‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ কী ফল বয়ে আনবে?

দেশের তৃণমূল পযর্ন্ত সংগঠন রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এরশাদের জাতীয় পাটির্। এই তিনটি রাজনৈতিক দল ছাড়া ভোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র দলের কোনো মূল্য ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। ড. কামাল, বি চৌধুরী এরা তো দেখলেন দল গঠন করে কোনো লাভ হয়নি। বরং রাজনীতির মূলধারা থেকে তারা ছিঁটকে পড়েছেন, হারিয়েছেন জনগ্রহণযোগ্যতাও। তাই বাধ্য হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার নিমিত্তে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ করেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে হঠানো। রাজনীতিতে এখন তাদের প্রধান গাত্রদাহের কারণ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য বলতে যা বোঝায় তা মূলত স্বাথের্র অথবা ষড়যন্ত্রের ঐক্য, গণতন্ত্র রক্ষা বা জনকল্যাণ নয়।

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
সম্প্রতি সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছে। ফলে বড় ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এই জোট বতর্মান সরকারের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ বলছেন সরকার উৎখাতের জন্য এই জোট গঠিত হয়েছে। অনেকেই শুনতে পাচ্ছেন এক এগারোর পদধ্বনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের জোট বা বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া গঠন নতুন কিছু নয়। এমনকি বিশ্ব রাজনীতিতেও নতুন কিছু নয়। নিবার্চনের আগে এমন জোট গঠিত হতেই পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীঘির্দন ধরে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই জোট যদি স্থায়ী হয় এবং এদের উদ্দেশ্য যদি দেশ ও জনগণের কল্যাণে হয় তবে সে অভাব পূরণ করবে। এটাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি আবার সরব হয়ে উঠেছে। সরকার বিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের লক্ষ্যে গত শনিবার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র নেতারা যোগ দিয়েছিলেন। ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে এই নতুন রাজনৈতিক জোটে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাসদের একটি অংশের আ স ম আব্দুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না। এই জোটের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য করার ব্যাপারে বিএনপিরও চেষ্টা রয়েছে। সরকারের প্রতি আহŸান জানিয়ে সমাবেশে বলা হয়, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিবার্চনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং নিরপেক্ষ নিবার্চন কমিশন পুনগর্ঠন করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নিবার্চনের পরিবেশ সৃষ্টি করার কাযর্কর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং তফসিলের আগে বতর্মান সংসদ ভেঙে দেবেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে আসলে কতটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে তা নিয়ে কৌত‚হল রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা দুনীির্তবাজদের ঐক্য। তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলÑজাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘আমরা দানবের সরকার চাই না, আমরা চাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানবিক সরকার।’ তিনি বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনরা সব দুষ্কমের্র ঘঁাটি বিএনপিকে রাজনীতিতে পুনবার্সনের ঠিকাদারি নিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের জঘন্য সব অপরাধকমের্র রক্ষার ঢাল হিসেবে ড. কামাল হোসেন ব্যবহৃত হলেন। নিজের মুখোশটাও খুলে ফেললেন তিনি।’ ২০ দলীয় জোটের কথা বলা হলে জামায়াতও এসে যায়। এর সরল অথর্ হচ্ছে জামায়াত নেপথ্যে রয়েছে। ২০ দলীয় জোটকে নিয়ে ঐক্য গঠন করা ড. কামালের জন্য কতটা যৌক্তিক তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। আসলে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ এমন যে কোনো আদশের্কই ধরে রাখা যায় না। সরকার অবশ্য ড. কামালের এই উদ্যোগকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। তিনি এক সময়ে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। এক সময়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট পদপ্রাথীর্ হয়ে নিবার্চন করে হেরেছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের একজন। আর এখন তিনি ২০ দলীয় জোটকে নিয়ে সরকার উৎখাতের আন্দোলন করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এমনই। দেশের তৃণমূল পযর্ন্ত সংগঠন রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এরশাদের জাতীয় পাটির্। এই তিনটি রাজনৈতিক দল ছাড়া ভোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র দলের কোনো মূল্য ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। ড. কামাল, বি চৌধুরী এরা তো দেখলেন দল গঠন করে কোনো লাভ হয়নি। বরং রাজনীতির মূলধারা থেকে তারা ছিঁটকে পড়েছেন, হারিয়েছেন জনগ্রহণযোগ্যতাও। তাই বাধ্য হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার নিমিত্তে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ করেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে হঠানো। রাজনীতিতে এখন তাদের প্রধান গাত্রদাহের কারণ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য বলতে যা বোঝায় তা মূলত স্বাথের্র অথবা ষড়যন্ত্রের ঐক্য, গণতন্ত্র রক্ষা বা জনকল্যাণ নয়। ড. কামাল হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাসদের একটি অংশের আ স ম আব্দুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, ভোটের রাজনীতিতে এদের কতটুকু গুরুত্ব রয়েছে? এমনকি ইনু-মেনন, এরা সরকারে না থাকলে কী মূল্য ছিল? এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। জাসদ (ইনু) যে ৬টি আসন পেয়েছে তা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করার কারণেই। এটা সত্য ও স্বীকৃত ঐক্যজোটের যারা নেতা আছেন, তারা জনগণের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তারা কতটুকু অবদান রাখতে পারবেন এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তা ছাড়া এই ঐক্য স্থায়ী হবে কিনা সে প্রশ্নও ইতোমধ্যে উঠে এসেছে। ঐক্য প্রক্রিয়া যে পঁাচ-দফা দাবি তুলে ধরেছে তার মধ্যে রয়েছে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চন এবং নিবার্চনের সময় সেনা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েন করা। নেতাদের দাবি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও একটি সুষ্ঠু নিবার্চনের দাবিতে আজ সারাদেশে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। এই জাতীয় ঐক্য জেলা উপজেলা গ্রামপযার্য় পযর্ন্ত বিস্তৃত করার জন্য উদাত্ত আহŸান জানিয়েছেন তারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন হবে সংবিধান অনুসারে এবং এই নিবার্চন কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, সংসদ বিলুপ্ত বা সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। মূলত তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতির জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নিবার্চনকেন্দ্রিক পরস্পরের প্রতি অনাস্থা থেকে। তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতি উঠে গেলেও সেই অনাস্থা এখন আরও জোরালো হয়েছে। ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ যত দাবিই করুক না কেন ওই পদ্ধতি বাংলাদেশে পুনবর্হাল হওয়া কঠিন। কারণ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নামে টানা দুই বছর ক্ষমতায় থেকেছে এক এগারোর সরকার। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেনÑ ‘ক্ষমতা থেকে সরে গেলে যারা একবার ক্ষমতায় বসে তারা আর ছাড়তে চায় না। মাশার্ল ল, সামরিক শাসন ও কেয়ারটেকার সরকারের এমন উদাহরণ রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ইলেকশন ঠেকানোর মতো শক্তি কারও নেই। ষড়যন্ত্র আছে, ষড়যন্ত্র থাকবে, জনগণ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবে। এর সরল কথা হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হবে। অবশ্য পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নিবার্চন হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। ওই সব দেশে নিবার্চন নিয়ে এত বিতকর্ ওঠে না, সৃষ্টি হয় না অরাজকতা। আমাদের দেশের মতো সহিংস পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দিলে তার ফলাফল কী হবে? মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সরকারের মেয়াদ শেষে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, হানাহানি রক্তপাত ঘটেÑ তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে দেশ জনগণ ও গণতন্ত্রের ক্ষতিই হয় বেশি? পরে নতুন সরকার এলেও ওই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায় না। যে কাজ করলে দেশ ও জনগণের মঙ্গল হয় সেদিকেই সব দলের মনোযোগ দেয়া উচিত। এও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যা এখনো রাজনৈতিক। কারণ বাংলাদেশের অথর্নীতি এখন বেশ উজ্জ্বল। কেবল ঈদ উপলক্ষে রেমিট্যান্স এসেছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তথ্য মতে, ২০০৮-০৯ অথর্বছর থেকে বিদায়ী ২০১৭-১৮ অথর্বছর পযর্ন্ত ১০ অথর্বছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ হাজার ১৮৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এর আগের ১০ অথর্বছরে (১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৭-০৮ অথর্বছর পযর্ন্ত) রেমিট্যান্স এসেছিল ৩ হাজার ৩৬৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার। এর মধ্যে মাথাপিছু আয় ও বেড়েছে। গত বছরের ১ হাজার ৬১০ ডলার থেকে এ বছর গড় আয় উন্নীত হয়েছে ১ হাজার ৭৫১ ডলারে। অথার্ৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪১ ডলার। এ ছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধি টানা তিন বছর ধরে ৭ শতাংশের বেশি। ২০১৭-১৮ অথর্বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অজির্ত হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এটা আমাদের জন্য সুখবর। যে করেই হোক এটা ধরে রাখতে হবে। যে জন্য জরুরি শান্তিপূণর্ ও গ্রহণযোগ্য সবার অংশগ্রহণমূলক নিবার্চন। সরকার ও বতর্মান বিরোধী জোটের (বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য) সদিচ্ছা আন্তরিকতা উদারতা ছাড়া আগামী নিবার্চন নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমাধানের পথ রাজনৈতিক দলগুলোকেই খুঁজে বের করতে হবে। কারণ সংঘাত সহিংসতা উন্নয়নের বড় বাধা। এর ফলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। একটি অংশগ্রহণমূলক নিবার্চনই পারে এসব বাধা দূর করতে। দেশবাসীর অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। দেশ ও জনগণকে সংঘাত সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই সবচেয়ে বেশি। আমরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে কোনো বিষয়ে পরমতসহিষ্ণুতা ও প্রকৃত গণতন্ত্রচচার্ প্রত্যাশা করি। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক