বেকারত্ব ও রাষ্ট্রের দায়

করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, করোনাকালে লাখো লাখো চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার।

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

সাধন সরকার
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সাল তরুণদের জীবনে মহাসংকট নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সেশনজট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ থাকায় বেকারত্ব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। করোনা মহামারি তরুণ থেকে শুরু করে সবার স্বাভাবিক জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কয়েকমাস ধরে বন্ধ থাকার ফলে লাখো লাখো বেকার তরুণ চাকরিতে আবেদনের তথা যোগদানের বয়স হারিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়ার দীর্ঘদিনের দাবি করোনাকালে আরও জোরালো হয়েছে। করোনাকালের পরিবর্তিত বাস্তবতা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজটের সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা আটকে থাকার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র। যদিও ইতিমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব পরীক্ষা বাকি আছে সেসব পরীক্ষা শেষ করতেও চলতি বছর পার হয়ে যাবে! সময় চলে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে। করোনাকালে কত শত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীর জীবন থেকে চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে গেছে তার হিসাব কে রাখে! একজন চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের জীবনে চাকরির আবেদনের বয়স পার হওয়ার শেষ দিনগুলো যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেই ভুক্তভোগীই শুধু বলতে পারবে। করোনা মহামারির কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা, ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। তবে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। করোনার এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল! বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাখো লাখো চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া ও সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো সময়ের দাবি। শুধু করোনার এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতর ও বাহিরে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। যদিও তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চলল। গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গড় আয়ু ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। প্রত্যেক বছর গেল বছরের চেয়ে আরও বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, এ দেশে বর্তমানে লাখো লাখো ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে যেন অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বাধিক। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা '৩০' এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হলে যে যার দক্ষতা অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার ওপর নয়, উন্নত দেশসমূহ দক্ষতার ওপর সবচেয়ে জোর দিয়ে থাকে। করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, করোনাকালে লাখো লাখো চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বরং সব পর্যায়ের তারুণ্যের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধাসমূহ হলো- ১, চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়লে সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে। ২, উন্নত দেশসমূহের সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ৩, শিক্ষিত বেকারের হার কমবে। ৪, রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে। ৫, মেধা পাচার বন্ধ হবে। ৬, অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। ৭, রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশি সময় পাবে। ৮, তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। ৯, গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ১০, বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে। ১১, শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং ১২, সর্বোপরি তরুণ জনগোষ্ঠী ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে। সাধন সরকার : কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী