ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন

ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রথম পর্ব। এই প্রথম পর্বে আমাদের শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের অবদান চিরস্মরণীয়। তাদের অবদান কোনো দিন ভুলবার নয়। কিছু লোক দালালি করলেও গোটা দেশ ছিল শেখ মুজিবের পক্ষে। তিনি ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রূপান্তর এবং স্বাধীনতার আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলতে সক্ষম হন। তিনি প্রথম বাঙালি, যিনি আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বাঙালি জাতিসত্তায় রূপান্তর করে জাতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন- তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, আমাদের মহান নেতা।

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

ডা. এস এ মালেক
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরিতে অংশ নেন সাধারণ জনতা, রাজনৈতিক সংগঠন এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। মানুষ নগ্নপায়ে ফুলের তোড়া নিয়ে অগ্রসর হন শহীদ মিনারের দিকে। দিনটি দেখে মনে হবে আমরা যেন আবার বায়ান্নতে ফিরে গেছি। 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।' সত্যিই আমরা যে শহীদদের ভুলিনি তার পরিচয় মিলবে এই শোক মিছিলে। কম হলেও কয়েক হাজার সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই শোক শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের পিতা-মাতার কোলে চড়ে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। ৬৫ বছরের বৃদ্ধ, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ফুল দিয়ে। প্রথাগত এই শোকযাত্রা শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো বিশেষ কোনো উপকারে আসবে না। এলে ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তারা প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা। বাংলা ভাষায় কথা বলার দাবি যদি মারাত্মক আকার ধারণ না করত, তা হলে পুলিশও গুলি ছুড়তো না এবং মানুষ ওইভাবে মারাও যেত না এবং ওইভাবে তারা জেগে উঠতো না। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ছাত্র সমাবেশে যদি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এই ঘোষণা না দিতেন, তা হলে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা এভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ত না। জিন্নাহর ঘোষণায় উপস্থিত ছাত্রসমাজ তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান ও নো নো ধ্বনি তোলেন। পাকিস্তানের ৫৬% নাগরিক ছিল বাঙালি। তাই স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকবর্গ ও কিছু বাঙালি নামক ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার। বাংলার দামাল ছেলেরা কিন্তু ভুল করেনি। রাষ্ট্রভাষা এক মাত্র উর্দু হলে বাঙালিরা যে কত বছর পিছিয়ে যেত, বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে তা ছিল কল্পনার বাহিরে। তাই '৫২তে রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, সফিউলসহ যারা জীবন দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠিত করল, তাই স্বভাবতই ভাষা আন্দোলনের দাবি পূরণ হওয়ায় এই আন্দোলন থেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাঙালি থামেনি। স্বায়ত্তশাসনের দাবি যে ক্রমাগত প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অত্যন্ত সুকৌশলে ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করলেন। তিনি প্রথম বাঙালি নেতা, যিনি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী এ ক্ষেত্রে অনেক সমর্থন জানিয়েছেন। আবার খাজা নাজিমউদ্দিনের মতো তথাকথিত বাঙালি পকিস্তানের পক্ষে দালালি করে উর্দুর পক্ষে কাজ করেছেন। এক সময় ধীরেন দত্ত পার্লামেন্টে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ছিলেন। এর পূর্বে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংসদের কার্যপ্রণালি বাংলায় বলতে দাবি জানান শেখ মুজিব। তাছাড়া বাংলা ভাষার দাবিতে তিনি প্রায়ই পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রস্তাব তুলতেন। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করার সময়ে যে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল, তাতে বাংলা ভাষার দাবি ছিল। প্রকৃত ভাষা আন্দোলন কিন্তু ১৯৪৮ সালে শুরু। ভারত বিভাগের পরপরই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেন। আসল কথা হচ্ছে বাঙালি নেতাদের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিবই ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা সৃষ্টি করে স্বায়ত্তশাসনের রূপ দান করেন। বাংলাদেশে অনেকেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে ছিল। জেনারেল আইয়ুব খান তার লিখিত উন্নয়নমূলক গ্রন্থ ঋৎরবহফ হড়ঃ সধংঃবৎং বইয়ে উন্নয়নের যে ফিরিস্তি লিখেছেন এরই বিপরীতে রাজশাহীর একজন ব্যাংক কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ঋৎরবহফ হড়ঃ ঋড়বং গ্রন্থ লিখে স্বায়ত্তশাসনের বৈষম্যগুলো নিরেটভাবে তুলে ধরেন। যারা বলেন, শেখ মুজিবের ভাষা আন্দোলনে তেমন কোনো অবদান নেই, যুক্তি দেখান তিনিতো জীবনের বিরাট সময় জেলে ছিলেন। তাদের কথা মিথ্যাচারে ভরা। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুখ্য ভূমিকা পালন করে ছিলেন। জাতীয় নেতারা জেলে থাকাকালে তিনি জেলের ভেতরে সভা করে সিদ্ধান্ত নিতেন যে, সব কর্মসূচি তা বাহিরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো এবং সেই অনুসারে আন্দোলন সংগ্রাম চলতো। তাছাড়া যখনি জেল থেকে বের হয়ে তিনি হাসপাতালে বা কোনো জনসভায় যেতেন, বুদ্ধি পরামর্শ ও কর্মসূচি সবাইকে জানিয়ে দিতেন। এমনকি জেল থেকে চিরকুট পাঠিয়ে নেতাদের কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করা হতো। এমনটা যদি হতো যে ভাষা আন্দোলনের দাবি মেনে নেওয়ার পর সরকার আন্দোলনকে স্থিমিত করতেন, তা হলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি এতটা প্রখর হতো না। তখনো স্বায়ত্তশাসেনের দাবি ছিল অসম্পূর্ণ। দুই পাকিস্তানের ভেতর অর্থনৈতিক বৈষম্যর প্রকৃতি কি ছিল এবং তার অবসান কীভাবে করা যেত সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বক্তব্যও কেউ পেশ করেননি। শুধু স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছেন। শেখ মুজিব একমাত্র বাঙালি নেতা- যিনি ৬ দফার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিলেন এবং কীভাবে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা যায় তার ধ্যান ধারণা দিলেন ৬ দফায়। অতি অল্পসময়ে জনগণ তার এই ৬ দফার পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক জন সমর্থন ও জনমত গড়ে উঠে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সারাদেশে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে আন্দোলন দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থা এমন হলো- গ্রামের মানুষ এক নজর শেখ মুজিবকে দেখার জন্য মশাল জ্বালিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতো। সরকার প্রমাদ গুলনেন। আইয়ুব খান ৬ দফাকে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেবেন বললেন। কিন্তু আইয়ুবের রক্ত চক্ষুকে বঙ্গবন্ধু ভয় পাননি। শুরু হলো আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন। মোনায়েম খান বললেন, শেখ মুজিবকে সুর্যের আলো দেখতে দেওয়া হবে না অর্থাৎ জেলে আবদ্ধ থাকবেন। কয়েক ডজন মামলা দিয়ে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করা হলো। জেলে থেকেও যে জেলায় তিনি গেছেন সেখানে আন্দোলন বেগবান হতো। এ সময় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক মিথ্যা মামলা দিয়ে ঢাকা জেল থেকে ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যান। তিনি জানতেন তাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য এই মামলা দেওয়া হয়েছে। এক মুঠো ধুলা কপালে মেখে সেনা নিবাসে প্রবেশ করলেন। সেখানে ক্যামেরা ট্রায়াল হলো। এর মাঝেই তাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়, এতে সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। সেনানিবাসের বাহিরে ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। জনগণ শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য সেনানিবাসের বাহিরে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ করলেন। জনরোষে সরকার শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বীর জনতা এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করলেন। তারপর সত্যিকার অর্থে তিনি বাংলার বন্ধু হিসেবে কাজ করেছেন। সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। ৬ দফাকে নির্বাচনি ম্যানডেট হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরা হলো। '৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুষ বিজয় অর্জন করে। তিনি পাকিস্তানের বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যোগ্যতা অর্জন করলেন। পাকিস্তানের নেতারা ভাবলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ মুজিব ৬ দফাকে ভুলে যাবেন। কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ৬ দফার সঙ্গে কোনো আপস নেই। কোনো কমা-দাড়ি- সেমিকোলন পরিবর্তন হবে না। ৬ দফাভিত্তিক সংবিধান রচনা করতে হবে। জনগণ ৬ দফায় সমর্থন দিয়েছে। তখন সরকার বুঝলেন পাকিস্তান রক্ষা করতে হলে যুদ্ধই একমাত্র পথ। পার্লামেন্টে অধিবেশন ডেকেও অনিবার্য কারণে তা স্থগিত করা হলো। শেখ মুজিব ৩ মার্চ আহ্বান জানালেন অসহযোগ আন্দোলনের। পাকিস্তান সরকারের কোনো শাসন না মানার নির্দেশ দিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অসহযোগ আন্দোলনে দুর্বল হয়ে পড়ে। শেখ মুজিবের কথায় প্রশাসন চলতে থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় পর্যন্ত শেখ মুজিবের কথা শোনত। শেখ মুজিব বিশ্ববাসীকে জানালেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নেতা। তিনি আরো জানালেন, পূর্ব পাকিস্তান শাসন করার নৈতিক ও আইনগত অধিকরা পাকিস্তান সরকারের নেই। এভাবে তিন সপ্তাহ চলল। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানের বরর্বর সেনাবাহিনী ঢাকায় হঠাৎ সামরিক অভিযান চালায়। ওই রাতে ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার বাঙালিকে হত্যা করল। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ পূর্বে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বীয় বাসভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষাণ দেন। সেই থেকে আমরা স্বাধীন। শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বললেন বাংলার মাটি থেকে চির তরে পাকিস্তানের শেষ সৈন্যকে খতম করা না পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। ৯ মাস যুদ্ধ চলল ভারত এই যুদ্ধে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে। অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাই ভারতের অবদান ভুলবার নয়। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই দিন আমাদের তাই মহান বিজয় দিবস। বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করে। ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রথম পর্ব। এই প্রথম পর্বে আমাদের শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের অবদান চিরস্মরণীয়। তাদের অবদান কোনো দিন ভুলবার নয়। কিছু লোক দালালি করলেও গোটা দেশ ছিল শেখ মুজিবের পক্ষে। তিনি ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রূপান্তর এবং স্বাধীনতার আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলতে সক্ষম হন। তিনি প্রথম বাঙালি, যিনি আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বাঙালি জাতিসত্তায় রূপান্তর করে জাতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন- তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, আমাদের মহান নেতা। ডা. এস এ মালেক: রাজনীদিক ও কলাম লেখক