পাঠক মত

আস্থাহীন কৃষকের স্বস্তি ফেরাতে হবে

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এক প্রবন্ধে কৃষক সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'নিজ অন্ন পর কর পণ্যে দিলে, পরিবর্তে ধনে দুঃখে নিলে।' আজ ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও কৃষকের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কৃষকের উৎপাদিত শস্যে দেশের খাদ্যের অভাব পূরণ হয়, তথাপি কৃষকের জীবন কাটে অনাহারে, অনাদরে, অখ্যাতিতে। যুগে যুগে হাজার হাজার শাসকের পরিবর্তন হলেও কৃষকের রূপ বদলায়নি। সভ্যতার সবচেয়ে আদি এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পেশা বরাবরই পেয়ে এসেছে শোষণের তিক্ত স্বাদ, নির্যাতন, বঞ্চনা। দেশের চালচিত্রে কৃষি ক্রমেই শিল্প খাতের কাছে প্রচ্ছন্ন হলেও কৃষির গুরুত্ব কখনো কমবে না। সভ্যতার উষালগ্ন থেকে কৃষিই ছিল মানুষের প্রথম এবং জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। আজকের পৃথিবী কৃষি ও কৃষকের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল- কথাটি যথার্থ সমীচীন বলে মনে করি। দেশের মোট জিডিপির (২০১৯-২০ অর্থবছর) ১৩.৪৪ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। কিন্তু দেশে কৃষি দিন দিন অলাভজনক পেশা হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে কৃষকের বঞ্চনা, অবহেলা, পাচ্ছে না ন্যায্য পাওনা। বেসরকারি একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের ৮৪ শতাংশ কৃষক তাদের মূলধন সংকটে আছেন। গ্রামে থাকার সুবিধার্থে কৃষকের অনেক সমস্যা স্বচক্ষে দেখা হয়। এক কৃষকের আক্ষেপের কথা এখানে বর্ণনা যথার্থ সমীচীন হবে বলে মনে করি। কৃষকটির ভাষ্য ছিল, 'সরকার শুধু চাকরিওয়লাদের বেতন বাড়ায়, আমাগোর জন্য কোনো কিছু করে না। ফসলের যে দাম, তা দিয়া আমাগোর সারের দামও ওঠে না।' অর্থাৎ কৃষকটি তার কথায় মূলধনের লোকশানের কথাই উচ্চারণ করেছেন। কৃষি এবং কৃষকের অবস্থা পশ্চাতে কেমন ছিল- এটি তর্কহীনভাবেই বলা যায় যে, এ দেশে কৃষকের অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। অথচ এ দেশের শতকরা ৭০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে কৃষির অবদান ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বিপুল শ্রমশক্তির আয়-রোজগারের পথ এ কৃষি। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের নানা উদ্ভাবনের ছোঁয়াতে কৃষিতে উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে উৎপাদন খরচও। কিন্তু সমস্যা ওই এক জায়গায়; কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য কৃষকের হাত পর্যন্ত পৌঁছে না। গ্রামীণ এ কৃষকদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন আমাদের বহুবিদ সংকটের অশনিসংকেত দেয় বৈকি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো থেকে প্রকাশিত 'মনিটরিং দ্য সিচু্যয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ' (এমএসভিএসবি) প্রকল্পের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস জরিপে দেখা যায়, ২০১৪ সালে গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রতি হাজারে শহরে আসত ২৮ দশমিক ২ জন। ২০১৮ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৬ জনে। গ্রাম থেকে শহরান্তর ঘটানো এসব লোকদের পেশা স্বভাবতই কৃষি। কেননা দেশের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৬৫.৪৮ শতাংশ কৃষক নানা সময় অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে ৮৩.১৫ শতাংশ আবার বলেছেন তাদের খামারের আয় তাদের পারিবারিক চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কৃষকদের শহরমুখী হওয়া দেশের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। কেননা কৃষি যেমন অতি অত্যাবশকীয় একটি পেশা, তেমনি শিল্প খাতও অনেকটা কৃষির ওপরেই পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। শিল্প বিপস্নবের এই পর্যায়ে এসে কৃষিকে অস্বীকার করা আমাদের জন্য হবে নির্বিক আত্মঘাতী হওয়ার সামিল। দেশের অধিকাংশ এ শহরমুখী কৃষকদের গন্তব্য মূলত দেশের বড় শহরগুলো। এমনিতেই নানান সমস্যায় জর্জরিত অপরিকল্পিত শহরগুলোর অবস্থা এখন কাহিল; তার ওপরে বাড়তি জনসংখ্যা সামাল দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ব্যর্থতার পরিচয়। সেখানে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে আসা এসব লোকের জন্য শহরগুলোর পরিস্থিতি দিন দিন আরও নিদারুণ দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির দরুন শহরমুখী এসব ছিন্নমূল মানুষের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতার প্রমাণ অতি সম্প্রতি অহরহ পাওয়া যাচ্ছে, যা শহরের আইন-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের খাদ্য সুরক্ষার জন্য হলেও আমাদের কৃষিকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। কৃষকের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করা গেলে কৃষির কদর অনেকটাই বেড়ে যাবে। দেশে কৃষিবাজারকে একটি বৃহৎ চক্র নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছে, যাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের অসংখ্য সিন্ডিকেট। এসব কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ও পাইকারদের দৌরাত্ম্যে কৃষিবাজার অর্থনীতি কৃষকের হাতে আর নেই। ফলে কৃষি পণ্যের দাম মাঝেমধ্যেই আকাশচুম্বী হলেও কৃষকের পকেটে বাড়তি পাওনা যোগ হয় না। তাই কৃষিকে এসব সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। কৃষিকে কৃষকের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া এবং দেশের প্রচলিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব সিন্ডিকেটের পতন ঘটানোর এখনই মোক্ষম সময়। সরকারের নির্ধারিত কৃষি পণ্যের মূল্য তালিকা অনুযায়ী কৃষকরা যাতে পণ্য বিক্রি করতে পারে, সেজন্য বাজারগুলোতে সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গ্রামীণ ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকার ঘোষিত ডেল্টা প্রকল্প দ্রম্নত বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে কৃষি অর্থনীতি অনেকটাই সম্পর্কযুক্ত। তাই দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের বেহাল রাস্তাগুলোর সংস্করণে মনোযোগ দিতে হবে। দেশীয় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্যায়ন করতে হবে, বাইরের দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের বাজার বৃদ্ধিতে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি প্রযুক্তির সঙ্গে গ্রামীণ কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এতে কৃষিকর্মের গতিকে আরও দ্রম্নত করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে কৃষি ও শিল্প খাতের সমন্বয় ঘটানো গেলে কৃষি খাত থেকে দেশের পক্ষে অনেক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কৃষকের জীবনমানের উন্নয়নে কৃষিভাতা চালু, কৃষি উৎপাদন সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির মূল্য হ্রাস করা এবং কৃষকদের জন্য স্বল্প সুদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রচুরসংখ্যক কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মূলত কৃষিতে তাদের চরম জরাজীর্ণ এবং দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের জন্য। বাংলাদেশেও কৃষকদের আত্মহত্যার কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। একজন কৃষক তার ঋণগ্রস্ত অসহায় জীবন থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে হত্যার মতো নির্মম পথ বেছে নেয়। তাই সময় এসেছে কৃষিকে অর্থনৈতিকভাবে একটা সমৃদ্ধশালী পেশা হিসেবে মানুষের মধ্যে নবপরিচয় ঘটানোর। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে হলে কৃষির পাশাপাশি কৃষকের চলমান দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের পরিবর্তন ঘটাতে হবে অবশ্যই। আকিজ মাহমুদ শিক্ষার্থী ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়