চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা
আমরা জানি কোনো সমস্যার কারণ নির্ণয় করতে পারলে তার শতভাগ প্রতিকার করার পদ্ধতিটাও জানা যায়। তা টিআইর শীর্ষ কর্তারাও জানেন, দুর্নীতির অর্থ কোথায় যায় এবং কারা জমা রাখেন তাও তারা জানেন। সারা দুনিয়া থেকে দুর্নীতি করা অর্থ পৃথিবীর মাত্র আট থেকে দশটি দেশে জমা হয়।
প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
গ্রাম-বাংলার একটি প্রাচীনতম প্রবাদ 'চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা'। এই প্রবাদটি কে কখন রচনা করেছিল তা আমার জানা নেই, তবে প্রবাদের প্রায়োগিকতা সম্পর্কে একটি ঘটনা শুনেছিলাম, ঘটনাটি ছিল গ্রামের এক ইউনিয়ন পরিষদে এক ব্যক্তির মুরগি চুরির অপরাধের বিচার। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মুরগি চোরকে বেধড়ক মারধর করা হয়। মার খেয়ে বেচারা চোর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বের হয়ে বাড়ি যাচ্ছিল, সঙ্গে তার স্ত্রী। স্বামীর শারীরিক যন্ত্রণার কাতরানো স্ত্রীর হৃদমূলে আঘাত করে, চোর বউও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন আর তার স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়া মেম্বারকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, তুই যে গরিব মানুষের গম বিতরণ না করে নিজে নিয়ে খাস ওই বিচার কে করে। এলাকার মেম্বার লোকটির মুরগি চুরি করার সময় দেখেছিল, তার চাক্ষুষ সাক্ষীর কারণে সালিশ কমিটি ব্যক্তিটিকে মুরগি চোর সাব্যস্ত করে। এবং শাস্তিস্বরূপ বেধড়ক মারধর করে। চোরের স্ত্রীর মেম্বারকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া গালাগাল শুনে পথচারীদের বলতে শোনা যায়, 'চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা'।
সম্প্রতি ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) নামে একটি সংস্থা দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে। এই সংস্থার মতে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হলো সোমালিয়া। টিআইবির করাপসান পারসেপশন ইনডেক্স-২০১৯ অনুযায়ী ৯ পয়েন্ট নিয়ে ঊর্ধ্বক্রম থেকে ১৮০ এবং নিম্নক্রম থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সোমালিয়া। দ্বিতীয় স্থানে আছে দক্ষিণ সুদান, তৃতীয় স্থানে সিরিয়া, চতুর্থ স্থানে ইয়ামেন, পঞ্চম স্থানে ভেনিজুয়েলা, ষষ্ঠ স্থানে উত্তর সুদান, সপ্তম স্থানে ইকুয়াটরিয়াল গুয়েনা, অষ্টমে আফগানিস্তান, নবমে উত্তর কোরিয়া, দশমে লিবিয়া এভাবে বাংলাদেশের অবস্থান এসে দাঁড়িয়েছে ১৪তম স্থানে। দুর্নীতিবিহীন এমন দেশের তালিকা আছে, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডে, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, জামার্নি, লুক্সেমবার্গ, অস্ট্রিয়া কানাডাসহ পৃথিবীর কথিত উন্নত বিশ্ব। দুর্নীতে শীর্ষ অবস্থান করা দেশ হলো, সোমালিয়া, দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। সোমালিয়া আফ্রিকার একটি দেশ। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। আর এই প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রয়েছে লোলুপদৃষ্টি। কথিত দুর্নীতিহীন দেশগুলোর লোলুপদৃষ্টির কারণে সোমালিয়ার রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। ইসলামী মৌলবাদীগোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। আর এই দ্বন্দ্বের কারণে বাড়ছে দুর্নীতি, সোমালিয়ার উচ্চ পদাসীন কর্তাব্যক্তিরা দেশটিতে দুর্নীতি করে টাকা পাচার করে কথিত দুর্নীতিহীন দেশে। প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে সোমালিয়ায় যারা হানাহানি সৃষ্টি করে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করছে আর সোমালিয়াকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে পরিণত করল তারা কি? তাদের কি বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়? সুদান, সিরিয়াসহ অপরাপর বেশ কয়েকটি দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এই দেশগুলোও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ কৌশলে এই যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে, এই দেশগুলোকে নিজেদের তৈরি অস্ত্র বিক্রির বাজার বানানোর জন্য।
তবে বিবিসি সংবাদ তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। আর ২০১৯ সালের নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪। যাই হোক যা ৫২ তাহাই ৫৩। দুর্নীতির অবস্থানগতক্রম বড় পার্থক্য নয়। বাংলাদেশের দুর্নীতির কারণ হিসাবে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের অবদমন, রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, মতপ্রকাশ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জবাবদিহিতার অভাব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি এরকম কারণগুলোর জন্য বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বের ১৪তম স্থানে অবস্থান করছে। টিআইবি দুর্নীতি থেকে বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য অনেক সুপারিশ করেছে তার মধ্যে দু-একটা উলেস্নখ করছি তা হলো, সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যম যেন জবাবদিহিতা চাইতে পারে সেই সুযোগ করে দেওয়া, ডিজিটাইলেজশনের মাধ্যমে তথ্যাধিকার আরও বিস্তৃত করা, আর্থিক খাতের দুর্নীতি অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি নিয়ন্ত্রণ করা। টিআইবির কথাগুলো মানে সুপারিশগুলো সুন্দর, এখানে প্রশ্ন জাগে আমেরিকায় কি গণতন্ত্র আছে? আমেরিকায় সার্বজনীন ভোটের চেয়ে ক্ষমতাবান হলো ইলেক্ট্ররাল ভোট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে মোট ইলেক্টরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮টি আর এ ভোটপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের ফলাফল। এনজিওকে সুশাসনের জন্য কাজ করার সুযোগ দিতে বলা হয়েছে, প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশে এমন কিছু এনজিও আছে যারা দেশের গণতন্ত্রের কথা বলে, অথচ সেই সংস্থাটির একজন ব্যক্তিই সংস্থার জন্মলগ্ন থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র, সংস্থাটির ভিতরে যদি গণতন্ত্র চর্চা হতো, তাহলে বিকল্প নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতো এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন কাগজপত্র টেম্পারিং করে একটি এনজিও কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক ফান্ড দিয়েছে তার পার্টনার এনজিওকে, এরকম দুর্নীতিবাজ এনজিওরা সরকারের কি জবাবদিহিতা চাইবে? ডিজিটাইলাইজেশন ডিভাইসের পাসওয়ার্ড চুরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১০ কোটি টাকা চুরি হয়। এই টাকা রক্ষিত ছিল নিউইয়র্কে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের অর্থবাজার থেকে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের মালিকানাধীন ৩০টি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছে কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং ভারতে। পিকে হালদার বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ যেসব দেশে জমা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম দেশ হলো, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ডেনমার্র্ক, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সংযুক্ত আরবসহ কথিত সভ্য ও দুর্নীতিহীন দেশগুলোতে।
২০ জুলাই ২০২০-এর প্রথম আলোর এক তথ্য থেকে জানা যায়, শুধু সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংকে জমা পড়েছে, ২০০৪ সালে ৩৬৫ কোটি টাকা, ২০০৫ সালে ৮৬৩ কোটি, ২০০৬ সালে ১১০৬১ কোটি, ২০০৭ সালে ২১৮৭ কোটি, ২০০৮ সালে ৯৫২, ২০০৯ সালে ১৩২৬ কোটি, ২০১০ সালে ২১০০ কোটি, ২০১১ সালে ১৩৫৫ কোটি, ২০১২ সালে ২০১৩ সালে ২০৩৮ কোটি, ২০১৪ সালে ৩৩১১ কোটি, ২০১৫ সালে ৪৫৩৯ কোটি, ২০১৬ সালে ৪৯৭৭ কোটি, ২০১৬ সালে ৫৮৮৩ কোটি, ২০১৭ সালে ৪২৮৮ কোটি, ২০১৮ সালে ৫৪৯৮ কোটি, ২০১৯ সালে ৫৩৬৮ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে যারা বাংলাদেশে থেকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখছেন তাদের আয়ের উৎস কি তা কখনো সুইজারল্যান্ডের সরকার জানতে চান না বা সুইস ব্যাংকও জমাকারীর কাছে থেকে তার আয়ের উৎস কি কি তার বিবরণীও নেয় না। ফলে অসৎ পথে দুর্নীতি, হিরোইন, মাদকের ব্যবসা করে যারা কোটি কোটি কালো টাকা উপার্জন করছে তারাই এ টাকাগুলো জমা রাখতে পারছে সুইস ব্যাংকে। আর প্রকান্তরে যে দেশে এই কাজটি দুর্নীতিবাজরা করল সেই দেশটির নাম তালিকাভুক্ত হয়ে গেল দুর্নীতির সূচকে, আমজনতাকে এ দুর্নীতির তকমা গায়ে জড়িয়ে বাস করতে হয়। তাছাড়া পৃথিবীর সব দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থ টিআইবির ধারণা সূচকে যাদের দুর্নীতিহীন দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই দেশগুলোতেই জমা হচ্ছে।
টিআই যার নাম বাংলাদেশে টিআইবির জন্ম ১৯৯৩ সালে। টিআইয়ের সদর দপ্তর জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত। টিআই প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হলো সারা বিশ্বের দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা। ১৯৯৫ সালে দুর্নীতির ধারণা সূচক বা সিপিআইয়ের উন্নয়ন ঘটায় ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। সিপিআইয়েরর্ যাঙ্কিং ব্যবসায়ীদের ওপর পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে এক একটি দেশের দুর্নীতি চালচিত্র ফোটে। আর এ দুর্নীতির সূচকের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের অবস্থান টিআই তুলে ধরে বিশ্ববাসীর কাছে। এ বছর টিআই তুলে ধরেছে ১৮০টি দেশের দুর্নীতির চিত্র। পাশাপাশি যেসব দেশে দুর্নীতি হয় না তারও একটি তালিকা তারা প্রকাশ করেছে। কারণ টিআইয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবিচ্ছেদ্য এবং সাংঘর্ষিকপূর্ণ অবস্থান'। প্রতি বছর টিআইয়ের দুর্নীতির তালিকা প্রকাশের পর হইচই পড়ে যায়। সরকারি দল বিরোধী দল একে অন্যকে দেখাতে চায় কার আমল ভালো ছিল। টিআইয়ের এ 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবিচ্ছেদ্য এবং সাংঘর্ষিকপূর্ণ অবস্থান' খুবই মাধুর্যতাময় একটি স্স্নোগান। যে কেউ শুনলে বাহবা দেবে টিআইকে। টিআইয়ের সংগঠন এবং কার্যক্রম পরিচালনার অর্থের জোগানদার তো তারাই যারা বিশ্বের কথিত উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। আর কথিত দুর্নীতিবিহীন দেশগুলোর ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থায় জমা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে খেতাব পাওয়া দেশের লুঠের অর্থ।
আমরা জানি কোনো সমস্যার কারণ নির্ণয় করতে পারলে তার শতভাগ প্রতিকার করার পদ্ধতিটাও জানা যায়। তা টিআইর শীর্ষ কর্তারাও জানেন, দুর্নীতির অর্থ কোথায় যায় এবং কারা জমা রাখেন তাও তারা জানেন। সারা দুনিয়া থেকে দুর্নীতি করা অর্থ পৃথিবীর মাত্র আট থেকে দশটি দেশে জমা হয়।
সুতরাং টিআই ১৮০টি দেশে দুর্নীতির ধারণা সূচক নির্ধারণ করার জন্য গলদঘর্ম পরিশ্রম না করে বিশ্বের যে আট থেকে দশটি দেশে দুর্নীতির অর্থ জমা হয় সেখানে কাজ করা। কথিত দুর্নীতিহীন দেশগুলোকে টিআই মোটিভেশন করুক, তারা যেন দরিদ্র দেশগুলোর দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় না দেয় এবং দুর্নীতির টাকা জমা না রাখে। প্রকৃতার্থে ওই কথিত দুর্নীতিহীন দেশগুলো অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ, কারণ তারা দরিদ্র দেশের লুট হওয়া অর্থ নিজ দেশে জমা রাখতে সাহায্য করে। এই অসৎ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কানাডা, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকাসহ কথিত উন্নত দেশ। টিআইবির উচিত বাংলাদেশের মতো দেশকে দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করার বদলে যারা পিকে হালদারকে আশ্রয় দিচ্ছে আর বাংলাদেশের লুট করা অর্থ জমা নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সাংঘর্ষিকপূর্ণ অবস্থান নেওয়া। কারণ পতিতাকে বেশ্যা বলে গাল দিয়ে বাহ্বা কুড়ানোর মাধ্যমে বীরত্বের কিছু নেই। যারা এই পতিতা তৈরি করে তাদের দমন করাটাই হলো একজন বীরের কাজ। টিআই যদি পৃথিবীর দুর্নীতির আশ্রয়দাতাদের বিরোধে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে পারে তাহলে দুনিয়াজুড়ে অপরাধ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রহীনতা রোধ হয়ে যাবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক