বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির নীতি-আদর্শে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত রাখতে হলে বাঙালি জাতিসত্তাকে সমুন্নত রাখতে হবে। একমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাই পারে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমুন্নত রাখতে। সময় এসেছে, সমস্ত বাঙালি এক হয়ে বাঙালিত্ববোধ জাগিয়ে তোলা। এ কথা মানুষকে বোঝানো যে, আমরা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক কোনো দেশ নয়। বাঙালির নীতি- আদর্শে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উক্তি দিয়ে লেখা শেষ করছি। 'যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, ততদিন বাংলার সংস্কৃতি থাকবে।'
ডা. এস এ মালেক
  ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি কখনো দুর্বল হয়, তাহলে স্বাধীনতার ভীতও দুর্বল হতে বাধ্য। আসলে বাংলা ভাষাভাষী লোক গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। মনে হয়, তাদের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিরাই তাদের জন্য একটা স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এটা সমগ্র বাঙালির গৌরব। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় এবং পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাজ্য হওয়ায় অনেক বাঙালি ভারতে বসবাস করছে। আর পৃথিবীতে এমন দেশ কমই আছে, যেখানে বাঙালি নেই। যে দেশেই হোক এবং যে ধর্মেরই হোক একজন বাঙালি যখন আরেকজন বাঙালির সঙ্গে কথা বলে এবং তা বাংলা ভাষায় কথা বলে, তখন পরস্পরকে বুঝতে যত সহজ হয়, ভাবের আদান-প্রদান যত সুগম হয়, অন্য কোনো ভাষায় তা সম্ভব হবে না। আসলে বাঙালিত্ব বোধই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। বাংলাদেশের মানুষ এক সময় পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলেন। আর পাকিস্তান ছিল একটা ধর্মরাষ্ট্র। ধর্মের কারণেই পাকিস্তানের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও বাঙালি তার জাতিসত্তাকে কখনো বির্সজন দেয়নি। বাংলা ভাষায় কথা বলা, গান করা, স্বপ্ন দেখা, সবছিল ভাষাভিত্তিক। পাকিস্তান চেষ্টা করেছিল উর্দুকে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে, পারেনি। বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষা রক্ষা করেছে। আসলেই এই বাঙালিত্ব বোধটা কী? বাঙালি বলতে আমরা কী বুঝি? সার্বিক অর্থে বাঙালি বলতে আমরা একজন বাঙালির জীবনের সার্বিক আচারণকেই বুঝি। প্রথমেই মায়ের কোল থেকে পড়েই বাংলাভাষায় মা কে মা বলে ডাকে। যতদিন সে জীবিত থাকে, অন্যান্য ভাষা শিখলেও মায়ের ভাষায় কথা বলা ও চিন্তা করা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আহার-বিহার চাল-চলনে, কথা-বার্তায়, পোশাক-আশাকে আমরা প্রমাণ করি যে, আমরা বাঙালি। এ দেশে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান বাঙালি হিসেবেই বসবাস করছে। ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক বন্ধনে তারা আবদ্ধ। একজন গায়ক যখন ভাটিয়ালি সুরে পাল উঠিয়ে নৌকায় গান করে আর দূর থেকে কেউ শুনে- তখন হিন্দু কি মুসলমান এই বিবেচনা থাকে না। বরং সুরের মূর্ছনা তাকে মোহিত করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, কবি নজরুলের কবিতায় যে বাঙালিত্বের ছাপ আছে, তা প্রতিটি বাঙালি হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। হিন্দু-মুসলমান হিসেবে নয়, বাঙালি হিসেবে। কিন্তু যারা ধর্মের কারণে এই সংস্কৃতিতে বিভেদ সৃষ্টি করতে চান, তারাই রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুর কবি আর নজরুলকে মুসলমানের কবি মনে করেন। ধর্মের সংস্কৃতি নেই তা নয়। হিন্দুর পূজা ও মুসলমানের নামাজ একই ধরনের নয়। তাই ধর্মের যদি সংস্কৃতি থেকে থাকে, তাহলে উভয়েই আলাদা। কিন্তু বাঙালি হিসেবে যে সংস্কৃতিকে অবিহিত করা যায়, তা অভিন্ন। কোনো ধর্মীয় সংস্কৃতি মানুষকে সাম্প্রদায়িক হতে উদ্বুদ্ধ করে না। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক যারা প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, তারাই সত্যিকারের জাতিসত্তায় অভ্যস্ত নন। অনেক মুসলমান কৌলীন্যের দাবি করেন এই বলে- ইরান, ইরাক ও সৌদির বংশদ্ভূত। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যারা ধর্মান্তরিত করে মুসলমান হয়েছেন, তারা হচ্ছেন- বাংলার বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোক। বাঙালিত্ববোধে তারা সবাই একাকার হয়ে গেছেন। এখনো অনেক মুসলমান আছেন- যাদের পূর্বপুরুষ অন্যে ধর্মের ছিলেন। ধর্মের জন্য বাঙালি হতে তাদের কোনো বাধা হয়নি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, বাঙালি হিসেবে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। তাই দেখা যায়, শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাঙালিরা এক হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তারা জন্মগতভাবে বাঙালির শত্রম্ন। বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, তারা সবাই বাঙালি। পাকিস্তানিত্ব থেকে বাঙালিত্ব আলাদা করার জন্য তারা সংগ্রাম করেছেন। কোনো ধর্মই সেই সংগ্রামের উপাদান ছিল না। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক আদর্শ, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হতে পারে না। ব্যক্তি জীবনে তিনি হিন্দু-মুসলমান যাই হন না কেন, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক জীবনে, তিনি বাঙালি। আজ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে স্বাধীন বাংলাকে মুসলিম বাংলা বানাতে চায়, তারা প্রকৃত অর্থে বাঙালি পরিচয় দিয়ে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে চায়। এরাই তারা, যারা পাকিস্তান ভাঙতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং যুদ্ধচলাকালে সম্পূর্ণ দখলদার বাহিনীদের সহযোগিতা করেছেন। এরা সাম্প্রদায়িক, এরা কোনো দিনও খাঁটি বাঙালি ছিলেন না। এরা ধর্মীয় সংস্কৃতিতে মুসলমান ছিলেন। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে এদের বিশ্বাস নেই। এরা যে কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তা বিসর্জন দিয়ে স্বাধীন বাংলাকে মুসলিম বাংলায় রূপান্তর করতে চান। এরাই ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেন। এভাবে তাহলে ধর্মীয় সংস্কৃতি জাতীয় সংস্কৃতির ওপর প্রধান্য দেওয়া যায়.....। পূর্ব পাকিস্তানেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারা কিন্তু আর্থ-সামাজিক সংকট নিরসনে শোষণমুক্ত হতে পাকিস্তানের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করতে দ্বিধাবোধ করেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কারণে দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে হবে, এর কোনো যুক্তি নেই। যারা ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে মূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতা দখল করতে চান, তারা মূলত বাঙালি ও বাংলাদেশবিরোধী। ধর্মীয় সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়কে তারা বাংলাদেশের মূলশক্তি হিসেবে দাঁড় করতে চান। এ কারণেই তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে চান। আর জনগণ এর বিরোধিতা করেন। দীর্ঘদিন তারা উগ্রধর্মবাদী রাষ্ট্র বানাতে এ কারণে মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক প্রচারে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ বাঙালি সংস্কৃতিতে যারা বিশ্বাস করেন, তারা ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত রাখতে হলে বাঙালি জাতিসত্তাকে সমুন্নত রাখতে হবে। একমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাই পারে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমুন্নত রাখতে। সময় এসেছে, সমস্ত বাঙালি এক হয়ে বাঙালিত্ববোধ জাগিয়ে তোলা। এ কথা মানুষকে বোঝানো যে, আমরা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক কোনো দেশ নয়। বাঙালির নীতি- আদর্শে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উক্তি দিয়ে লেখা শেষ করছি। 'যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, ততদিন বাংলার সংস্কৃতি থাকবে।'

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে