শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিকারহীন সড়ক দুর্ঘটনা

শাকিবুল হাসান শিক্ষার্থী বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বিগত ২ বছরের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে ৪৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫২২৭ জন ও আহত হয়েছে ৬৯৫৩ জন। এর মধ্যে রেলপথে দুর্ঘটনা ১৬২টি, নিহত ১৯৮ জন, আহত ৩৪৭ জন। নৌপথে দুর্ঘটনা ৩০টি, নিহত ৬৪ জন, আহত ১৫৭ জন আর নিখোঁজ ১১০ জন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনগুলো হলো- বাস ৯৯২টি, ট্রাক ১০৩৩টি, মোটরসাইকেল ১০৯৮টি, কাভার্ড ভ্যান ১৬০টি, মাইক্রোবাস ১৫৮টি, নসিমন ৮৩টি, কার ৭৯টি ও অন্যান্য (সিএনজি/ভ্যান/পিক-আপ) ২১৭৮টি। এসব যানবাহনের মোট নিহত চালক হলো- ১১৯০ জন। যা মোট নিহতের ২২ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার জন পথচারী মারা গেছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৫০ দশমিক ০৪ শতাংশ। দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়েই আছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই আবার আয়ের কোনো উৎস নেই। তাই বাধ্য হয়ে তারা ভিক্ষা করে পরিবার-পরিজনকে কোনোমতে চারটে ভাতের ব্যবস্থা করে চলেছে। কেউবা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের স্মরণিকা প্রকাশ উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। আলোচনা সভায় তারা ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দোষীদের শাস্তি ও চালক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। সমাবেশে আলোচনাকালে 'পথ যেন হয় শান্তির, মৃতু্যর নয়,' স্স্নোগান সামনে রেখে আলোচনায় বক্তারা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান। তারা বলেন, শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর দেশে যে মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে তা নয় আর্থিক দিক দিয়েও দেশের প্রভুত ক্ষতি হচ্ছে। প্রধান অতিথি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবি দলমত নির্বিশেষে সবার। এখানে বিভেদের সুযোগ নেই। তিনি সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর আহ্বান জানান। বিশেষ অতিথি বলেন, ২৪ বছর থেকে নিসচা চিৎকার করছে, আইন তৈরি করো, শক্ত আইন বানাও। ২০১২ সালে আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু চার বছর পরও এর বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, ২৪ বছরে একটি দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো দুর্ঘটনার জন্য দোষীরা শাস্তি পাননি। দুর্ঘটনা হ্রাসে তিনি চালকদের প্রশিক্ষণের জোর দেন।

এটা সত্য, দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রায় প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। সংবাদপত্রে যেসব দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয় তার বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত প্রত্যন্ত এলাকায় যেসব সড়ক-দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় তার সব কটির খবর সংগ্রহ করা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। বস্তুত, দূরপালস্নার সড়ক পথে এবং বিশেষত হাইওয়েতে আর রাজধানী নগরীসহ দেশের বিভিন্ন শহর/বন্দরে যেসব সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে থাকে, প্রধানত সেসবের খবর সংবাদপত্রে ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে প্রচার পেয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও ছোট-বড় সড়কপথে প্রায় প্রতিদিন যেমন দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তেমনি অনেক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। শুধু দূরপালস্নার পথে ও হাইওয়েতে এবং দেশের বিভিন্ন শহর-বন্দরে নয় রাজধানীতে সংঘটিত হচ্ছে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। নগরীর অভ্যন্তরীণ রাজপথ তো বটেই, এমনকি রাজধানীর বুক চিরে বহিরাঞ্চলে চলে যাওয়া এয়ারপোর্ট রোড বা বিমানবন্দরের সুবিস্তৃত ও সুমসৃণ পথে সংঘটিত হচ্ছে দুর্ঘটনা। সারাদেশে জরিপ ও পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, নানা কারণে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা যেমন বিপুল, তেমনি এসব দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত, নিহত ও পঙ্গু হয়ে পড়া লোকের সংখ্যা হাজার হাজার। দেশে প্রতি বছর এই যে হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান, আহত হন পঙ্গু হয়ে শেষজীবন কাটানো তার জন্য তাদের উত্তরাধিকাররা ক্ষতিপূরণের খুব কম টাকাই পান। এদিকে চালকের বা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সাজাও হয় কম। প্রকৃতপক্ষে, সড়ক দুর্ঘটনা শুধু জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে না, দুর্ঘটনায় আকস্মিক ও অকাল মৃতু্যর শিকার হওয়ার দরুন অথবা মৃতু্যর হাত থেকে আপাত রেহাই পেলেও আহত ও পঙ্গু হয়ে পড়ার কারণে তাদের এবং তাদের পরিবার-পরিজন ও উত্তরাধিকারীদের জন্য বিরাট অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। অনেক পরিবার চিরকালের জন্য পঙ্গু ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মীয় ও উত্তরাধিকারীরা নানা পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ ও বিমার টাকা ইত্যাদি পায় না বলে একেবারে পথে বসে যায়। জরিপ ও পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হতভাগ্য ব্যক্তিদের উত্তরাধিকারীদের মতো, দেশের বিভিন্ন স্থানে যারা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন তাদের উত্তরাধিকারীরা বঞ্চনার শিকার।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত, আহত ও পঙ্গুদের হতভাগ্য উত্তরাধিকারীদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তথা বিমার টাকা পাওয়ার চেয়ে শতগুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো আদৌ তেমন পরিস্থিতির শিকার না হওয়া অর্থাৎ কারও সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত না হওয়া, আহত ও পঙ্গু হয়ে পড়ার মতো দুর্ভাগ্যের শিকার না হওয়া। দৈব-দুর্ঘটনার ওপর মানুষের কোনো হাত না থাকলেও পূর্বাহ্নে সতর্কতা অবলম্বন করলে এবং সাবধান হয়ে চললে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পায়। এ কথাটি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য ও সত্য। কেননা, সড়ক দুর্ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মূলে রয়েছে সংশ্লিষ্টদের অসতর্কতা ও দায়িত্বহীনতা। সড়ক পথের অপ্রশস্ততা ও উঁচু-নিচু অবস্থান, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রম্নটি-বিচু্যতি, যানবাহনের লক্কড়মার্কা অবস্থা, ড্রাইভারের অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, ওভারটেক করার প্রবণতা, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, পথচারীদের অসাবধানতা ও দায়িত্বহীনতা, গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি বহুবিধ কারণে সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। কি ধরনের বেপরোয়া ও উদ্দাম গতিতে চললে এবং আকস্মিকভাবে ওভারটেক করতে গেলে এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে তা সহজে অনুমেয়। অধিকাংশ যানবাহন চালকের যথেষ্ট অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা রয়েছে। একশ্রেণির ড্রাইভার রাজপথে ও দূরপালস্নার পথে এবং হাইওয়েতে যানবাহন চালাতে গিয়ে বেপরোয়া ও উদ্দাম হয়ে ওঠে, দুর্ঘটনার আশংকা এবং নিজের ও যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা বেমালুম ভুলে যায়। সড়ক পথে বিশেষত দূরপালস্নার পথে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং চেকিং ব্যবস্থার অভাব ড্রাইভারদের অবাধ, উদ্দাম ও বেপরোয়া করে তোলে। প্রতিটি বড় ধরনের এবং মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পর সংবাদপত্রে যথেষ্ট লেখালেখি হয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করার, দূরপালস্নার পথে ঘন

ঘন চেকিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়ার, ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন এবং অদক্ষ ও দায়িত্বহীন ড্রাইভার যাতে পাড়ি জমাতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানানো হয়। যানবাহনের ফিটনেস কড়াকড়িভাবে পরীক্ষা করা, ড্রাইভারের গাড়ির লাইসেন্স, ইন্সু্যরেন্স সার্টিফিকেট ইত্যাদি পরীক্ষা করা, ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন ও অদক্ষ ড্রাইভারকে পথে নামতে না দেওয়া ইত্যাদি বহুবিধ ব্যবস্থা কড়াকড়িভাবে গ্রহণের জন্য দাবি জানানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে এবং ড্রাইভারের অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে।

অনেক পুরনো এবং লক্কড়মার্কা যানবাহন যে নানা কায়দা-কৌশল ও বিভিন্ন উপায়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট আদায় করে এবং দূরপালস্নার পথে চলার পারমিশন পেয়ে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ পুরনো এবং হরহামেশাই মেলে। বহু যানবাহন বিশেষত বাস, মিনিবাস, ট্রাক ইত্যাদি যে লক্কড়মার্কা অবস্থার জন্য ধুঁকতে ধুঁকতে দূরপালস্নার পথ চলে, তা তো যাত্রীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। শুধু তাই নয়, চলার পথে মারাত্মক ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সংঘটিত করে এর জন্য দায়ী ড্রাইভার ও যানবাহন মালিকরা নানা কায়দা-কৌশলে ও দুর্নীতির আশ্রয়ে পার পেয়ে যায়। এমনকি, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ দানের খেসারত থেকে রক্ষা পায়। অধিকাংশে দেখা যায়, মারাত্মক দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়া এবং তাতে বহু লোক নিহত ও আহত হওয়া সত্ত্বে ড্রাইভাররা অক্ষতভাবে পালিয়ে যায়। তাদের টিকির সন্ধান সহজে পাওয়া যায় না। অনেকে মামলা-মোকদ্দমা থেকে সহজে ছাড়া পেয়ে যায়।

সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত, আহত ও পঙ্গু হওয়া মর্মান্তিক ঘটনা। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার না হওয়া এবং সাক্ষীর অভাবে অথবা নানা জটিলতার কারণে মামলা খারিজ হয়ে যাওয়া আরও দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।

সুতরাং, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে এর আদ্যোপান্ত সংস্কার করুন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তি সচেতনতাও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- অতিরিক্ত ভাড়ার লোভে অধিক যাত্রী পরিবহণ পরিহার করতে হবে, ওভারটেকিং বন্ধ করার পাশাপাশি গাড়ির মেশিন নিয়মিত চেক করতে হবে। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। সাধারণ মানুষকেও নিজ দায়িত্বে সচেতন হতে হবে, রাস্তা পারাপারের সময় উভয় দিকে খেয়াল রাখতে হবে, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও যাত্রী বোঝাই যানবাহন পরিহার করতে হবে। সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা থেকে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হবে। আসুন আমরা নিজ দায়িত্বে সচেতন হয়ে নিজে সুস্থ থাকি, অন্যকে সুস্থ রাখি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে