শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থান ধরে রাখতে হবে। করোনার প্রভাব থেকে বিশ্ব একদিন মুক্ত হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিও ফের আগের মতো চলতে শুরু করবে।
অলোক আচার্য
  ০১ মার্চ ২০২১, ০০:০০

২০২০ সাল জুড়েই চলেছে করোনাভাইরাসের তান্ডবলীলা। পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে এক অতিমারিকে। যার প্রভাবে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। চীনের উহান থেকে শুরু হওয়ার পর থেকেই মানুষ প্রথম যে চিন্তা করেছে তা হলো এই রোগ থেকে প্রতিকারের জন্য একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের। শুরু থেকেই সেই প্রচেষ্টায় ছিল পৃথিবীর বহুদেশের বহু বিজ্ঞানী। চলছিল গবেষণা। গত বছরের শেষ দিকে সেই প্রচেষ্টার সুখবর আসতে থাকে। এরই মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে প্রয়োগও শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর যখন নতুন করে শুরু হয় তখন আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেতে শুরু করে বিশ্ব। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। কারণ অর্থনীতি যে নিয়ামকগুলো নিয়ে উত্থান ঘটে সেগুলোও থেমে ছিল। যেমন- আমাদের গার্মেন্টস শিল্প। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এখনও ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এক তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে করোনার প্রভাবে ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে। ইউরোপ হলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় গন্তব্য। ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ রপ্তানি কমেছে ২৭ দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। করোনা অতিমারিতে ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। এক প্রকার থমকে ছিল বহু দেশ ও শহর। এ রপ্তানি কমেছে করোনাভাইরাসের প্রভাবে। আমাদের অর্থনীতির প্রাণ পোশাকশিল্প। আবার আমাদের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিচিত রেমিট্যান্স সেখানেও করোনার কারণে পরিস্থিতি নাজুক। করোনার কারণে অভিবাসনের হার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও কম। সংকট কাটিয়ে এসব খাতও আগের মতো হবে। কারণ এখন করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম চলছে ব্যাপকহারে। অর্থনীতিকে করোনার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করতে হবে কয়েকটি দিক থেকে। এক, যখন করোনাভাইরাস তার তান্ডব চালাচ্ছে তখন অর্থনীতিকে কীভাবে সামাল দেয়া যায়। দুই, করোনাভাইরাসের প্রভাব যখন কমে আসবে তখন অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগ দেয়া এবং সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতিতে যে ক্ষত থাকবে তা সারাতে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবস্থা গ্রহণ। করোনার প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনীতিতে মন্দাবস্থার ইঙ্গিত আগেই দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে বিশেষ করে শিল্পকারখানা বন্ধ থাকা, পর্যটন খাত বন্ধ থাকা এবং রেমিট্যান্সের মতো খাত থমকে যাওয়াতে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়েছে। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বকে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ঘিরে ছিল। আর এই সংকটে বেশি পড়ে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। যে মহামন্দার কথা বলা হয়েছিল, তা ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পর আর কখনো এতটা সংকোচন হয়নি বলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল।

দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলো দারিদ্র থেকে উত্তরণে বেশ ভালোভাবেই লড়াই করছিল করোনার পূর্বে। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর সেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃতু্য ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয় দেশগুলোকে। ফলে দরিদ্র থেকে উত্তরণে লড়াই করা দেশুগুলো সংকটে পড়ে। একদিকে দরিদ্র থেকে উত্তরণে লড়াই করার সক্ষমতা ধরে রাখা অন্যদিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমতা অর্জন করা। জনগণকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলো করোনাভাইরাসের সঙ্গে মোকাবিলা। ফলে অনেক দেশ তাদের চালিয়ে আসা উত্তরণের লড়াই থেকে পিছিয়ে পড়ে। দরিদ্র দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল দরিদ্রতা বিমোচনে কাজ করা। অনেক দেশ তা ভালোভাবেই সামাল দেওয়ার চেষ্টায় ছিল। জাতিসংঘের বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থার ভবিষ্যৎ রিপোর্টে বলা হয়েছে' অর্থনীতি যে অবস্থায় পতিত হয়েছে তা থেকে উত্তরণে দেশগুলোকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে একসময় থমকে থাকা অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছিল। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বেশ সময় লেগে যায়। জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুদ্ধে মানুষ লড়াই করেছিল করোনাভাইরাসের শঙ্কা নিয়েই। অর্থনীতির এমন অবস্থা শুধু দুয়েকটি দেশ বা দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় বরং বিশ্বব্যাপীই এর থাবা ফেলেছে। বড় বড় শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিও এখন লড়াই করছে ফিরে আসার। কারণ সেসব শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিল্পকারখানা বন্ধ ছিল। ফলে সেই দেশ এবং সেই দেশের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্রিটেনের অর্থনীতি গত ৩০০ বছরে এমন খারাপ অবস্থায় পড়েনি বলে বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দফা উদ্ধার পরিকল্পনা ঘোষণা করার পরও শঙ্কা রয়ে গেছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা শুরুর আগে বাংলাদেশের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশগুলো দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু করোনা শুরুর পর এ উন্নতিতে ভাটা পড়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা, দারিদ্র্য কমানো, জ্বালানি, আয় বৈষম্য দূর করা, লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনা, মৌলিক পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি খাতে দেশগুলোর উন্নতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এখন অনেক দেশকে এ খাতে নতুন করে শুরু করতে হবে। থেমে যাওয়া অর্থনীতি পুনরায় শরু করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। করোনায় অসুবিধা তৈরি হওয়ার পর সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে আবার বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা এবং নগদ অর্থ দেওয়া অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকা গেছে। গৃহহীনদের ঘর দেওয়া হচ্ছে। এসব সরকারের নানামুখী উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার ফলে দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করা মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। নতুন স্বপ্ন দেখছে। করোনার ফলে তারা যেখানেই থেমে ছিল তারা আবার নতুন করে শুরু করছে। করোনা মহামারির মতো একটি বৈশ্বিক সংকটে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবাই। ফলে যারা যার অবস্থান থেকে ফিরে আসার লড়াই করছে।

অর্থনীতির একটি দিক চাকরির বাজার। করোনার কারণে এই দিকেও টালমাটাল অবস্থার তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ সেটা এখন সামলে নিচ্ছে। বাংলাদেশও সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে। বিশ্ব অর্থনীতির মূল ধাক্কাটা কর্মী ছাঁটাইয়ের মধ্যে দিয়ে ঘটবে বলে মনে করা হয়েছিল। বস্তুত ঘটছিলও তাই। অর্থনীতির অবস্থানের সঙ্গে বেকারত্বের সম্পর্ক রয়েছে। কর্মহীন মানে অর্থনীতির জন্য মন্দা। ফলে দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবন লাভের এই প্রক্রিয়ায় কর্মসংস্থানের দিকে জোর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন খাত এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ অর্থনীতির বহু চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে আজকের অবস্থায় এনেছে। এ দেশ যে তলাবিহীন ঝুড়ি নয় তা প্রমাণ করেছে বহু আগেই। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে বহু আগেই। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। সেই প্রায় শূন্য থেকে শুরু করা দেশটি আজ উন্নয়নশীল দেশের আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্রের দ্বারপ্রান্তে। অবসান ঘটবে দীর্ঘ ৪৩ বছরের এলডিসি। পদ্মা সেতু নিজ অর্থায়নে নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছি। এই আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাদের শুরু হবে উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণে পথ চলা। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিন্ম মধ্যআয়ের দেশের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যে তিনটি সূচক থাকে তার সবকটি পূরণ হয় ২০১৮ সালেই। উন্নয়নশীল দেশের ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা সব সূচকেই সক্ষমতা নিয়ে এ লক্ষ্যে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থান ধরে রাখতে হবে। করোনার প্রভাব থেকে বিশ্ব একদিন মুক্ত হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিও ফের আগের মতো চলতে শুরু করবে।

অলোক আচার্য :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে