামাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাসান চরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন- যা রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বিশ্ববাসী দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। তবে রহিঙ্গাদের যেখানেই রাখা হোক না কেন, তারা যেন নিজ দেশে মিয়ানমার দ্রম্নত ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের চেয়ে প্রত্যাবাসনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নতির জন্য ভালো চিন্তা করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যাকেও কখনো অগ্রাহ্য করেননি। বিশ্বকে অবশ্যই স্বীকৃতি ও প্রশংসা করতে হবে যে জাতিগত সম্প্রদায়কে প্রত্যেকে রাষ্ট্র প্রত্যাহার করে নিয়েছে আর আমাদের নেত্রী তাকে গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি কখনো তাদের পক্ষে খারাপ কিছু চাইবেন না। কারণ তিনি মানবতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন- যা বিশ্বাবাসীকে হতবাক করেছে। তাই তাকে 'মাদার অব হিউমিনিটি' পদকে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিক আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব অসুবিধায় পড়েছে। যাদের বেশির ভাগই ২০১৭ সালে মিয়ারমারের রাখাইন রাজ্যে অমানবিক সহিংসতায় এক কাপড়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের জনগণের পক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়াকে আইসিজে রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গা শরণার্থীর পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছে। গাম্বিয়া হলো একমাত্র দেশ, যে সাহস, দক্ষতা দিয়ে মানবতার অভিযোগ এনে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে নৃশংসতা। জাতিগত সংখ্যালঘুদের হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ২০১৯ সালে গাম্বিয়া নিয়ে আসা মামলায় আইসিজে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা গণহত্যা রোধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। ১৭ জন বিচারকের একটি প্যানেল সর্বসম্মতিক্রমে শাসিত আদেশে আদালত ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের বিধানকে বহাল রেখেছে- মিয়ানমার 'রোহিঙ্গাদের অধিকারের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে' বলে জানিয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ষা এবং গণহত্যার সব ক্রিয়া রোধ করার নির্দেশ দিয়েছে। জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুকির যুক্তিতর্ক প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে অবশ্যই ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন মেনে চলতে হবে। আইসিজের আদেশ অস্থায়ী, তবে মিয়ানমারের সরকারকে রোহিঙ্গাদের রক্ষার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় এবং মামলা চলমান থাকাকালীন এবং গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো প্রমাণ সংরক্ষণ করতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক বছর সময় নিতে পারে এবং মিয়ানমার এই আদেশগুলোকে উড়িয়ে দিতে পারে না। অন্যদিকে চীন মিয়ানমারকে সমর্থন করে এবং উভয়েই একই ধর্মীয় বিশ্বাসকে লালন করে। মিয়ানমার সমস্যা ছাড়াই তাদের মুসলমানদের সঙ্গে তারা যা খুশি তা করতে পারে কারণ চীনারা রয়েছে তাদের সঙ্গে। চীন যদি তার ভেটো শক্তি ব্যবহার করে তবে অর্ডার কার্যকর হবে না। যারা আইন মেনে চলতে চায় না এবং যাদের শক্তিশালী রাজনৈতিক মিত্র রয়েছে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনের ভেটো পাওয়ার রয়েছে। তাদের অনুচিত হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করা সবচেয়ে কঠিন। তবে আন্তর্জাতিক বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে আইসিজেতে গাম্বিয়ার অবস্থান এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলাটি রাষ্ট্রগুলোকে গণহত্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করার নজির হিসেবে কাজ করতে পারে- যা এটি তার নিজস্ব ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য। উন্নত দেশগুলোর কার্যকর উদ্যোগের জন্য জাতিসংঘ চাপ দেয়া দরকার। বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীর পরিস্থিতি বিশ্বের অন্যতম জটিল। যা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত রয়েছে। কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা এবং মানবিক এজেন্সিদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগে থাকা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। অস্থায়ী ব্যবস্থা আদালত কর্তৃক আদেশিত আইনত মিয়ানমারের ওপর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে, কেবল জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলই তা প্রয়োগ করতে পারে এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে এ ঘটনার সম্ভাবনা দূরবর্তী। সুতরাং, মামলাটি পরবর্তী পর্যায়ে চলে যাওয়ার পরে এবং আদালত সামনের মাসগুলোতে মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়াটির অপেক্ষায় রয়েছে। আইসিজেতে গাম্বিয়ার ঘটনা এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোহিঙ্গাদের সমর্থন বিশ্ববাসীর পক্ষে উদাহরণস্বরূপ। নিপীড়নের নিন্দা করার জন্য আপনার কাছে সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক শক্তি থাকতে হবে না। আইনি বাধ্যবাধকতা এবং নৈতিক দায়িত্ব, মানবতার দৃষ্টান্ত বড় বা ছোট সমস্ত রাজ্যের জন্য বিদ্যমান। ব্যারিস্টার নুসরত জাহান তানিয়া : প্রভাষক, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি ও পরিচালক, ইসলামি কমার্শিয়াল ইন্সু্যরেন্স কোং লিঃ