শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে

সামাজিক অবক্ষয়, অপরাধ, সন্ত্রাস, মাদকসহ নানা অপকর্ম রোধ করতে হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। আর ধর্মীয় মোড়কে এ দেশের মানুষকে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বানানোর প্রচেষ্টাটি হতে হবে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ। তাহলেই সোনার বাংলা তার প্রকৃত রূপ ফিরে পাবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ০২ মার্চ ২০২১, ০০:০০

শেষ হলো ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারি। এই মাসেই বিশ্ববাসী উদযাপন করল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটায়। তাই ভাষা মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে ওই সংস্কৃতির ধারার রয়েছে একটি নিগূঢ় সম্পর্ক। মানুষ তার সংস্কৃতির শেকড়ের নিগূঢ় সম্পর্ক থেকে বিচু্যত হতে পারে না। যদি কোনো কারণে সংস্কৃতির বলয়ের বিচু্যতি ঘটে তখন দেখা যায় নানা রকমের সামাজিক অস্থিরতা। মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের জন্য এ বছর তেমন ঘটা করে পালন করা হয়নি ইংরেজি ২০২১ সালের শুভাগমন। তারপরও ৩১ ফার্স্ট নাইটে চোলাই মদ খেয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মারা গেছে দুই ডজন মানুষ। এটাই হলো বিদেশি সংস্কৃতি এ দেশের লালনের ফসল। ৩১ ফার্স্ট নাইটের সংস্কৃতির ধারাটি কী বাংলার সংস্কৃতি? অথচ এই করোনা মহামারিতেও সব নিয়ম-কানুন ও স্বাস্থ্য বিধি উপেক্ষা করে কেন মানুষ ৩১ ফার্র্স্ট নাইট উদযাপন করল? কারণ এ দেশের কিছু মানুষ এখনো ইংরেজিকে মনে করে উচ্চাসনের একটি সংস্কৃতি, এই থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রচলন ইংরেজি সংস্কৃতি থেকে আর বাংলা সংস্কৃতির সাংঘর্ষিক এ সংস্কৃতি লালন করতে গিয়ে দেশের উঠতি বয়সি যুবকরা বিপথগামী হচ্ছে। আর এটাই হলো এক ধরনের সংস্কৃতিক অবক্ষয়। গত বছরেই ১৮ ডিসেম্বর দেখা গেল আরবি ভাষা দিবস উদযাপন করতে। আরবি সংস্কৃতির প্রভাবে এ দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা। মাদ্রাসার শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র বলাৎকারসহ নানা অপসংস্কৃতিমূলক কর্মকান্ড। বাংলাদেশে এখন দুটো সংস্কৃতির টানাটানি চলছে- যার ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা আর এই টানাটানির ফলাফলে ঘটছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা। কারণ বাস্ুত্মচু্যত মানুষের ঠাঁই কোথায় মিলবে তা সে নিজেও জানে না। যখন মানুষ নিজের সংস্কৃতির বাইরে অন্যের সংস্কৃতি চর্চা শুরু করে তখন সে হয়ে যায় বাস্তুচু্যত। আর এ ধরনের বাস্তুচু্যতরা নিজেদের নিয়ে পড়ে যায় বিপাকে আর তাদের কর্তৃক-ই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। এ দেশের মহলবিশেষে কিছুগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকিয়ে এ দেশের মানুষকে মূল সংস্কৃতির ধারা থেকে বৃন্তচু্যত করার চেষ্টায় লিপ্ত, আবার আরেকটিগোষ্ঠী পুঁজিবিকাশ এবং মুনাফা লুট করার উদ্দেশ্যে এ দেশের মানুষকে বিদেশি সংস্কৃতির অবয়বে বানাচ্ছে উগ্র আধুনিক। এই দুদলের চাপে দেশীয় সংস্কৃতি ও জীবনপ্রণালিতে ঘটছে নানা ধরনের ব্যতয় এবং এই ব্যতয়গুলোর প্রভাবে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা আর সমস্যাগুলোর মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে অপরাধ।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের ধর্ম পালন বিষয়টি কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে মানুষকে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, ধরা যাক, ভারতের উত্তর প্রদেশের হিন্দু ধর্মপালনকারী হিন্দি ভাষী কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশে আসেন, তিনি এ দেশের একজন হিন্দু ধর্ম পালনকারী বাঙালির সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন তারপর দেখা যাবে যে, আগত ব্যক্তিটি বাঙালির সংস্কৃতির ধারার মানুষটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন না, অপরদিকে আরবীয় কোনো মুসলিম ধর্ম পালনকারী বাংলাদেশে এসে বাঙালি মুসলিম ধর্ম পালনকারীর সঙ্গে নিজকে খাপ খাইয়ে চলতে পারবেন না। এর মূল কারণ হলো, উভয়ের ক্ষেত্রে যে বিপত্তিটা দেখা দেবে তা হলো, তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলা একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে যায়, কারণ একজন অন্যজনের কথা বুঝবেন না। দ্বিতীয়ত, খাদ্যাভ্যাসে থাকবে ব্যাপক অমিল। তৃতীয়ত, স্বভাবসুলভ আচরণগুলোতে থাকবে ব্যাপক পার্থক্য। চতুর্থত, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ম্যানার- এ ক্ষেত্রেও দেখা দেবে ভিন্নতা। তাছাড়া ধর্ম পালনের রীতিগত প্রথাগুলোর মাঝে দেখা যাবে কিছু ভিন্ন প্রথা ( যদিও এটা যত সামান্য বিষয়)। শুধুমাত্র মিল থাকবে একই ধর্ম অনুসারী হিসেবে। অপরদিকে একজন বাঙালি হিন্দু ধর্ম পালনকারী ব্যক্তি এবং মুসলিম ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির মধ্যে দুইটি ভিন্ন ধর্ম ছাড়া সব কিছুর মিল থাকবে। তাহলে কেন ধর্মীয় সূচককে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু নিরূপণ করা হয়? ধর্মীয়সূচকের মাধ্যমে মানুষকে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু হিসেবে চিহ্নিত করার কাজটি স্বয়ং রাষ্ট্র করে থাকে। তা যে কেবল বাংলাদেশ বা ভারতে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়; সারা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে এরকম লঘু-গুরু নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া। আর চলমান ধরনের প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখার মূল কারণ তাদের সংস্কৃতিবাণিজ্য। এর ফলে পুঁজিবাদীরা সংস্কৃতিবাণিজ্য চালায় অবলীলায়। কারণ সারা পৃথিবীতে ইংরেজি মাতৃভাষা এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, অথচ তাদের সংস্কৃতি আধিপত্য বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বর্তমানে ভারতীয় সংস্কৃতিক আগ্রাসন বেড়েছে ইংরেজি সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বেশি। ভারতীয়রা জাতীয়ভাবে ইংরেজি ভাষাকে লালন করে থাকে। কারণ ভারত বহু ভাষাভাষীর একটি দেশ। তাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্যে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ভারতীয়দের কাছে ইঙরেজি একটি অপরিহার্য ভাষা। তাই ভারতীয়রা তাদের জাতীয় দাপ্তরিক কাজে ইংরেজি ভাষাকে ব্যবহার করে থাকে। ভারতীয়দের ইংরেজির ভাবধারার প্রভাব বলয়টি বাংলাদেশের ওপর বিস্তার লাভ করছে খুবই সূক্ষ্নভাবে। ভারতীয়রাই পরোক্ষভাবে এই কাজটি করে আসছে। বিভিন্ন আড্ডায় বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয়দের অপছন্দ করে নানা ধরনের কথা বলে থাকেন, এই অপছন্দের মূল কারণ ধর্মীয় ভাবাবেগ তারা; কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির প্রলেপের বলয় থেকে নিজেদের মুক্ত না করে বরং যুক্ত করার চেষ্টাই করে থাকেন। অনেকেই বলে থাকেন, বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি শেখা ছাড়া গত্যান্তর নেই, প্রশ্ন হলো, চীনারা কি ইংরেজি লালন করে বা কোনোকালে করেছিল। সারা বিশ্ব এখন সয়লাব চীনা প্রযুক্তিতে। চীনারা যদি ইংরেজি না শেখে সারা বিশ্ব বাণিজ্যে আধিপত্য স্থাপন করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?

পৃথিবীতে ঊর্ধ্ব ক্রমানুসারে চীনা ভাষায় কথা বলে প্রায় ১২৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষ, স্পেনিশ ভাষায় ৪৩ কোটি ৭০ লাখ, ইংরেজি ৩৭ কোটি ২০ লাখ, আরবি ২৯ কোটি ৫০ লাখ, বাংলা ২৯ কোটি ৫০ লাখ, পর্তুগিজ ২১ কোটি ৯০ লাখ, রুশ ভাষায় ১৫ কোটি ৪০ লাখ, জাপানি ১৩ কোটি ও লাহান্দা ১১ কোটি ৯০ লাখ। এছাড়া অন্যান্য যে ভাষাগুলো রয়েছে সেগুলোতে কথা বলে অবশিষ্ট মানুষ। চীনারা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে না, তাদের সংস্কৃতিতে ইংরেজি সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে পারেনি। এই কারণে দেখা যায়, বিভিন্ন কূটকৌশলে চীনাদের সম্পর্কে ধর্মীয় আবরণে ছড়ানো হয় নানা ধরনের বিদ্বেষ। প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা ওই অঞ্চলের প্রচলিত সংস্কৃতির ধারকবাহক। ধর্ম হলো মানুষের মনস্তাত্ত্ব্বিক ধ্যান ধারণা। মূলত ধর্ম হলো বিমূর্ত এক বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতিকে মিলানোর প্রচেষ্টাও মঙ্গলজনক নয়। আর এ ধরনের মেলানোর প্রচেষ্টার কারণে ধর্ম এবং সংস্কৃতি দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে এ দেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের যে মিল রয়েছে, এই মিলটাকে অধিকতর ধার্মিক করার লক্ষ্যে আরবীয় সংস্কৃতি বা উর্দু সংস্কৃতি মেলানোর চেষ্টা করলে তাতে ভালো ফল আশা করা যাবে না। অপরদিকে হিন্দি বা ইংরেজি সংস্কৃতির সঙ্গে মেলাতে গেলেও হয়ে যাবে অতি উগ্র আধুনিকতা- যা মানান সই হবে না। ফলে মূল সংস্কৃতির ধারাটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুশাসনগুলো হয়ে যাবে অকার্যকর। ফলে সামগ্রিক বিষয়গুলোই ভেস্তে যাবে। ধর্মীয় সূচকে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু নির্ধারণ করার আরেকটি কারণ হলো, প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ম পালনকারী জনসংখ্যাকে আনুপাতিক হারে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু নির্ধারণ করে, সংখ্যাগুরুদের মনোজগতের প্রবেশ করার মাধ্যমে তাদের সমর্থন আদায় করা, এই সমর্থনের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকে থাকা বা যাওয়ার পথটা সুগম করা যায়। বিশ্বের দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতা ধরে রাখার মূল হাতিয়ার হলো ধর্ম।

সামাজিক অবক্ষয়, অপরাধ, সন্ত্রাস, মাদকসহ নানা অপকর্ম রোধ করতে হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। আর ধর্মীয় মোড়কে এ দেশের মানুষকে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বানানোর প্রচেষ্টাটি হতে হবে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ। তাহলেই সোনার বাংলা তার প্রকৃত রূপ ফিরে পাবে।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে