শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

মোবাইল ফোনের আদ্যোপান্ত ও বাস্তবতা

নতুনধারা
  ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আদিমকালে মানুষ গুহার ভিতরে বর্বর জীবন-যাপন করত। তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ ছিল পশু শিকার ও বনের ফলমুল সংগ্রহ। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত আগুনের ধোঁয়া এবং মশাল, এমনকি হেঁটেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তথ্য আদান-প্রদান করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মরিয়া হয়ে নিজেদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছে। সৃজনশীলতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করেছে যুগোপযোগী সব আবিষ্কার। ব্রিটেনে ১৮৫০ সালে শিল্পবিপস্নবের পর তৈরি হয়েছে বাষ্পীয় ইঞ্জিনসহ আজকের বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। এত এত আবিষ্কারের মধ্যে মোবাইল ফোন অন্যতম। মোবাইল ফোনকে অনেকে মুঠো ফোনও বলে থাকে। কেননা এটা সহজেই হাতের ভিতরে নিয়ে ঘোরাঘুরি করাসহ তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো জায়গায় যোগাযোগ করা যায়।

পৃথিবীতে প্রথম মোবাইল ফোন উদ্ভাবকের মর্যাদা দেওয়া হয় মোটোরোলা কোম্পানিতে কর্মরত ডা. মার্টিন কুপার এবং জন ফ্রান্সিস মিটেলকে। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে প্রথম সফলভাবে প্রায় ১ কেজি ওজনের হাতে ধরা ফোনের মাধ্যমে কল করতে সক্ষম হন। মোবাইল ফোনের প্রথম বাণিজ্যিক সংস্করণ বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে। ফোনটির নাম ছিল মোটোরোলা ডায়না টিএস ৮০০০এক্স। যুগের পরিক্রমায় আধুনিক থেকে আধুনিকতার স্পর্শে মোবাইল ফোন হয়ে উঠেছে ছোটখাটো একটা কম্পিউটার। কেননা কম্পিউটারের অনেক ছোট ছোট কাজ এখন স্মার্ট ফোন দিয়ে করা যায়। মোবাইল ফোনের উন্নয়ন ও বিকাশ লাভের জন্য পরিবর্তনের হাত ধরে এসেছে মোবাইল ফোনের এক একটা প্রজন্ম (এবহবৎধঃরড়হ)। মোবাইল ফোনের প্রজন্মকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- প্রথম প্রজন্ম (১ংঃ এবহবৎধঃরড়হ, ১৯৭৯-১৯৯০), দ্বিতীয় প্রজন্ম (২হফ এবহবৎধঃরড়হ, ১৯৯১-২০০০), তৃতীয় প্রজন্ম (৩ৎফ এবহবৎধঃরড়হ, ২০০১-২০০৮) এবং চতুর্থ প্রজন্ম (৪:য এবহবৎধঃরড়হ, ২০০৯-বর্তমান)। যাকে সংক্ষেপে ১এ, ২এ, ৩এ, ৪এ বলা হয়ে থাকে। একটা প্রজন্ম আরেকটা প্রজন্ম থেকে বৈশিষ্ট্য ও কর্মদক্ষতার দিক থেকে ভিন্ন। আশির দশকে ১এ ফোনগুলো ছিল সেলুলার নেটওয়ার্ক নির্ভর এবং এগুলো অ্যানালগ সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে কাজ করে। এ দশকের ফোনগুলো থেকে কথা বলা ছাড়া বাড়তি কোনো সুবিধা পাওয়া যেত না। ১৯৯০ সালে এঝগ স্ট্যান্ডার্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২এ ফোন বাজারে আসে। ডেটা সার্ভিসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নেটওয়ার্ককে আরও বেশি সমৃদ্ধশালী করতে জাপানে এনটিটি ডোকোমো প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হয় ৩এ। ৩এ ফোনের ঘাটতি পূরণ করতে ৪এ উদ্ভাবন হয় যা ৩এ থেকে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই শক্তিশালী বলতে বাকি তিনটা প্রজন্ম থেকে এটার নেটওয়ার্ক কভারেজ, ইন্টারনেট ও অন্যান্য সুবিধা বেশি সেটা বোঝায়। বর্তমান মোবাইল ফোনগুলো পালা বদলের হাত ধরে অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হয়েছে। অলঙ্কৃত হয়েছে স্মার্ট নামক শব্দ দ্বারা। স্মার্ট মানে চটপটে, বুদ্ধিমান, ছিমছাম, যা প্রতিটা স্মার্ট ফোনের ভিতরে পরিলক্ষিত। স্মার্ট ফোন দ্বারা শুধু কথা নয়, আরও অনেক সেবা সহজে গ্রহণ করা যায়। যেমন- এসএমএস বা ক্ষুদে বার্তা, এমএমএস বা মাল্টিমিডিয়া মেসেজ সেবা, গতিশীল ইন্টারনেট সেবা, বস্নু-টুথ, ওয়াইফাই, অডিও কল, ভিডিও কল, গেমিং ও ক্যামেরা সুবিধা। স্মার্ট ফোনের বদৌলতে আজকাল ঘরে বসেই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, আলোচনা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করে অনেকে নানান বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। খেলার মাঠে উপস্থিত না থেকেও ভার্চুয়াল জগতে নামি-দামি খেলোয়াড়দের সঙ্গে সহজেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি খেলা করতে পারছে। এমনকি অনেকে যুদ্ধের ময়দানে নিজের রক্ত না ঝরিয়েও ভিডিও গেমের মাধ্যমে যুদ্ধ করে আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠছে। ভিডিও গেম যে শুধু আনন্দ দিচ্ছে তা নয়, মূল্যবান সময় ও মেধা একযোগে নষ্ট করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজ। হুমকির মুখে তারুণ্যের দুরন্তপনা। দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে তাদের উদ্দীপনা। অনেক মা-বাবা বাচ্চাদের মোবাইলে কাটুুন দেখায়, বাচ্চা কান্না করলে তাদের কাছে মোবাইল ধরিয়ে দেয়। ভাত খাওয়ানোর সময় আরব্য-রজনীর গল্প শোনানো বাদে টিভি চালু করে ভাত খাওয়ায়। কিছু বাচ্চা মোবাইলকে এতটা ভালোবাসে যে, দুধের ফিটার কেড়ে নিলে কান্না না করলেও ফোন কেড়ে নিলে কান্না করতে ভুল হয় না। এমন অবস্থায় সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথায়? আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কলেজ স্টুডেন্ট দৈনিক দশ ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। হতে পারে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করা, পিডিএফ ফাইল পড়া কিংবা মেসেজ করাসহ অন্য কাজ। যদি আমি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কথা বলি তাহলে দৃশ্য পুরোপুরি উল্টো হয়ে যাবে। পরিবহণ কিংবা রাস্তা-ঘাটে চলার সময়ও অনেকে ফোনের ডিসপেস্নর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা স্মার্ট ফোন বলতে ভিডিও গেম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বোঝে। ফেসবুক, পর্নো ভিডিও, পাফজি, ফ্রি ফায়ার নামক মারাত্মক ভিডিও গেমে আসক্ত। এ তালিকায় তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের মানুষ বিদ্যমান। মোবাইলকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের সংসার ভেঙেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকের লাল, নীল স্বপ্ন। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক প্রভাব গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে। ইৎরঃরংয ঈযরৎড়ঢ়ৎধপঃরপ অংংড়পরধঃরড়হ-এর মতে, গত কয়েক বছরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাকপেইন সমস্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়া উদ্বিগ্ন ও হতাশা, চোখের সমস্যা, স্নায়ু সমস্যা, মানসিক চাপ, নেতিবাচক অনুভূতির প্রভাব সমান হারে বেড়েছে। এসব কারণে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে স্মার্ট ফোনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। একটি উদাহরণ না দিলেই নয়- একই ফুল থেকে মৌমাছি মধু এবং মাকড়সা বিষ সংগ্রহ করে। তাহলে স্মার্ট ফোনের কারণে যে শুধু ক্ষতি হচ্ছে বা হবে বিষয়টা এমন নয়। স্মার্ট ফোন যে শুধু সময় অপচয় করছে এমন ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। অতি অল্প সময়ে আমরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। যুক্ত হতে পেরেছি গেস্নাবাল ভিলেজ নামক পস্নাটফর্মে। গেস্নাবাল ভিলেজ এমন একটি পস্নাটফর্ম, যেখানে বিশ্বের সব দেশ তথা দেশের মানুষ নিমিষেই সংবাদ আদান-প্রদান করতে পারে। নিজেদের সুখ, দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারে। আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে দন্ডায়মান, যেখানে ইন্টারনেট কানেকশন দিয়ে ওয়েব পেজ ব্রাউজিং করার সুবাদে পৃথিবীর অন্যদেশ ও মানুষের সম্পর্কে খবরাখবর জানতে পারছি। অবগত হতে পারছি সামরিক ও বেসামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। সচেতন হতে পারছি রাজনৈতিক আগ্রাসন নামক ধারালো থাবার বিষয়ে। তাই তো 'কবি কাজী নজরুল ইসলাম' সংকল্প কবিতায় লিখেছিলেন 'বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি, আপন হাতের মুঠোয় পুরে'। এতসব সুবিধা ভোগ করার জন্য মোবাইল ফোনের সঙ্গে আলাদা করে কোনো তারের সংযোগ দিতে হয় না। অথচ আশির দশকের ফোনগুলোর নেটওয়ার্ক এতটা দুর্বল ছিল যে অ্যান্টেনা সংযোগ করে কথা বলতে হতো। তাহলে এ দশকের ফোনগুলো এত সমৃদ্ধশালী হলো কীভাবে? স্মার্ট ও সেলুলার ফোনের ভিতরে মূলত পার্থক্য হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার দুটোতেই। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারকে মানুষের শরীর ও মনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ আমাদের শরীর যা আমরা ধরতে, ছুঁতে পারি তা হার্ডওয়্যার। পক্ষান্তরে, আমরা যে কথা বলি তা সফটওয়্যার। কিছু বৈশিষ্ট্য স্মার্ট ফোনকে আলাদা করে তুলেছে। তা হলো অপারেটিং সিস্টেম, অ্যাপিস্নকেশনস, নেটওয়ার্ক এবং ছডঊজঞণ কি বোর্ড। এ থেকে বোঝা যায়, বড় ডিসপেস্ন থাকলেই সেটা স্মার্ট ফোন হয় না। বরং উপরিউক্ত বিষয়গুলো একটি ফোনকে স্মার্ট করে তোলে। আবার স্মার্ট ফোন ব্যবহার করলেই যে স্মার্ট হওয়া যায় এটা একটি প্রচলিত ভুল ধারণা। স্মার্ট ফোন স্মার্টলি এবং দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করাই স্মার্টনেস। তাই কারোর ক্ষতির জন্য কোনো কিছুকে দায়ী না করে, ঘুণ ধরা চিন্তা-চেতনার সংশোধন দরকার। সবকিছুর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশ ও জাতির কল্যাণ আবশ্যক।

আবু সোহান

শিক্ষার্থী

ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে