বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও নতুন কিছু প্রত্যাশা

সবচেয়ে বেশি বয়সি প্রেসিডেন্টের কাছে এখন বিশ্ববাসীর প্রত্যাশাও অনেক বেশি। ইতিহাসের সব প্রেসিডেন্টকে ছাড়িয়ে যাওয়ার হাতছানিও তার সামনে। জো বাইডেন বলেছেন, ক্ষোভ আর তিক্ততাকে পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়বেন। বাইডেনের এমন আহ্বানে বিশ্বাসী শুধু যুক্তরাষ্ট্রবাসীই নয়, বিশ্ববাসীও।
সাহাদাৎ রানা
  ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জো বাইডেন। ২০ জানুয়ারি বুধবার রাতে শপথ নিয়ে আগামী ৪ বছরের জন্য হোয়াইট হাউহের বাসিন্দা হলেন ৭৭ বছর বয়সি বাইডেন। এর আগে গত নভেম্বরে মার্কিন ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন তিনি। এত সংখ্যক ভোট তার আগে কেউ পাননি। সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বাইডেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সি প্রেসিডেন্টও। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন। যিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে চার বছর কাটিয়েছেন হোয়াইট হাউসে। যখন সঙ্কট মোকাবিলার বিষয় আসে, তখন সময় নষ্ট করার মতো সময় থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এমন কথাই বলেছেন জো বাইডেন। তার এমন বক্তব্যের পর সবার প্রত্যাশাও বেড়েছে বহুগুণ।

বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা। কেমন হবে আগামীর বিশ্ব রাজনীতি। কারণ সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উপর বিশ্বরাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ নির্ভর করে। নির্ভর করে ভবিষ্যৎও। ইতিমধ্যে অনেক দেশ হিসাব কষতে শুরু করেছে কে কতটা লাভবান হবে। আবার কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। বাস্তবতা হলো- যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ। তাদের সুদৃষ্টির উপর অনেক দেশের ভালো থাকা নির্ভর করে। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শাসকের প্রেক্ষিতে অনেক দেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব পড়ে। পরিবর্তন আসে অনেকের ভাগ্যে। তাই বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু নতুন একজন প্রেসিডেন্ট পেল তা কিন্তু নয়। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে এর ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে জো বাইডেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো হবেন নাকি নতুন কিছু করবেন। নতুন কিছু করলে তা কেমন হবে।

অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ১৫টি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন জো বাইডেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যাওয়া। যা নিয়ে তিনি এর আগেও একাধিকবার কথা বলেছেন। এখন দায়িত্ব নিয়েই সেই কাজটি করলেন বাইডেন। এমন চুক্তিতে ফিরে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ইতিবাচক। এছাড়া তথাকথিত মুসলিম নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়েছে। ২০১৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সাতটি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে একটি আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন ট্রাম্প। এবার দায়িত্ব নিয়ে সেই আদেশ বাতিল করে দিলেন জো বাইডেন। এর ফলে বিশ্বে ধর্মীয় শত্রম্নতা ও বিদ্বেষ অনেকটা কমে আসার প্রত্যাশা সবার মধ্যে তৈরি হয়েছে।

এখন আলোচনা বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে কেমন হবে বাইডেন। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বা সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। বাংলাদেশের জন্য এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশ সবসময়ই সব রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গেও তা অব্যাহত থাকবে। কূটনীতিকরা মনে করছেন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বেশকিছু জায়গায় লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা ভিন্নতর। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গত চার দশক বা তার বেশি সময়ের দিকে দৃষ্টি দিলে তা আরও স্পষ্ট হবে। বাস্তবতা হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু ক্ষেত্রে যে পররাষ্ট্র নীতি প্রয়োগ করেছেন স্বাভাবিকভাবে জো বাইডেন সে নীতি থেকে সরে আসবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন না। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো। তবে জো বাইডেন তার নির্বাচনী বক্তব্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন তিনি। ইতিমধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যাওয়া সেটাই প্রমাণ করে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করার কথা বলেছিলেন তিনি। যা ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার এড়িয়ে গেছেন। দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে সেই কাজটি করেছেন জো বাইডেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জো বাইডেনের এমন উদ্যোগ সবাইকে আশাবাদী করে তুলেছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যদি যুক্তরাষ্ট্র আরও নিবিড়ভাবে কাজ করে তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি হবে। এর ফলে সবচেয়ে লাভবান হবে বাংলাদেশসহ সেসব দেশ যারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে যুক্তরাষ্ট্র মানেই স্বপ্নের দেশ। বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকেন। বিশেষ করে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু বিগত চার বছর ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বাংলাদেশের। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে যা ছিল অনেক কম। সে সময় ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ কিছু রাষ্ট্রের জন্য ছিল কড়াকড়ি। ভিসা প্রাপ্তির সংখ্যাও ছিল অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক কম। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের বারাক ওবামার সময়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসাব্যবস্থা সহজীকরণও ছিল। কিন্তু বিগত চার বছর যা ছিল অনেকটা কঠিন। তবে এবার বারাক ওবামার সময়ে আবারও ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন সবাই। এর মূল কারণ আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্র শাসন করবে ডেমোক্রেটরা। আর ঐতিহাসিকভাবে রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্রেটরা অনেক বেশি উদার। বাইডেন প্রশাসনের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভিসাপ্রাপ্তি সহজীকরণ হবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্যও। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাড়তি কিছু সুবিধা পেতে পারে। বাইডেন দায়িত্ব নিয়ে তথাকথিত মুসলিম নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে তার ইঙ্গিতই দিয়েছেন।

বাংলাদেশিদের আরও কয়েকটি জায়গায় আশাবাদী করে তুলেছে। বিশেষ করে অভিবাসী প্রত্যাশীদের। ডোনাল্ড ট্রাম্প গত চার বছর ইমিগ্রেন ভিসা প্রায় বন্ধ করে রেখেছিলেন। যে কারণে অনেকের আইনগতভাবে বৈধতা পাওয়া সম্ভব হয়নি। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় অভিবাসী প্রত্যাশীরা নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। স্বপ্ন বোনার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কেননা, নির্বাচনের আগে জো বাইডেন অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি নির্বাচিত হলে ইমিগ্রেন্ট ভিসা আবার চালু করবেন। এখন হাজার হাজার বাংলাদেশিসহ অসংখ্য অভিবাসী প্রত্যাশীর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার দরজা খুলে যাওয়ার অপেক্ষা। শুধু অভিবাসী প্রত্যাশীদের জন্য নয়। বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত হলো। যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় ছিল কড়াকড়ি। বারাক ওবামার সময়ের শিক্ষার্থীদের যুক্তরাস্ট্রে শিক্ষার সুযোগ যেমন প্রসারিত ছিল এবার তেমন কিছুর প্রত্যাশা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। এছাড়া ব্যবসা ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। বাইডেন প্রশাসনের তেমন প্রতিশ্রম্নতিও রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি বয়সি প্রেসিডেন্টের কাছে এখন বিশ্ববাসীর প্রত্যাশাও অনেক বেশি। ইতিহাসের সব প্রেসিডেন্টকে ছাড়িয়ে যাওয়ার হাতছানিও তার সামনে। জো বাইডেন বলেছেন, ক্ষোভ আর তিক্ততাকে পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়বেন। বাইডেনের এমন আহ্বানে বিশ্বাসী শুধু যুক্তরাষ্ট্রবাসীই নয়, বিশ্ববাসীও।

বিশ্ববাসীও স্বপ্ন দেখছে যুদ্ধ নয় শান্তিময় একটি বিশ্বের। আর সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশা এখন তেমনই।

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে